ঢাকার হারানো বইয়ের দোকানের খোঁজে

ফিচার

04 November, 2022, 11:50 am
Last modified: 04 November, 2022, 11:57 am
নিউমার্কেটের ১ নম্বর গেট থেকে ভেতরে ঢুকে হাতের বাঁয়ে প্রথমেই যে গলি রয়েছে, সেটি পরিচিত লাইব্রেরি গলি হিসেবে। একটা সময় এখানে ৪০টির মতো বইয়ের দোকান ছিল। কিন্তু, টেলিভিশন আসার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ৬০-৮০র দশক পর্যন্ত বইয়ের প্রতি মানুষের টান যেমনটা ছিল এখন আর তা নেই। নীলক্ষেতে মূল বইয়ের পাশাপাশি পুরোনো বই ও ফটোকপি করা বই বিক্রি শুরু হলে, নিউমার্কেটে হ্রাস পেতে থাকে দেশের বাইরে থেকে বই আমদানির পরিমাণ।

আমাদের কাছে বইয়ের ভাণ্ডার মানেই ঢাকার নীলক্ষেত। কিন্তু তার আগে ঢাকার মানুষরা বইয়ের খোঁজ পেত কোথায়? সে নিয়েই আজকের লেখাটি।

সময়টা ৬০ এর দশক। ঢাকা শহর তখন এত বিস্তীর্ণ আর মানুষে ভরপুর ছিল না। মানুষ কম ছিল ঠিকই, কিন্তু যোগাযোগ ও যাতায়াত ভালো ছিল তাদের মধ্যে। ফলে সবাই সবাইকে চিনতো, জানতো। তখন কেবল স্টেডিয়াম হলো জিন্নাহ এভিনিউয়ের পাশে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ)। স্টেডিয়ামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মোহাম্মদ শাহাজাহান নামটি। শাহজাহান ছিলেন ক্যালকাটা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেন। ভিক্টোরিয়া পার্কের বিখ্যাত বইয়ের দোকান প্রভেনশিয়াল বুক ডিপো ছিল তাদের পারিবারিক ব্যবসা। মূলত পাঠ্যবইয়ের দোকান ছিল এটি। যা পরে চলে এলো স্টেডিয়ামের দোতলায়।   

ম্যারিয়েটা প্রকোপে আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা...

শাহজাহান সাহেব তখন স্টেডিয়ামের সাথে আরও কিছু বইয়ের দোকানের জায়গা বরাদ্দ করলেন। গড়ে উঠলো 'আইডিয়াজ'। যার নাম পরবর্তীতে রাখা হয় 'ম্যারিয়েটা'। ৬০ এর দশকে বইয়ের একটি বড় জায়গা ছিল স্টেডিয়ামের দোতলায় ছোট্ট এই দোকানটি।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, এই স্টেডিয়ামের সাথে লাগোয়া দোকানগুলোতেই একসময় পাওয়া যেত বিদেশি বই

দোকানটি ছোট্ট ছিল, কিন্তু কাঙ্খিত বহু বই পাওয়া যেত সেখানে। এমনকি বাইরের দেশ থেকে ইংরেজি বইও নিয়ে আসা হতো এ দোকানে। সেই ৬০-৭০ দশকের যেসব বইপ্রেমী ছিলেন, তাদের প্রিয় নাম 'ম্যারিয়েটা'। নামটি উচ্চারণ করতে গিয়ে চোখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো লেখক ও প্রকাশক ড. মফিদুল হকের।  

মূলত এই নামটি ছিল একজন ইংরেজ যুবতীর। পুরো নাম ম্যারিয়েটা প্রকোপে। মাত্র ৩০ বছর বেঁচেছিলেন যিনি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার যুদ্ধে অবদান রাখা ১২৪ জন বিদেশি নাগরিকের মধ্যে ম্যারিয়েটা ছিলেন অন্যতম।        

ম্যারিয়েটা ছিলেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশন এইডের সেক্রেটারি। পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালালে অন্যদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ম্যারিয়েটাও প্রতিবাদে লন্ডনের রাস্তায় নেমে আসেন। নর্থ ওয়েস্ট লন্ডনের ৩৪ স্ট্র্যাটফোর্ড ভিলায় অবস্থিত তার ফ্ল্যাটটিও 'অ্যাকশন বাংলাদেশ'-এর অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন তিনি।

