পাম চাষ: প্রচার-প্রচারণাই সার, বাকি সবটাই ব্যর্থতার কাহিনী

ফিচার

16 November, 2022, 10:30 pm
Last modified: 17 November, 2022, 10:28 am
এক দশকের বেশি সময় আগে কিছু সংগঠন দেশজুড়ে পাম চাষের পক্ষে প্রচারণা চালায়। পামকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ফল হিসেবে তুলে ধরে তারা। তাদের প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়ে দেশের অনেক জায়গায় বন উজাড় করে গড়ে তোলা হয় পাম বাগান। তারপর কী হলো? সত্যিই কি ব্যাপক লাভের মুখ দেখাতে পেরেছে পাম তেলের গাছ?

২০০৪ সালে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় কয়েকটি পাহাড় কেনেন আবুল হোসেন ও তার বন্ধুরা। পাহাড়গুলোতে তখন ঘন দেশীয় বন ছিল। আর ছিল বিপুলসংখ্যক বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণীর বসবাস। তবে এমন সমৃদ্ধ বনও যে তেমন একটা টাকা আনতে পারবে না—এ কথা আবুল হোসেন জানতেন। তিনি জানতেন, একদিন এই পাহাড়গুলোকে তার কাজে লাগাতে হবে। 

২০০৭-০৮ সালে আবুল হোসেন পাহাড়গুলোর বন উজাড় করে সেই খালি জায়গায় কয়েক হাজার তেল পাম গাছের চারা লাগান। ওই সময় কয়েকটি সংগঠন দেশজুড়ে পাম চাষের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছিল। পাম চাষকে তারা ব্যাপক সম্ভাবনাময় কাজ হিসেবে তুলে ধরেছিল। ওই প্রচারণা দেখেই আবুল হোসেন পাম চাষের এ সিদ্ধান্ত নেন।

প্রায় ১৪ বছর এগিয়ে এবার ২০২২ সালে আসা যাক। এ বছর দেখা গেল আবুল হোসেন তার পাম বাগান উজাড় করে সেখানে সেগুনের মতো কাষ্ঠল গাছ লাগাচ্ছেন।

আবুল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পাঁচ বছর পর প্রথম যে ফলন এসেছিল, সেটি ভালোই ছিল। কিন্তু পাম বেচার মতো কোনো ক্রেতা আমরা পাইনি।' তার ৩৫ একরের বাগানটিতে ২০ হাজার গাছ ছিল। প্রতি তিন মাস পরপর ফল সংগ্রহ করা যেত।

যেসব সংগঠন পাম চাষের প্রচারণা চালিয়েছিল, সেগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। আবুলের এখন সংগঠনগুলোর নামও ঠিকমতো মনে নেই।

'এখানে [পাম চাষে] আমরা দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু কোনো লাভই করতে পারিনি,' আবুল হোসেন জানালেন। প্রতিটি চারা কিনতে খরচ পড়েছিল ১১০ টাকা। এছাড়া বন কাটা ও পাম বাগান রক্ষণাবেক্ষণেও প্রচুর বিনিয়োগ লেগেছিল। 

আবুল হোসেন জানান, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে ৬-৭ লাখ পাম গাছ ছিল। চরম হতাশ চাষিরা এখন সমস্ত গাছ কেটে সেসবের জায়গায় ফল ও কাঠের গাছ লাগাচ্ছেন।

আবুল হোসেন নিজে তার অর্ধেক পাম গাছ কেটে ফেলেছেন। তার আর্থিক অবস্থা এখন এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে, একসঙ্গে সবগুলো গাছ কাটার ব্যয় বহন করার সামর্থ্যও তার নেই। মাস কয়েক আগে পাঁচ একর জমির পাম গাছ কেটে সেখানে সেগুন গাছ লাগিয়েছেন বলে জানালেন আবুল হোসেন।

চাষিরা এখন তাদের পাম বাগানের ভালো যত্ন নিতে পারছেন না।

কিন্তু তিনি কি একটা পামও বিক্রি করতে পারেননি? তার কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম আমরা।

আবুল হোসেন জানালেন, কয়েকদিন আগে এক লোক তার কাছ থেকে ১০ টাকা কেজিতে পাম ফল কিনে নিয়ে গেছেন।

'ফল সংগ্রহ করে সেগুলো কালেকশন পয়েন্টে পাঠানোর পর কেজিতে আমাদের মাত্র ২-৩ টাকা লাভ ছিল। যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছিলাম, তার তুলনায় এটা কিছুই না,' আবুল হোসেন বললেন।

আবুল হোসেনের কাছ থেকে পাম কিনেছিলেন আরব আলী। তিনি টিবিসকে জানালেন, চট্টগ্রামের একটি ছোট্ট কারখানা অনানুষ্ঠানিকভাবে পামের রস আহরণ করে তা বিভিন্ন সাবান কারখানায় সরবরাহ করে। এখন পামের রসের চাহিদা কম বলে জানালেন তিনি।

সারা দেশের পাম চাষিদেরই এমন দুর্দশা। পঞ্চগড়ের চা চাষি রোকন উজ্জামান জানান, এই সংগঠনগুলো তাদের কাছেও গিয়েছিল। তাদের কাছে থাকা পাম চারা কিনে সেগুলো লাগাতে উৎসাহিত করেছিল তারা। সংগঠনগুলোর কথা শুনে কিছু চাষি পাম গাছের চারা কেনেন। চারা বিক্রি করেই সংগঠনগুলো উধাও হয়ে যায়। এরপর বিপদে পড়েন পাম চাষিরা। শেষে তারা হতাশ হয়ে পাম বাগান কেটে সেখানে অন্যান্য গাছ লাগান। তবে বেশিরভাগ কৃষক চা বাগান করেন।

