মোগল-মারাঠা যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্মকর্তা যেভাবে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে নেয়!

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
01 January, 2023, 01:30 pm
Last modified: 01 January, 2023, 02:46 pm
অবরোধ আট বছর স্থায়ী হয়। এই সময়ে হিগিনসন কোনো পক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষতার অবস্থান বেছে নেন। মারাঠারা যখন মোগল সেনাপতি আলী মারদান খানকে বন্দী করে, তখন তিনি মধ্যস্থতা করতে অস্বীকার করেন।

৩ অক্টোবর, ১৬৯২। দক্ষিণ ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন কার্যক্রমের কেন্দ্র ফোর্ট সেন্ট জর্জের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ন্যাথানিয়েল হিগিনসন। তার পূর্বসূরি এলিহু ইয়েলের মতো হিগিনসনও আমেরিকায় ব্রিটেনের নতুন উপনিবেশ নিউ ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে অন্যান্য সবকিছুতেই দুজনের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক।

জেমস ট্যালবয়স হুইলার এবং হেনরি ডেভিসন লাভের মতো ইতিহাসবিদরা হিগিনসনের ছয় বছরের মেয়াদকে 'শান্তি ও অগ্রগতির সময়' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে, ইয়েলের ছিল বিতর্কে ভরপুর: তার বিরুদ্ধে কোম্পানির পণ্যগুলো আত্মসাৎ করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে একজন ব্যবসায়ীর সাথে যোগসাজশ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এবং তার এই বিতর্কিত কাজগুলো হিগিনসনের সমযয়ের ওপরও দীর্ঘ ছায়া ফেলেছিল।

বিতর্কিত সময়

নাথানিয়েল হিগিনসন জন্মগ্রহণ করেন কানেকটিকাটের গিলফোর্ডে, ১৬৫২ সালের অক্টোবরে। তার দাদা ফ্রান্সিস একজন মন্ত্রী ছিলেন যিনি একটি বিতর্কিত সময়ে তার পরিবারের সাথে ইংল্যান্ড ছেড়েছিলেন। রাজকীয় ক্ষমতার অবসান এবং পার্লামেন্ট ব্যবস্থার উত্থানের দাবিতে তখন ইউরোপজুড়ে ধর্মীয় সংস্কার ও অভ্যুত্থানের হিড়িক চলছে। ইংল্যান্ডেও বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চের সাথে বিবাদে লিপ্ত।

আমেরিকাতেও বিভেদ দেখা দিয়েছে। হিগিনসনদের মতো পিউরিটানরা কোয়াকারদের মতো অন্য প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদাযয়ের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে উপনিবেশবাদীরা নিউ ইংল্যান্ডের বাইরে পশম ব্যবসা এবং জমির নিয়ন্ত্রণের জন্য ফরাসি, ডাচ এবং নেটিভ আমেরিকান উপজাতিদের সাথে লড়াই করছে। সপ্তদশ শতাব্দীর আমেরিকা ছিল অনিশ্চিত জীবনের অন্য নাম।

হিগিনসনের বাবা জন ১৬৬৯-এ ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এক ঝড় তার জাহাজকে সালেমের বন্দরে টেনে নিয়ে যায়। ঘটনাক্রমে সেই এলাকায় থাকা সম্প্রদায়ের একজন যাজকের প্রয়োজন ছিল। তাই জনও তার বাকি জীবনের জন্য সেখানে বসতি স্থাপন করেন।

হিগিনসন ১৬৭০ সালে হার্ভার্ড কলেজ থেকে স্নাতক হন এবং চার বছর পর তার দাদার ফেলে আসা দেশ ইংল্যান্ডে চলে আসেন। সফরটি সংক্ষিপ্ত হওয়ারই কথা ছিল। ফরাসি এবং স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের সাথে যুদ্ধের ফলে ব্রিটেনের আমেরিকান উপনিবেশগুলোকে দরিদ্র করে দিয়েছিল। হিগিনসনও সেটি ছেড়ে আরও ভালো জায়গায় থাকার খোঁজে ছিলেন। ইংল্যান্ডে তিনি প্রথমে এক অভিজাত পরিবারের সন্তানদের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তারপর লন্ডন টাওয়ারের টাকশালের সুপারভাইজার হন।

ভারতে হিগিনসন

১৬৮৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মকর্তা হিসেবে ভারতে পাড়ি জমান হিগিনসন। ১৬৮৮ সালে হন মাদ্রাজ কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র, যা ইংল্যান্ডের রয়্যাল চার্টার দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকজন সেখানে একত্রিত হয়েছিল: 'আর্মেনিয়ান, হিব্রু, পর্তুগিজ, জেন্টু (তৎকালীন সময়ে স্থানীয় হিন্দুদের জন্য ইংরেজদের দেওয়া নাম) এবং মুর (মুসলমান)'।

