রবীন্দ্রনাথের ৫টি ছবিকে ‘অধঃপতিত’ ঘোষণা করেন হিটলার, সরিয়ে ফেলা হয় জাদুঘর থেকে

ফিচার

সৌতিক বিশ্বাস, বিবিসি
21 November, 2022, 10:55 pm
Last modified: 21 November, 2022, 11:09 pm
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জার্মানি ভ্রমণ করেছিলেন তিনবার। একবার ১৯২১ সালে, এরপর ১৯২৬ সালে এবং সর্বশেষ ১৯৩০ সালে। তার দুই ডজন বই ততদিনে জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়ে গেছে। ‘তিনি যেখানেই বক্তৃতা দিতেন, পুরো হলে তিল ধারণের ঠাঁই হতো না।

সবমিলিয়ে পাঁচটা ছবি ছিল। পাখি আর মানুষের দৃশ্য। একটা ছবিতে আঁকা হয়েছিল লাল জামা পড়া এক মেয়েকে।

রঙিন কালি আর গোয়াশে আঁকা ছবিগুলোর চিত্রকর আর কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আঁকার পর এগুলোর স্থান হয় লন্ডনের একটি প্রথমসারির জাদুঘরে। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছবিগুলো জার্মানিকে উপহার দিয়েছিলেন। 

সাত বছর পরে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের এ ছবিগুলোকেই খারিজ করে দিয়েছিল নাৎসি শাসকগোষ্ঠী। শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে তখন অনেক 'অনুপযুক্ত' চিত্রকর্মকে 'অপজাত' হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল নাৎসিরা।

হিটলার নিজেই ছিলেন একজন ব্যর্থ চিত্রশিল্পী। পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট আধুনিক চিত্রকর্মকে তিনি 'উন্মাদগ্রস্ত মনের প্রমাণ' হিসেবে দেখতেন। নাৎসিপ্রধান জার্মানির জাদুঘরগুলো থেকে ১৬,০০০ চিত্রকর্ম সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। এগুলোর মধ্যে ভ্যান গগ ও ম্যান রে'র একটি করে ছবিও ছিল।

এ ধরনের ছবিকে বিদ্রূপ করার জন্য নাৎসিরা একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছিল।

হিটলারের এ চিত্রকর্মবিরোধী ক্যাম্পেইনে কেন ও কখন রবিঠাকুরের ছবিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়, এ সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কোনো রেকর্ড নেই। আর্ট হিস্টোরিয়ানেরা মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মডার্নিস্ট হওয়ার কারণেই এগুলোর ওপর হামলে পড়া সহজ হয়ে গিয়েছিল নাৎসিদের জন্য। হিটলার একবার বলেছিলেন, 'যারা আকাশকে সবুজ আর জমিকে নীল হিসেবে দেখে ও আঁকে, এদের সবাইকে খোজা করে দেওয়া উচিত'।

রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি চিত্রকর্মকে ‘অপজাত’ তালিকাভুক্ত করে নাৎসি সরকার। ছবি: বিবিসি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জার্মানি ভ্রমণ করেছিলেন তিনবার। একবার ১৯২১ সালে, এরপর ১৯২৬ সালে এবং সর্বশেষ ১৯৩০ সালে। তার দুই ডজন বই ততদিনে জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়ে গেছে। 'তিনি যেখানেই বক্তৃতা দিতেন, পুরো হলে তিল ধারণের ঠাঁই হতো না। আগ্রহীরা ঢুকতে না পেরে ধস্তাধস্তি করার কথা নিয়মিত সংবাদপত্রে প্রকাশ পেত,' বলেন জার্মান ভাষায় রবীন্দ্র সাহিত্যের অনুবাদক মার্টিন ক্যাম্পচেন।

রবীন্দ্রনাথকে তৎকালীন জার্মান গণমাধ্যমে 'পূর্ব থেকে আগত প্রজ্ঞাবান', 'প্রফেট, বোধাতীত, ও ত্রাতা' ইত্যাদি সম্বোধনে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল।

১৯৩০ সালে ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৩০০টি ছবির একটি একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এগুলোর মধ্যে ১০০টির বেশি প্যারিসে ও প্রায় অর্ধসংখ্যক ছবি বার্লিনের ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট-এ প্রদর্শতি হয়। এরপরে লন্ডনে প্রদর্শনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ছবিগুলো।

১৯৩৭ সালের আগ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো বার্লিনের বারোক প্রিন্স প্যালেসে রাখা হয়েছিল। এখানে আরও ছিল ন্যাশনাল গ্যালারি। হিটলারের শুদ্ধিকরণ অভিযান চালু হওয়ার পর ১৯৩৭ সালের ১৫ অক্টোবরের এক নির্বাসন তালিকায় তার পাঁচটি ছবির নাম দেখা যায় বলে জানান আর্ট হিস্টোরিয়ান কনস্ট্যান্টিন ভেঞ্জলাফ।

ওই ছবিগুলোর কপালে ঠিক কী জুটেছিল তা আজও জানা যায়নি।

১৯৪১-৪২ সালে তৈরি করা তথাকথিত 'অপজাত চিত্রে'র তালিকায় এ ছবিগুলোর নাম পাওয়া যায়। ছবিগুলোর নাম সেখানে দেওয়া হয়েছিল মাস্ক (মুখোশ), পোর্ট্রেইট, গার্ল (লাল জামায়) (বালিকা), মাস্ক ও টু বার্ডস (দুটো পাখি)।

