মনে পড়ে চাচা চৌধুরী, বিল্লু আর পিঙ্কির কথা? কোথায় ছিল ডারমন্ড কমিকসের আঁতুরঘর?

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
21 January, 2023, 08:40 pm
Last modified: 21 January, 2023, 09:45 pm
চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কি, রমন, শ্রীমতিজি, মোটু-পাতলু, ছোটু-লম্বু—জনপ্রিয় সব নাম। এই কমিকস চরিত্রগুলো যেন আমাদের ঘরেরই সদস্য। এই চরিত্রগুলোর আঁতুড়ঘরের নাম ডায়মন্ড কমিকস। আর প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠেছে এমন এক মানুষের হাত ধরে, যিনি এই ব্যবসায় আসতেই আগ্রহী ছিলেন না!

গুলশান রাই ভার্মা স্নাতক করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে। তার পরিবারের ছিল হিন্দি পাল্প ফিকশন আর ধর্মীয় বইয়ের ব্যবসায়। পারিবারিক ব্যবসায় তার আগ্রহ কমই ছিল। তবে ১৯৭৮ সালে তিনি যখন জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রিন্টিং টেকনোলজির ওপর ডিপ্লোমা কোর্স করে আসেন, তখন দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেল। ১৯৭৮ সালে ভাই নরেন্দ্র ভার্মাকে নিয়ে গুলশান শুরু করেন ডায়মন্ড কমিকসের প্রকাশনা। 

ভার্মা ভাইয়েরা এমন এক সময় তাদের প্রকাশনা শুরু করেন, যখন মুম্বাইভিত্তিক ইন্দ্রজাল কমিকস ও অমর চিত্রকথার মতো হিন্দি কমিকস দিল্লী আর মীরাটের সস্তা উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল।

এই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসেন গুলশান রাই। ফ্যান্টম ও ম্যানড্রেক দ্য ম্যাজিশিয়ানের মতো চরিত্রগুলোর প্রকাশনা এবং বিতরণ করার লাইসেন্স নেন তিনি। ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজ দারুণভাবে গ্রহণ করে নেয় এই কমিকস দুটি।

এরপর গুলশান হাত বাড়ান প্রাণের কমিকসগুলোর দিকে। চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কি, রমন ও শ্রীমতিজির মতো চরিত্র হয়ে ওঠে বাসাবাড়ির নিয়মিত নাম। তাদের সাথে যোগ হয় মোটু-পাতলু, ছোটু-লম্বু, তৌজি, রাজন-ইকবাল, ভারতীয় কমিকস জগতের প্রথম নিজস্ব সুপারহিরো ফৌলাদি সিং। একইসাথে কিছু অ্যাডভেঞ্চার জনরা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান গুলশান। নিয়ে আসেন মহাবলী শাকা, ডিনামাইট ও অগ্নিপুত্র অভয়ের মতো কিছু অ্যান্টি-হিরো চরিত্র, যাদের সৃষ্টি হয়েছিল বলিউড থেকে। জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রগুলোর স্টিল ইমেজকে কমিকস রূপ দিয়ে প্রকাশ করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ফিল্ম চিত্রকথা।

নৈতিক বার্তার পাশাপাশি ডায়মন্ড কমিকস আরেকটি জিনিসের ওপর জোর দেয়: বিজ্ঞাপন। তাদের রঙিন কমিকসগুলো ছিল সস্তা, সহজলভ্য কাগজে ছাপানো। আর তাতে থাকত প্রচুর বিজ্ঞাপন। তারাই প্রথম তাদের কমিকসের সঙ্গে সরাসরি স্পন্সরযুক্ত বাচ্চাদের পণ্য বাজারে আনে। রাসনা, ব্রিটানিয়া, পার্লে, ম্যাগির মতো বড় ব্র্যান্ডগুলোর সাথে যৌথভাবে কাজ করতে থাকে ডায়মন্ড কমিকস। যার ফলে কমিকসের বাজারে মোটামুটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে তারা।