লন্ডনের ট্রাফাল্গার স্কয়ারের সেই র‍্যালি

১৯৭১ সালে আগস্টের ১লা তারিখ লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে অ্যাকশন এইড, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে একটি প্রতিবাদ যাত্রার (র‍্যালি) আয়োজন করে। সেই র‍্যালিতে যোগ দিয়েছিল ২৫০০০ জন এবং ২০০ জন সংসদ সদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষ অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেন। 'জয় বাংলা' 'লং লিভ, লং লিভ, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব এই স্লোগান গেয়ে রাজপথে র‍্যালি করেছিলেন সেদিন তারা। আর তাদের নেতৃত্বে যে দুজন নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন এই ম্যারিয়েটা।

ম্যারিয়েটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে খুব আন্তরিকভাবে জড়িত ছিলেন। তার বাড়িটাকে ঘিরেই অনেকরকম কাজ হতো। তার বাড়িতে যাতায়াত ছিল অনেক তরুণদের, যারা এই যুদ্ধে জড়িত ছিলেন। লন্ডনে থেকেও বাংলাদেশের জন্য পুরোটা সময় কাজ করে গেছেন ম্যারিয়েটা। ম্যারিয়েটা বাংলাদেশের বিজয়ে খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের গোড়ার দিকে ঢাকায় বেড়াতেও এসেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে কিছুদিন পর ম্যারিয়েটা আত্মহত্যা করেন।

লন্ডনে ম্যারিয়েটা প্রকোপের সমাধি

অনেকের মতে, বাংলাদেশকে তিনি যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, সেভাবে দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু ম্যারিয়েটাকে যারা চিনতেন- জানতেন, তাদের কাছে তার (ম্যারিয়েটা) মৃত্যু হয়তো মানবতার নিষ্ঠুরতার প্রতিই এক প্রতিবাদ। ম্যারিয়েটা রবীন্দ্র সংগীত খুব পছন্দ করতেন। তাই তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের দিন রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া হয়েছিল। তাকে নিয়ে তেমন লেখালেখিও হয়নি আমাদের এখানে। তবে যারা তাকে চিনতেন, তাদের কাছে ম্যারিয়েটা এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম।

সেই খালেদ ভাই...    

তেমনি একজন ছিলেন এই আইডিয়াজ –ম্যারিয়েটা দোকানের কর্ণধার খালেদ। ড. মফিদুল হোক বলেন, 'তার মৃত্যু আঘাত দিয়েছিল খালেদ সাহেবকে। দোকানের নাম তার নামে রাখার পাশাপাশি, রক্তদান কর্মসূচির মতো বিভিন্ন ক্যাম্পেইন এবং পোস্টারের মাধ্যমে 'ম্যারিয়েটা' নামটি স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করেছিলেন খালেদ ভাই।'    

'খালেদ সাহেব জানতেন কে কোন বই পছন্দ করবে। তাই অনেক সময় নতুন বই আনলে সেলফে রাখতেন না। আবার নতুন বইয়ের প্যাকেট খোলা নিয়ে কাজ করতো অন্য ধরনের উত্তেজনা। প্যাকেট থেকে কী বই বের হবে এবার তা নিয়ে অনেক এক্সাইটমেন্ট কাজ করতো আমাদের মধ্যে!' তিনি যোগ করেন।  

খন্দকার মোহাম্মদের ইলিয়াস, তারও একটি দোকান ছিল সেখানে

খুব দেখেশুনে, বাছাই করা বই আনতেন তিনি। যে কারণে, সবার অনেক আগ্রহ ছিল। ম্যারিয়েটা নিয়ে স্মৃতিচারণে আরেক প্রবীন বলেন, 'লাতিন আমেরিকার অনেক ভালো ভালো লেখকের বই যেমন, মারিও ভার্গাস ইয়োগা, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মতো বিখ্যাত লেখকদের বই নিয়ে আসতেন খালেদ সাহেব। খুব চুরুট খেতেন তিনি। একটার পর একটা চলতো শুধু।'  
   
খুব প্রগতিশীল আর বইপ্রেমী মানুষ ছিলেন ম্যারিয়েটার খালেদ। তার মৃত্যুর পর তার মেয়েরা আজিজ সুপার মার্কেটে শুরু করেছিল হ্যান্ডি ক্রাফট, কাপড়ের ব্যবসা। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।  

