উপযুক্ত বিকল্প না থাকায় টুইটার ছাড়া অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে?
ইলন মাস্ক টুইটার কিনেছেন তিন সপ্তাহ হতে চলল। এই অল্প সময়ের মাঝেই কর্মী ছাঁটাই, ছুটির দিন কমানো, ব্লু টিক কাণ্ডসহ প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার অনেক কিছুতে পরিবর্তন এনেছেন মাস্ক, এবং এখনও করে চলেছেন। যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির এখন বিশৃঙ্খল অবস্থা। আবার সম্প্রতি টুইটারের বিকল্প হিসেবে কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে কি টুইটারের দিন শেষ হতে চলল? বিকল্প হিসেবেই বা কোন মাধ্যম আসতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এল পাইস-এর এক প্রতিবেদনে।
টুইটারের মালিকানা নেওয়ার পর থেকে শুরু করে ইলন মাস্কের এসব ঝটিকা সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবহারকারীদের মাঝে তিন ধরনের মতামত দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, একদল আছেন যারা যা-ই ঘটুক না কেন, টুইটার ছাড়তে নারাজ। দ্বিতীয়ত, অনেকে আপাতত ব্যবহার চালিয়ে নিতে চাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা দেখার অপেক্ষায় আছেন। এবং তৃতীয়ত, আরেকদল আছেন যারা যত দ্রুত সম্ভব টুইটার ব্যবহার ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন।
মাস্কের দাবি, প্রথম দুটি দল তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় অনেক বড় এবং গত দুই সপ্তাহে টুইটারে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। প্ল্যাটফর্মটির দৈনিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ২৫ কোটিরও বেশি।
এই মাইক্রোব্লগিং সাইটটির সাবস্ক্রিপশন ও পেওয়াল পরিকল্পনা সফল হলে ব্যবহারকারীদের দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে—যারা টাকা দেবে এবং যারা দেবে না। সফলতার মুখ দেখলে মাস্কের এই নিয়ম অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মনোযোগ টানবে।
তবে বর্তমানে অনেক বেশ ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিকে। গত বৃহস্পতিবার টুইটারের এক মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত দেখে বোঝা যায়, এখনও পর্যন্ত লাভজনক অবস্থায় থাকলেও দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছে না কোম্পানিটি।
সেদিনই গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কয়েকজন নির্বাহী পদত্যাগ করেছিলেন। আশঙ্কার কথা হলো, অনিয়ন্ত্রিত ছাঁটাইয়ের ফলে ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) থেকে আইনি ঝামেলা আসতে পারে। 'ইলন মহাশূন্যে রকেট পাঠাতে পারে, কিন্তু এফটিসিতে তার কোনো ক্ষমতা নেই'—এমন কথা ছড়িয়েছে কোম্পানিটির এক অভ্যন্তরীণ চ্যানেলে। চরম বিশৃঙ্খলায় পড়ে টুইটারের যাত্রা যে শেষ হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
টুইটারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আরেকটি কারণ হলো ইলনের ব্লু টিক বিক্রির সিদ্ধান্ত। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তার নেওয়া অন্যতম একটি সিদ্ধান্ত ছিল ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টের জন্য মাসিক আট ডলার ফি নেওয়া। বহু কোম্পানি, রাজনীতিবিদ ও সেলিব্রিটিরা এ পরিষেবাটি নিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যার শুরু হলো তখন, যখন একে একে লকহিড মার্টিন করপোরেশন, রবলক্স, বিপি ইত্যাদি বড় বড় কোম্পানির নামে ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো ব্লু টিকের সেবা নিল। যিশু খ্রিষ্ট থেকে শুরু করে শয়তান, এমনকি মাস্কের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান টেসলার নামেও ভুয়া অ্যাকাউন্ট চালু হয়েছিল।
টুইটারের সবকিছু এতই অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে যে, এখন একমাত্র নিশ্চয়তা হলো 'অস্থায়িত্ব'। আসন্ন মাসগুলোতে টুইটার ব্যবহারকারীরা অনেক 'ছাইপাঁশ' শুনতে পাবেন ও নিত্যনতুন 'খবর' আসবে যাবে বলেও ঘোষণা দেন মাস্ক।
ইতিমধ্যে টুইটারের বিকল্প হিসেবে অন্য কিছু প্ল্যাটফর্মের নামডাক শোনা যাচ্ছে। তবে সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য টুইটার ছেড়ে যাওয়া অতটাও সহজ নয়। প্রথমত, 'নেটওয়ার্ক প্রভাবের' জন্যই মূলত টুইটার এত জনপ্রিয়; কাউকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত বা ফলোয়ার কিংবা অনুসারী বাড়ানোর জন্য বছরের মতো সময় লেগে যেতে পারে এবং এতে বেশ রুটিনমাফিক কাজেরও প্রয়োজন হয়। এমন ব্যবহারকারীদের জন্য টুইটার তথ্য, বিনোদন কিংবা আলাপ আলোচনা ও বিতর্কের অন্যতম উৎস। ফলে আচানক টুইটার ছেড়ে দেওয়া তাদের জন্য সহজ কাজ নয়।