জব্দ করা এ ছবিগুলো পরে শিল্পীর নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী তালিকা করা হয়। এরপর অনেকগুলো ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয় এগুলোকে। এসব ক্যাটাগরিগুলো টি (অদলবদল বোঝানোর জন্য), ভি (বিক্রয় করা) ও এক্স (ধ্বংস করা) ইত্যাদি চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

রবিঠাকুরের ছবিগুলোর ক্ষেত্রে দুটো ছবি অদলবদল ও দুটো ধ্বংস করার ক্যাটাগরিতে রাখা হয় ওই তালিকায়। অবশিষ্ট টু বার্ডস শীর্ষক পঞ্চম ছবিটির জন্য কোনো ক্যাটাগরির ট্যাগ লাগানো ছিল না।

নাৎসিদের নিন্দিত একটি ছবি বর্তমানে মিউনিখের একটি জাদুঘরে রয়েছে। ছবি: অলিভার কাসের সৌজন্য/ ভায়া বিবিসি

কনস্ট্যান্টিন ভেঞ্জলাফের লেখা অনুযায়ী, গ্যালারি থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবিগুলো 'অদৃশ্য হয়ে যায়' এবং 'এখন পর্যন্ত এগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি'।

তবে তিনটি ছবি ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ভারতে যোগাযোগ করেছিল রাইখ মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট অ্যান্ড প্রোপাগান্ডা। ১৯৩৯ সালে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারের খোঁজ করে ওই মন্ত্রণালয়। যদিও কবি স্বয়ং তখন জীবিত ছিলেন।

আরেক আর্ট হিস্টোরিয়াস আর. শিব কুমার রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ওই তিনটি ছবি রবীন্দ্রনাথকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল ১৯৩৯ সালেই। বাকি দুটি হারিয়ে গেছে।

তবে মিউনিখের পিনাকোঠেক দ্য মর্ডান মিউজিয়ামের মডার্ন আর্টের প্রধান কিউরেটর অলিভার কেসা জানান, হারিয়ে যাওয়া দুটি ছবির মধ্যে একটি মিউনিখের দ্য বাভারিয়ান স্টেট পেইন্টিং কালেকশনস-এর সংগ্রহে সেই ১৯৬৪ সাল থেকেই আছে বলে মনে করা হয়।

ড. অলিভার ওই ছবিটিকে একটি 'অর্ধ-ছায়াবৃত মাথা' হিসেবে উল্লেখ করে এটিকে 'কৃচ্ছ্র ও স্বপ্নালুভাবে পরলৌকিক' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

'আমার বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের ওই একটি ছবিই জার্মানির কোনো পাবলিক কালেকশনে আছে। দ্বিতীয় ছবিটি ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে এক নিলামের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের একজন ব্যক্তিগত সংগ্রাহক কিনে নিয়েছিলেন,' অলিভার জানান।

'ভারতে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফেরত পাঠানো বাকি তিনটি ছবি এখন হারিয়ে গেছে,' অলিভার আরও বলেন।

তথাকথিত ‘অধঃপতিত’ ছবিগুলোকে ব্যঙ্গ করতে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল নাৎসিরা, সেখানে দেখা যাচ্ছে অ্যাডলফ হিটলার তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হারম্যান গোয়েরিংকে। ছবি: ছবি: গেটি ইমেজেস/ ভায়া বিবিসি

অধ্যাপক শিব কুমারের বিশ্বাস তিনি 'খুব সম্ভবত ফেরত দেওয়া একটা ছবি বিশ্বভারতীর আর্কাইভে দেখেছিলেন'। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্থাপিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভের পরিচালক নীলাঞ্জন বন্দোপাধ্যায় বিবিসিকে বলেন, তিনি এভাবে 'হুট করে চিত্রকর্মটির অস্তিত্ব সম্পর্কে বলতে পারবেন না এবং ওই চিত্রকর্মের কোনো ফোটোগ্রাফ থাকলে বরং তা খুঁজতে সহায়ক হতো।'

বয়স ষাটের কোঠায় পৌঁছানোর মাঝামাঝিতে এসে আঁকাআঁকি শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি ১৯৪১ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ২,৩০০টি ছবি এঁকেছেন।

'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবসময় ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন। নিজের পাণ্ডুলিপিতে আঁকজোক কাটতেন তিনি। ১৯২৮ সালের দিকে নিজের প্রথমদিককার ছবিগুলো এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ,' বলেন অধ্যাপক শিব কুমার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা চিত্রকর্মের মধ্যে আছে কাল্পনিক প্রাণী, জ্যামিতিক নকশা, নারী, নিজের ছবি, ল্যান্ডস্কেপ, মানুষের মতো দেখতে মুখোশ ইত্যাদি। আর্ট হিস্টোরিয়ানরা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রশিল্প আর্ট ন্যুভের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

'রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ভারতে তার চিত্রকর্মে স্বাধীনতার একটি ধারণা তৈরি করতে। ১৯৩০-এর দশকে তখনো যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে মডার্ন আর্ট খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি। রবি'র ছবি যখন জার্মানিতে প্রদর্শন করা হয়, তখন মানুষজন সেগুলোকে সুরিয়ালিস্ট ও এক্সপ্রেশনিস্টদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন,' বলেন অধ্যাপক শিব কুমার।


  • সূত্র: বিবিসি

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.