৫০ এর দশকে 'ওয়ারসি বুকশপ' ছিল ঢাকার প্রথম অভিজাত বুকশপ

'ম্যারিয়েটার' পাশেই ছিল 'স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স' - রাশিয়ার প্রগতি প্রকাশনীর আড়ত বলা চলে। ম্যাক্সিম গোর্কিসহ বহু রুশ সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মের বাংলা অনুবাদ সেখানে পাওয়া যেতো। এর কর্ণধার ছিলেন রুহুল আমিন নিজামী। 'স্ট্যান্ডার্ড পাব্লিশার্স' তাদের পৈত্রিক ব্যবসা। তার দোকানে একসময় ভিড় জমাতেন শাহেদ আলী (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, 'বইমেলার সময় বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসতেন।

'প্রভেনশিয়াল বুক ডিপো ও 'স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স' এই দুটো দোকান স্টেডিয়ামের অনেক বড় জায়গা জুড়ে ছিল। আন্তর্জাতিক বইগুলোর পাশাপাশি বাংলা বইও ছিল। আমদানিকৃত বইয়ের মধ্যে ইংরেজি, চীনা আর রাশিয়ান বই বেশি পাওয়া যেত। তবে যা-ই আনা হতো তা খুব নির্বাচিত বই ছিল।


     
পুরেনো বই পাওয়া যেত বাংলা বাজার আর পুরনো পল্টনে। বিভিন্ন ভারতীয় আর ব্রিটিশ আমেরিকান ম্যাগাজিন পাওয়া যেত সেখানে। ভ্যানে করে বিক্রি করতেন 'হাশেম' নামে এক হকার। যেসব আমেরিকান বা ব্রিটিশ সাহেবরা আসতেন এদেশে, তাদের রেখে যাওয়া ম্যাগাজিন পত্রিকাগুলোই কিনে বিক্রি করতেন ভ্যানে ভ্যানে। প্রচুর পাঠক ছিল তার। নিজে বেশিদূর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করেননি, কিন্তু বই পড়ার আগ্রহ ছিল তার। কিছুটা বিপ্লবী চেতনার ছিলেন হাশেম, জানান মফিদুল হক।

৫০ এর দশকে 'ওয়ারসি বুকশপ' ছিল ঢাকার প্রথম অভিজাত বুকশপ। তারা মূলত আর্টের বই, রংয়ের সামগ্রী আনতো। পুরান ঢাকায় নাজ সিনেমা হলের নিচে ছিল এর প্রথম ঘাঁটি। এরপর এলো নিউমার্কেটে, পরে উঠেই গেলো দোকানটি। সেভেন সীজ নামে আরেকটি প্রকাশনী ছিল, জার্মান বই আনতো তারা।    

এসব দোকানে আসতেন সাধারণ পরিবারের বইপড়ুয়া, সংস্কৃতিমনা, প্রগতিশীল আর রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিরাই। কখনো ছাত্র, কখনো শিক্ষক, কখনো সাধারণ ব্যবসায়ী, ডাক্তার। একটা শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠছিল তখন এই দোকানগুলোর সুবাদে। যারা পড়তে চায়, লেখালেখি করতে চায়। সমাজ, রাজনীতি নিয়ে সচেতন হতে চায়। খুব বড় পর্যায়ের, বড় মাপের মানুষজন আসতেন না এখানে। তবে যারা আসতেন, সেঅ সাধারণ মানুষদের অনেকেই আজ বড় বড় পর্যায়ে চলে গেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, কবি আবুল হাসান প্রমুখ।  

বইয়ের আরেক দুনিয়া ঢাকার নিউমার্কেটে 

নিউমার্কেটের ১ নম্বর গেট থেকে ভেতরে ঢুকে হাতের বাঁয়ে প্রথমেই যে গলি রয়েছে, সেটি পরিচিত লাইব্রেরি গলি হিসেবে। একটা সময় এখানে ৪০টির মতো বইয়ের দোকান ছিল। সব শ্রেণির পাঠক ও বইপোকার আনাগোনা ছিল এখানে। কী বই ছিল না এখানে! দেশি-বিদেশি ছোটগল্প, উপন্যাস, বোর্ডের বই, মেডিকেল বই—সব ধরনের বইয়ের সংগ্রহ ছিল এ দোকানগুলোতে। সারাদিনই ভিড় লেগে থাকত ক্রেতাদের।

তখন নিউমার্কেটে বইয়ের দুনিয়া মানে নওরোজ কিতাবিস্তান, জিনাত বুক সাপ্লাই লিমিটেড, নলেজ হোম- এসব। নিউমার্কেটের আজিমপুরের ফটক পেরিয়ে একটু ভেতরে ছিল 'নলেজ হোম'। এখন আর নেই এই দোকানটি। কিন্তু একটা সময় এই দোকানটি পরিচিত ছিল পত্র-পত্রিকার গুদামখানা বলে।