দ্বিতীয়ত, এটা ঠিক যে নতুন বা তরুণ ব্যবহারকারীরা হয়তো অন্যান্য টেক্সট-কেন্দ্রিক সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোকে বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করবেন। কিন্তু একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে—টুইটারের যে ফিচার, অর্থাৎ টুইটার ব্যবহার করে গ্রাহকরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, অন্য প্ল্যাটফর্মে হুবহু তা পাবেন না।
একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে হয়তো টুইটারের অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে, কিন্তু প্ল্যাটফর্মটির একটিমাত্র বিকল্প খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
দ্য কুল নেটওয়ার্ক: মাস্টোডন
টুইটারের বিকল্প হিসেবে সবার আগে উঠে আসছে মাস্টোডনের নাম। ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু হলেও মাস্টোডনের নাম অপরিচিতই ছিল এতদিন। কিন্তু মাস্কের দায়িত্ব গ্রহণের পর গত সপ্তাহ থেকে তরতর করে বড় হতে চলেছে এই প্ল্যাটফর্মটি।
স্পষ্ট বিকল্প না হতে পারে, তবে মাস্টোডনের ইউজার ইন্টারফেস অনেকটাই টুইটারের মতো; একটি বার্তা লিখবেন যেটিকে বলা হচ্ছে টুট (টুইটের বিপরীতে), যা হতে হবে পাঁচশ বা এর চেয়ে কম শব্দের। বার্তাটি হবে পাবলিক, এতে লাইক দেওয়ার পাশাপাশি টুইটারের মতোই রিটুইট করা যাবে।
সম্প্রতি এই প্ল্যাটফর্মটিতে সাইন আপ করার জন্য এত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন যে অল্প কয়দিনেই এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
মাস্কের 'গণ ছাঁটাইয়ের' আগে টুইটারের কর্মীসংখ্যা ছিল সাত হাজার, আর অন্যদিকে মাস্টোডনের আছে কেবল একজন পূর্ণকালীন কর্মী। এর প্রতিষ্ঠাতা ইউজেন রোচকো, বাস করছেন জার্মানিতে। মাস্টোডনে রোচকোর অনুসারীর সংখ্যা এক লাখ ৯০ হাজার, আর টুইটারে মাস্কের আছে ১১ কোটি ৩০ লাখ জন অনুসারী।
ধরুন, আমরা সবাই সদালাপী ব্যক্তি, যারা একটি পাবলিক স্ফিয়ারে চ্যাটিং বা আলাপ করতে অভ্যস্ত। তাহলে মাস্টোডন আমাদের জন্য হতো একটি 'কুল নেটওয়ার্ক'। ভবিষ্যতে এটি হতে পারে সামাজিক নেটওয়ার্কের একটি বিকল্প।
প্ল্যাটফর্মটি টুইটার, ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকের মতো একটিমাত্র কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত হয় না। এটি পরিচালনা করে বিভিন্ন গ্রুপ বা ব্যক্তি। তাছাড়া এতে কোনো অ্যালগরিদম বা বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা নেই।
টুইটারকে 'মাংশাসী' বলে অনেক সময় মাস্টোডনকে 'নিরামিষ' বলে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ মাস্টোডন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি 'ন্যায়পরায়ণ', 'স্বাস্থ্যকর' ও 'পৃথিবীর প্রতি অতটা আগ্রাসী নয়!'
মাস্টোডনে আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশের অনুমোদন দেন না রোচকো। কিছুদিন আগে উসকানি দিতে এক ব্যবহারকারী রোচকোকে বলেন, 'নাৎসিদের অস্তিত্ব আর নেই।' এতে কাজ হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন রোচকো।
মাস্টোডন পরিচালিত হয় বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে। তাই এখানে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে কোনো সার্ভার বা কমিউনিটি বাছাই করতে হয়। যদিও বাছাইকৃত কমিউনিটি স্থায়ী নয়, এটি পরবর্তীতে পরিবর্তন করা যায়। এরপর সেটিংয়ের কাজ আর বাকি দশটা মাধ্যমের মতোই। এই ধাপ শেষ হলে দেখা যাবে এর সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে টুইটারের ২০০৭ সালের সংস্করণের। এখানে ব্যবহারকারী এখনো অনেক কম, সাইটিটিতে বাগও রয়েছে। কিন্তু তাই বলে যে ব্যবহারকারী যে বাড়বে না, এমনটা নয়।
তবে কি টুইটারের বিকল্প হতে পারবে মাস্টোডন? দুপক্ষেই যথেষ্ট যুক্তি আছে। যেসব টুইটার ব্যবহারকারীর মাস্টোডনে অ্যাকাউন্ট আছে তারা এর গুণগান করেই যাচ্ছেন। টুইটোডন এবং ডিবার্ডিফাই সেবার মাধ্যমে টুইটারে নিজের অনুসারীদের মধ্যে কে মাস্টোডন ব্যবহার করছে সেটিও জানা যাচ্ছে। আবার দুটো সাইটেই টুইট কিংবা টুট করা যাচ্ছে।
তবে এখন টুইটার ছেড়ে দেওয়া মানে প্রভাব এবং প্রাসঙ্গিকতা হারানো। টুইটারের সাইবারসিকিউরিটি কমিউনিটি তিলে তিলে যে নেটওয়ার্ক গড়েছে তার অবশ্যই বড়সড় প্রভাব রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলা দেখে মনে হচ্ছে দুর্বলভাবে হলেও টুইটারের একটি বিকল্প আসা অযৌক্তিক কিছু নয়।