চার বছর পরে কাউন্সিলের দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে তিনি নিজেকে ফোর্ট সেন্ট জর্জের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন, যখন ইয়েল তার অবস্থান থেকে সরে আসেন। ঐ বছরই তিনি একজন ইংরেজ মহিলা এলিজাবেথ রিচার্ডসকে বিয়ে করেন, যার পিতা পূর্বে বালাসোরে (ঊড়িষ্যা) কোম্পানির ব্যবসায়ী ছিলেন। তাদের ঘরে নয় সন্তানের জন্ম হয়, যাদের মধ্যে চারজন শৈশবেই মারা যায়।

প্রেসিডেন্ট হিসাবে হিগিনসনকে শুধুমাত্র তার পূর্বসূরির অপকর্মের দিকেই নজর রাখতে হয়নি, বরং এই অঞ্চলে নজর দেওয়া অন্যান্য শক্তিগুলোর সাথেও সতর্কভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়েছিল। ১৬৯০ সালে শিবাজীর পুত্র রাজারামের নেতৃত্বে মারাঠাদের একটি দল সেন্ট জর্জ ফোর্ট থেকে ১৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে জিঞ্জির দুর্গে আশ্রয় চায়। এবং শীঘ্রই তারা  কর্ণাটকের প্রথম নবাব জুলফিকার খান এবং স্বরূপ সিং বুন্দেলার নেতৃত্বে থাকা মোগল বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়।

অবরোধ আট বছর স্থায়ী হয়। এই সময়ে হিগিনসন কোনো পক্ষে না গিয়ে নিরপেক্ষতার অবস্থান বেছে নেন। মারাঠারা যখন মোগল সেনাপতি আলী মারদান খানকে বন্দী করে, তখন তিনি মধ্যস্থতা করতে অস্বীকার করেন। যখন আওরঙ্গজেবের পুত্র মোহাম্মদ কাম বক্স মারাঠাদের সাথে নিজে গিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছিলেন তখন জুলফিকার খান তাকে বন্দী করেন। তখনও হিগিনসন গায়ে পড়ে ঝামেলায় জড়াতে চাননি। 

অবশ্য হিগিনসনের এই পক্ষপাতহীনতা বজায় রাখার জোরালো কারণ ছিল। মোগলদের বিরোধিতা করার সামর্থ্য তার ছিল না। মোগল সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে নবাব ফরমান বা জমি অনুদান জারি করতেন। এদিকে ইংরেজরা এগমোর এবং পুরাসাওয়ালকামের নিকটবর্তী গ্রামগুলি তাদের অধীনে রাখার জন্য মোগলদের কাছে অনুরোধ করেছিল।

নবাব জুলফিকার খান

১৬৯৭ সালে জুলফিকার খানকে ঋণ দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর ব্যাপারে হিগিনসনের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে মোগলদের সাথে ইংরেজদের সংঘর্ষ প্রায় বেঁধেই গিয়েছিল। কিন্তু থাঞ্জাভুর থেকে এগিয়ে আসা মারাঠা বাহিনীর সংবাদ এবং জিঞ্জির অবরোধ পুনরায় শুরু করার জন্য আওরঙ্গজেবের স্পষ্ট নির্দেশ আর এই সংঘর্ষকে সামনে এগোতে দেয়নি। ১৬৯৮ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকেই জিঞ্জি দুর্গর পতন হয়। ছয় মাস পরে হিগিনসন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগ করেন।

কোম্পানির লোক

ফোর্ট সেন্ট জর্জে হিগিনসনের আমল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য অনেক সাফল্য বয়ে এনেছিল। প্রেসিডেন্ট হিসেবে কৌশলগতভাবে এবং আর্থিকভাবে কোম্পানিকে সুরক্ষিত করার কাজ ছিল তার। জলদস্যুরা সমুদ্রে এর কোম্পানির জাহাজগুলোকে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলো এবং দুর্গে থাকা আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীদের সাথে এই জলদস্যুদের লেনদেনের সম্পর্ক ছিল। হিগিনসন প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেই আর্মেনিয়ানদেরকে ইংরেজদের পক্ষে আসতে চাপ দেন এবং প্রথম সমস্যার সমাধান করেন। 

অর্থসংস্থান ঠিক রাখার জন্য তিনি দুর্গের মধ্যে ঢোকানো ও বাইরে বের করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন। একইসাথে ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে হিন্দুদের, একজন প্রধান বণিকের মাধ্যমে পুরো বাণিজ্য পরিচালনার পরিবর্তে একটি যৌথ-স্টক কোম্পানি গঠন করতে রাজি করান।