নিউমার্কেটে সারি ধরে ছিল একসময় ৩৫-৪০টির মতো বইয়ের দোকান

অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোর বিজ্ঞান চিন্তায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'তখনকার সময়ে 'নলেজ হোম' নামে বেশ বড় একটা বইয়ের দোকান ছিল। আমি মাঝে মাঝেই গিয়ে শেলফ থেকে বিভিন্ন বই, সাময়িকী নামিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। একদিন দোকানের মালিক আমার উৎসাহ দেখে তার দোকানের চিলেকোঠায় চেয়ারে বসে আমাকে বই পড়ার সুযোগ করে দেন। সেখানেই আমি দেশ-বিদেশের নানা রকম সাময়িকী, বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়তে শুরু করি।'  

নলেজ হোমের পাশেই ছিল 'মহিউদ্দীন এন্ড সন্স' এর দোকান। দুই ভাই মিলে চালাতেন এটি। মহিউদ্দীনকে বলা হয় 'পেঙ্গুইন' আর 'পেলিকান' বইয়ের স্বর্গ। তখন মার্কিন ১ ডলার পাকিস্তানি ৪ টাকা ৭৫ পয়সার সমান ছিল। ফলে ছাত্ররাও ঐ সব বই কিনতে পারতো।

নিউমার্কেটের জিনাত আর ফয়সাল দুটি আবেগের নাম  

১৯৬৩ সালে নিউমার্কেটে প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকায় ইংরেজি বইয়ের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক ও বিক্রয়কেন্দ্র জিনাত বুক সাপ্লাই লিমিটেড। প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবদুল মালেক। অবসরে যাওয়ার পর বাবার দোকানের দেখাশোনার ভার পড়লো  সৈয়দ আবে সালেহ মোহাম্মদ ফয়সালের ওপর। যিনি আজও জিনাতের ফয়সাল নামে পরিচিত। নিউমার্কেটের জিনাত বুকশপের 'ফয়সাল' কে চেনেনা এমন প্রবীন লেখক সাহিত্যিক কমই আছে। ৬০-৮০ দশকের জীবন যাদের বইয়ের সাথে কেটেছে , তাদের কাছে নিউমার্কেটের জিনাত আর ফয়সাল দুটি আবেগের নাম।  

জিনাত বুক সাপ্লাই লিমিটেডের সেই ফয়সাল/ ছবি- টিবিএস

শুরুতে একাডেমিক বই, এরপর বাংলা বই এবং এখন শুধুই ইংরেজি বই নিয়ে কোনোমতে টিকে আছে দোকানটি। ইংল্যান্ডের ২৫টি কোম্পানি থেকে বই আনা হতো এখানে। তারমধ্যে অন্যতম পেঙ্গুইন প্রকাশনী। পৃথিবীতে শীর্ষ প্রকাশনাগুলোর মধ্যে পেইঙ্গুইনের অবস্থান শীর্ষেই। এরপর কমতে কমতে এখন একটায় এসে থেমেছে এই কোম্পানি সংখ্যা। বর্তমানে গত একবছর যাবত কোনো বই আমদানি হচ্ছে না। একে তো বইয়ের পাঠক সংখ্যাই নিচে গিয়ে ঠেকেছে। তার ওপর পাইরেসির যুগ এসে অরিজিনাল বইয়ের দাম গেছে বেড়ে। ফলে সারাদিনে একটি বই বিক্রি হয়, এই দাবিও করতে পারেন না তারা। তবু আজও দোকানে পাইরেটেড বইয়ের স্থান দেননি এক বিন্দুও!  

মেয়েদের দোষ, আশুতোষ আশুতোষ!

স্টেডিয়ামের ঐ দোকানগুলোতে যেমন মেয়েদের অংশগ্রহণ কম ছিল। নিউমার্কেটের চিত্র তেমন ছিল না। ১৯৫৪ সালে নিউমার্কেট প্রতিষ্ঠার পর নারীরা তাদের ঘরের বাইরে বের হওয়া শুরু করলো। যে কারণে এটি হওয়ার পর এর বিরুদ্ধে নান রকমের প্রচারণা হয়। এমনকি একসময় মার্কেটের ভেতরে 'বেপর্দা' নারীদের প্রবেশ রোধ করার জন্য স্থানীয় মসজিদ থেকে লোক পাঠানোর প্রস্তাবও করা হয়েছিল- এমন কোথাও লেখা রয়েছে কাদের মাহমুদের 'ঢাকাই কথা ও  কিসসা' বইটিত।

যা-হোক, এই বইয়ের দোকানগুলোতে মেয়েরা ভিড় জমাতো সুনীল, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বইগুলোর জন্য। মেয়েরা তখন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বই পড়তো খুব। তা-ই মজা করে বলা হতো, মেয়েদের দোষ, আশুতোষ আশুতোষ!