তবে সরবরাহ চেইনকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় একটি পাম বাগান।

মেহেরপুরের বোটানিকা এগ্রো লিমিটেড নামের একটি খামার ২০১৩ সালে জেলার বিসিক শিল্প অঞ্চলে একটি কারখানা স্থাপন করেছিল। তারা বিনিয়োগকারী অংশীদারও সংগ্রহ করে। কৃষকদের পাম গাছের যত্ন নিতে অনুপ্রাণিত করে এবং পাম তেলকে 'তরল সোনা' আখ্যা দিয়ে ভালো লাভের নিশ্চয়তা দেয়

কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি খুব একটা সাফল্য পায়নি।

বোটানিকা এগ্রোর সাবেক প্রশাসনিক পরিচালক কাজী মেহেদী হাসান বলেন, 'আমরা যখন কাজ শুরু করি, ততদিনে চাষিরা পামের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। তারা গাছের যত্ন নিত না, তাই ফলনও ভালো হতো না।'

স্থানীয় দুজন প্রকৌশলী আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত উপাদানের সমন্বয়ে তেল নিষ্কাশন মিলটি নির্মাণ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাষিরাও এই পদ্ধতিতে কাজ করার করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।

মেহেদী বলেন, 'তেল উৎপাদনের বদলে মানুষ চারা বিক্রিতেই বেশি আগ্রহী ছিল। একেকটি চারা দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হতো।'

খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর এলাকায়ও প্রচুর পাম বাগান করা হয়। একেকটা বাগানের আয়তন ছিল ১৫ বিঘা। মেহেদী আক্ষেপ করে বলেন, 'আমাদের প্রতিদিন ১-৫.৫ টন পাম প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা ছিল। কিন্তু আমরা দিনে ১০০ কেজি পাম ফলও সংগ্রহ করতে পারিনি।'

এর ফলে কদিন পরই কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়।

মেহেদী জানান, বোটানিকা এগ্রোই দেশের প্রথম পাম অয়েল কারখানা।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তাদের ১০৪টি কৃষিপণ্যের তালিকায় পামের নাম নেই। তাদের পরামর্শ ছাড়াই দেশে পাম চাষ করা হয়েছিল।

তবে কাজটি শুধু ব্যক্তিগত উদ্যোগেই করা হয়নি। বাংলাদেশ বন বিভাগও পাম বাগান করেছে।

বাংলাদেশ বন বিভাগের সহকারী প্রধান বন সংরক্ষক, সামাজিক বনায়ন ও সম্প্রসারণ, মোল্লা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বন বিভাগ ১৯৭০-৮০ সালের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কিছু পামের আবাদ করেছিল। সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। প্রথম কারণ, বড় আকারে চাষের জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত জমি নেই। দ্বিতীয় কারণ, উৎপাদিত পামে মানসম্পন্ন মাত্রার প্রোটিন ছিল না এবং উৎপাদন সন্তোষজনক ছিল না।'

পাম চাষিরা বন উজাড় করে ফেলার আগে এই জায়গা বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থল ছিল।

পাম চাষের উদ্যোগকে অবশেষে ব্যর্থ ঘোষণা করা হয়। বন বিভাগ এরপর আর কখনও পাম চাষ করেনি। তবে রোপণ করা গাছগুলোও কাটা হয়নি। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানসহ অন্যান্য স্থানে কয়েক দশক ধরে অনেকগুলো পাম বাগান পরিত্যক্ত পড়ে আছে। অথচ এসব জায়গা বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থল হতে পারত।

পামের বিদ্যমান ব্যক্তিগত বাগানগুলোর বেশিরভাগই পাহাড়ি জমিতে অবস্থিত। এসব বাগান তৈরি করা হয়েছিল বন উজাড় করে তৈরি। বন কর্মকর্তারা বলেন, এভাবে দেদারসে বন উজাড় করে, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো লাভ নেই।

মিজানুর রহমান বলেন, 'আমি যতদূর বুঝি, এসব আবাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, উৎপাদনের কোনো সম্ভাবনা নেই।'

সম্প্রতি এমআরটি এগ্রো প্রোডাক্টস বিডি লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি তাদের ময়মনসিংহের কারখানায় নিজেদের রাইস ব্র্যান তেলের মিল দিয়ে পরিশোধিত পাম তেল উৎপাদন শুরু করেছে। খাগড়াছড়ির আরব আলী নামের ওই ব্যক্তিও এই কোম্পানির সরবরাহ চেইনে কাজ করেন।

এমআরটি এগ্রোর পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমরা প্রতি মাসে ১০০ থেকে ২০০ টন পাম সংগ্রহ করতে পারি। উৎপাদিত তেলের ওজন এর ২০ শতাংশ। কোনো কোনো মাসে আমরা একেবারেই পাম সংগ্রহ করতে পারি না।' 

কোম্পানিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ১-২টি বাগান থেকে পাম সংগ্রহ করে। গত আট-নয় তাদের পাম সংগ্রহ চলমান রয়েছে।

খাগড়াছড়ির চাষি আবুল হোসেনকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, লাভ নিশ্চিত করার জন্য তিনি সরাসরি এমআরটি এগ্রোকে পাম সরবরাহ করতে পারেন কি না। আবুল হোসেন বলেন, ময়মনসিংহে পাঠানোর মতো পাম সংগ্রহ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ছোট লট সরবরাহ করা লাভজনক নয়। স্থানীয়ভাবে কারখানার সংখ্যা বাড়াতে পারলে সেটি একটি সমাধান হবে।

হতাশ উদ্যোক্তা আবুল হোসেন বলেন, 'এখন একটাই আশা বাকি—কোনোভাবে আমার সব পাম গাছ কাটার সামর্থ্য অর্জন করা।'
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.