ফোর্ট সেন্ট জর্জে তার সময়কালে হিগিনসন বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্বার্থ এবং অনুভূতির ভারসাম্য বজায় রাখতে কাজ করেছিলেন। ট্রিপলিকেনের (বর্তমান থিরুভালিকেনি) একটি মসজিদ নিয়ে দুই ইমামের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তিনি মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন। আবার, সানথোমের বিশপ যখন কুড্ডালোরের জন্য একজন যাজক নির্বাচন করেন, তখন তিনি কোম্পানির জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যক্তির নিয়োগ নিশ্চিত করেছিলেন। অন্যদিকে, যখন দুই মন্দিরের 'প্যাগোডা' রাজস্ব তত্ত্বাবধানের জন্য দুই কমিটির মধ্যে বিবাদ শুরু হয়, তখন হিগিনসন সে দায়িত্ব আসল বণিকদের কাছে ফিরিয়ে দেন।

১৬৯৭ সালে মালাবার উপকূলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ঘাঁটি অ্যাঞ্জেঙ্গো ইংরেজ বণিকদের জন্য সুরক্ষিত করার জন্য তাদেরকে সাহায্য করেন। অ্যাঞ্জেঙ্গোর রানী উমায়াম্মা ১৬৯৩ সালে ইংরেজদের বাণিজ্য সুবিধা প্রত্যাহার করে নেন। ইংরেজরা অবরোধ এড়িয়ে দুর্গের নির্মাণ পুনরায় শুরু করে, যা ঐ অঞ্চল থেকে মরিচ ও তুলার বাণিজ্য বাড়াতে সাহায্য করে।

অভিযোগের খাড়া

এসব সাফল্য সত্ত্বেও ফোর্ট সেন্ট জর্জে হিগিনসনের ওপর এলিহু ইয়েলের ভূত চেপে বসেছিল। একজন ব্যবসায়ী ক্যাথরিন নিক্সের সাথে ষড়যন্ত্র করে ইয়েলের বিরুদ্ধে কোম্পানির পণ্য চুরি করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়াই তিনি প্রাচীর ও দুর্গের প্রাচীর নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার ভাই টমাস চীনের সাথে বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার ফলে সেখান থেকেও তার আয় অনেকের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়।

কাউন্সিলের তিন ইংরেজ সদস্যের রহস্যজনক মৃত্যুর পর ইয়েলের দিকে আঙুল তোলা হয়, যারা ইয়েলের বিরুদ্ধে জোর করে জেলে ঢোকানোর অভিযোগ এনেছিল। হিগিনসন লন্ডনে চিঠি লিখে এই অভিযোগগুলোর যুক্তি ভেঙে দেন। তবে এই অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ শেষ হয় যখন ১৬৯৯ সালে হীরার ব্যবসা করে বড়লোক হওয়া সালে ইয়েল ভারত ছেড়ে চলে যান।

এলিহু ইয়েল

হিগিনসনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন টমাস পিট নামের একজন প্রাক্তন জলদস্যু, যার সম্পদের পাহাড় তাকে সংসদের আসন পেতে সাহায্য করেছিল। পিটের নাতি এবং প্রপৌত্র ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হন: উইলিয়াম পিট দ্য এল্ডার এবং উইলিয়াম পিট দ্য ইয়াংগার।

বিচ্ছেদের বেদনা

হিগিনসন ১৭০০ সালের গোড়ার দিকে তার পরিবারের সাথে ভারত ত্যাগ করেন এবং পরবর্তী ১০ বছর লন্ডনে কাটান। আমেরিকায় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন তিনি, বিশেষ করে অজনপ্রিয় দায়িত্বপ্রাপ্ত জোসেফ ডুডলির বদলে ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর হিসেবে তাকে আমন্ত্রণ জানানোর পর।

দীর্ঘদিন দূরে থাকায় তার বাবা ও ভাই তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পোড়েছিলেন। পরিবারের সাথে চালাচালি করা চিঠিগুলোতে আমেরিকায় ফ্রান্সের সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধের বর্ণনা এবং হিগিনসন পরিবারের অনিশ্চিত জীবনের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। 

হিগিনসনের ভাই ইস্ট ইন্ডিজের সাথে বাণিজ্য স্থাপন করতে আগ্রহী ছিলেন। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন: "প্রিয় ভাই, স্থানের দূরত্ব যেন আমাদের একে অপরকে ভুলে যাওয়ার কারণ না হয়। ভাল দিনগুলো মনে করো; এবং আমাকে এখানে তোমার কোম্পানিতে নিয়োগ দিয়ে আবার সুখী হতে দেও।"

তার বাবা আশা পুনর্ব্যক্ত করেন যে হিগিনসন তার পরিবারের জন্য তার তার অংশ করবেন। একটি দীর্ঘ চিঠিতে পরিচিত যারা মারা গিয়েছেন তাদের খবর দিয়ে লিখেছেন: "আমাদের জীবনের অর্থ কী? এটি বাষ্পের মতো যা কিছুক্ষণের জন্য দেখা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।"

তবে হিগিনসন কখনোই আমেরিকায় ফিরতে পারেননি। ১৭০৮ সালের অক্টোবরে লন্ডনে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা যান হিগিনসন। দুই মাস পরে তার বাবাও মারা যান।
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.