৭১ সালের ১লা আগস্টে লন্ডনের ট্রাফাল্গার স্কয়ার

এছাড়া, জেমস লং এর বাংলা বই, 'প্রবাদমালা' তিন খন্ডের,  সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস, যে গল্পের শেষ নেই, ভারতের প্রাচীন বিবাহ সম্পর্কিত বই, প্রাচীন নৃতত্ত্বের ইতিহাস এই বইগুলোও সাধারণ মানুষই পড়তো।  

ধনী পরিবারের গৃহিণীরা কিনতেন বিভিন্ন চিত্রকর্মের বই। বুলবুল-ই-শিরাজ উপাধিতে ভূষিত ইরানি কবি হাফিজ, কবি মওলানা জালালুদ্দীন রুমি, শেখ সাদি, কবি জামির বিভিন্ন বই পাওয়া যেত একদম অরিজিনাল। আগে একদিনে যা বিক্রি হতো, এখন পাঁচমাসেও তা বিক্রি হয়না বলে জানান ফয়সাল।

সবই স্মৃতি...

আরেকটি দোকান ছিল, যার দায়িত্বে ছিলেন লেখক খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। দোকানটির নাম জানা না গেলেও, চাইনিজ বইসহ অন্যান্য বই পাওয়া যেত সেখানেও। ইলিয়াস সাহেব ছিলেন বামপন্থী এবং একজন প্রগতিশীল ব্যক্তি। সহোদর ভাই কে জি মোস্তফা একজন ভাষাসৈনিক এবং সাংবাদিক।  

এসব বইয়ের দোকান ঘিরে ছিল শিক্ষিত সমাজের আড্ডা। শহর বড় ছিল না, কিন্তু প্রাণবন্ত ছিল। মানুষের মধ্যে যাওয়া আসা ছিল, আন্দোলন ছিল। শুধু বই কেনার উদ্দেশ্যেই না, আড্ডা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিংবা একটু দেখা করে যাওয়ার জন্য আসতেন তারা। অনেকের সঙ্গে দেখা হতো। কিন্তু এরা কেউ খ্যাতিমান ছিলেন না। একেবারে সাধারণ মানুষ।     

একদম শুরুর দিকে ভারতীয় বইগুলো বিক্রি হতো এসব দোকানে। কিন্তু ৬৫র পাক-ভারত যুদ্ধের পর বই আসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন অন্যান্য বিদেশি বইগুলো আসা শুরু হয়। এদেশের পাঠকদের সঙ্গে বিদেশি সাহিত্যের প্রেমের সম্পর্কটা আইয়্যুব খানের সময়েই গড়ে ওঠে। কারণ, বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মান, যুক্তরাজ্য এসব জায়গা থেকে প্রচুর বই আসতো এদেশে। তাছাড়া তখন তৃতীয় বিশ্বগুলোতে পাঠ্যবইয়ের দামটাও বেশি ছিল। তাই, ব্রিটিশ কাউন্সিল ইএলবিএসের বইগুলো আনত। এছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনীর যেসব বই প্রয়োজন, সেগুলো পেপারব্যাক করে, কম দামে নিয়ে আসতো এই দোকানগুলো।

ক্রমে, ঢাকার কেন্দ্র সরে যাওয়ার কারণে বইয়ের দোকানও সরে গেলো। নতুন ঠিকানা এলো নিউমার্কেট। কিন্তু নিউমার্কেটেও আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল। নীলক্ষেতে মূল বইয়ের পাশাপাশি পুরোনো বই ও ফটোকপি করা বই বিক্রি শুরু হলে, নিউমার্কেটে হ্রাস পেতে থাকে দেশের বাইরে থেকে বই আমদানির পরিমাণ। তবে এ কোথাও সত্যি, টেলিভিশন আসার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ৬০-৮০র দশক পর্যন্ত বইয়ের প্রতি মানুষের টান যেমনটা ছিল এখন আর তা নেই। ফলে ফটোকপি দিয়েও দোকানগুলো তাদের পাঠকদের ধরে রাখতে পারছেনা আর…

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.