কেবল বিজ্ঞাপনগ্রহীতা হিসেবেই নয়, বরং নিজেদের বিজ্ঞাপনও অন্যান্য মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন গুলশান রাই। প্রিন্ট থেকে রেডিও পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তাদের বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন, 'চুন্নু পাড়তা ডায়মন্ড কমিকস, মুন্নু পাড়তা ডায়মন্ড কমিকস, মাজেদার হ্যায় ডায়মন্ড কমিকস'।

অনুবাদের ওপর জোর দিয়ে বিভিন্ন ভাষায় তাদের চরিত্রগুলোকেই ছড়িয়ে দেয় ডায়মন্ড কমিকস। কাজে লাগায় তাদের বিশাল ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কগুলোকে। ট্রেন স্টেশন থেকে শুরু করে শহুরে এলাকার রাস্তার বইয়ের দোকানগুলোতে সহজেই পাওয়া যেতে থাকে 'ডায়মন্ড কমিকস'। বয়স, অবস্থান, ভাষা ও সাক্ষরতার স্তরকে ছাপিয়ে তারা গড়ে তোলে এক বিশাল পাঠকসমাজ, এক মিডিয়া সাম্রাজ্য, যা আজও দাঁড়িয়ে আছে।

একটি ট্রান্সমিডিয়া সাম্রাজ্য

যা-ই হোক, গুলশান রাইয়ের অবদান কেবল একজন প্রকাশকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অ্যাসেম্বলি লাইনের মতো মাসের পর মাস একই গতিতে নির্দিষ্ট সময় পরপর শত শত কমিকসের সম্পাদনাও তাকে কেন্দ্র করেই হতো। তেমন একটা স্বীকার না করা হলেও ছোটু-লম্বু, তৌজি, ডিনামাইট, শাকাসহ অন্যান্য চরিত্রের ধারণার অনেকখানিই বের হয়েছিল তার মাথা থেকেই।

মারভেল কমিকসের মারভেল বুলপেনের মতো সম্পাদক প্রায়ই কমিকসের প্লট তৈরি করতেন। তার ওপর ভিত্তি করেই লেখক, পেন্সিলার ও কালারিস্টরা পুরো কমিকসকে রূপ দিতেন। এরপর অনুবাদকদের মাধ্যমে একাধিক ভাষায় সংলাপ অনুবাদ করা হতো, যা সারা দেশজুড়ে কমিকগুলোর আবেদন বাড়িয়ে দেয়।

গুলশান রাই। ছবি: সংগৃহীত

রাইয়ের অধীনে ডায়মন্ড কমিকসের কমিকসশিল্পীদের নাম বড় করে প্রদর্শন করা হতো। প্রত্যেক সংখ্যার প্রচ্ছদে বড় বড় হরফে শিল্পীদের নাম ছাপা হতো। তবে ফ্রিল্যান্সারদের ভাড়া করা শুরু হলে এই ব্যবস্থায় ভাটা পড়ে। তখন সবার কাজই একটা নামে প্রকাশ করা হতো। ফলাফল হিসেবে স্বয়ং রাইয়ের অনেক অবদানও চাপা পড়ে যায়।

পূর্ণাঙ্গ কমিক বইয়ে চাচা চৌধুরীর রূপান্তর সম্ভবত এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মূল চাচা চৌধুরীর বয়স্ক, গ্রামীণ, কৃষি দর্শনবান্ধব সাজসজ্জা প্রতিস্থাপিত হয় একটি সুসজ্জিত, মধ্যবিত্ত শহরতলীর চাচা চৌধুরী দিয়ে। পরের এই বৈশিষ্ট্যই সবার কাছে পরিচিত।

এগুলোকে যদিও দেশের অসম নগরায়নের প্রতিফলন হিসাবে দেখা যায়, তবে এটি এক ট্রান্সমিডিয়া সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে দিয়েছিল। লাইভ-অ্যাকশন ও অ্যানিমেটেড শোতে রূপান্তর করার ভালো ভালো গল্প উঠে আসতে থাকে এসব কমিকস থেকে। বলিউডও তাদের গল্পের জন্য কমিকসের চরিত্রগুলোকে ধার করতে থাকে।

ডায়মন্ড কমিকস এখনো পারিবারিক মালিকানাধীন ব্যবসা হিসাবে চলছে। ডিজিটালাইজেশন করে, মেটাভার্সে বিনিয়োগ করে তারা ভবিষ্যতেও টিকে থাকার জন্য বাজি ধরেছে। ডায়মন্ডের সাফল্য অনুপ্রাণিত করেছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ কমিকস, মনোজ কমিকসসহ অনেক প্রতিষ্ঠানকে। তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে মারা যাওয়া গুলশান রাই যে বিশাল শূন্যস্থান তৈরি করে গেছেন, তা পূরণ করার মতো ক্ষমতা এখনও ভারতীয় কমিকস জগতের কারোর হয়নি।

একই বছরের শুরুতে ব্যবসায়িক রিয়েলিটি শো 'শার্ক ট্যাঙ্ক ইন্ডিয়া'তে হাজির হয়েছিলেন প্রাণের একসময়ের ইন্টার্ন কার্টুনিস্ট সুমিত কুমার। উদ্দেশ্য, নিজের কমিকস ও অ্যানিমেশন কোম্পানি বাকারম্যাক্সের জন্য বিনিয়োগ জোগাড় করা। বিনিয়োগকারীরা তার উপস্থাপন দেখে বিনোদিত হলেও কেউই বিনিয়োগ করতে রাজি হননি। বদলে বাকারম্যাক্সের লাভ বাড়ানোর জন্য অ্যানিমেশন-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর দিকে আরও মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।

ভারত পে-র প্রতিষ্ঠাতা আশনির গ্রোভার সুমিত কুমারকে অ্যাখ্যা দেন এমন ব্যক্তি হিসেবে, যিনি নিজের কমিকস দেখে নিজেই হাসেন। যে কারণে বাকারম্যাক্স তাদের লাভজনক অ্যানিমেটেড প্রজেক্টগুলোকে বাদ দিয়ে কমিকস বইয়েই ডুবে আছে। ভারতীয় বাজারে কমিকসের অন্ধকার যুগ হিসেবে পরিচিত ১৯৯০ থেকে ২০০৭ সালেও গুলশান রাই তার কোম্পানিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন, যে সময় কমিকসের চাহিদা একেবারেই কমে যায়। সেই গুলশান রাইও ইংরেজি ভাষার গ্রাফিক নভেল এবং সংকলনের নতুন ঢেউ থেকে দূরে ছিলেন। তার মতে, 'কমিকস জগতে এদের বিচরণ বাজারের ১১-১৭ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আপনি যদি মেট্রোপলিটন শহরগুলো থেকে বেরিয়ে যান, তবে কেউ এদের সম্পর্কে জানে না।'

ভারতের একটি গণসংস্কৃতি হিসেবে পুনরায় চালু হওয়ার ক্ষমতাও কমিকসের আছে। এটি করার জন্য স্থানীয় ভাষা ও অনুবাদের সাহায্য নিতে হবে। গুলশান রাই ডায়মন্ড কমিকসের মাধ্যমে আগেই প্রমাণ করে গিয়েছেন যে এটি সম্ভব। বাকারম্যাক্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন যা প্রয়োজন তা হলো ১৯৭০-এর দশকে প্রাণের যে জিনিসের প্রয়োজন ছিল সেটিই। গুলশান রাইয়ের মতো এমন একজন ব্যক্তি, যার বিনিয়োগ করার মতো অর্থ এবং কমিকসকে সারা ভারতবাসীর কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো দৃষ্টিশক্তি রয়েছে।


  • সূত্র: স্ক্রল ডটইন

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.