কি আছে ফিনল্যান্ডের বিশ্বের প্রথম স্থায়ী পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণাগারের অভ্যন্তরে!

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
21 October, 2022, 07:10 pm
Last modified: 21 October, 2022, 07:47 pm
বনের ভেতরে ৪০০ ফুট মাটির নিচে বিশ্বের সর্বপ্রথম স্থায়ী 'পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণাগার' তৈরির কাজ হাতে নিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে ফিনল্যান্ড! দেশটির পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত অলকিলুয়োতো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঠিক পাশেই এই সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।

প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উচ্চমাত্রায় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য কোথায় রাখা হবে তা উন্নত দেশগুলোর জন্য একটি বড় চিন্তার বিষয়। কারণ এটি এমন একটি পদার্থ যা থেকে সামান্য অসাবধানতায় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বনের ভেতরে ৪০০ ফুট মাটির নিচে বিশ্বের সর্বপ্রথম স্থায়ী 'পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণাগার' তৈরির কাজ হাতে নিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে ফিনল্যান্ড! শুধু তাই নয়, দেশটি জানিয়েছে মাটির নিচে এই বর্জ্য নিরাপদে রাখা যাবে ১ লাখ বছর! 

স্কাই নিউজ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালে এই সংরক্ষণাগার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এদিকে যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশও একইভাবে স্থায়ী পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণের কথা বিবেচনা করছে। আর যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে পঞ্চাশের দশকে পারমাণবিক শক্তির উত্থানের পর থেকে বিশ্বজুড়ে যে ২৬০,০০০ টন উচ্চমাত্রায় তেজস্কিয় পারমাণবিক বর্জ্য জমা হয়েছে, সেগুলোরও নিষ্পত্তি সম্ভব!

ফিনল্যান্ডের এই পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণ কেন্দ্রটির নাম 'অংকালো', ফিনিশ ভাষায় যার অর্থ গর্ত। দেশের পশ্চিম উপকূলের ইউরাজকি পৌরসভায় অবস্থিত অলকিলুয়োতো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঠিক পাশেই এই সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। যদিও নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনে নাশকতার পর এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই কড়া যে জায়গাটির কোনো ছবি-ভিডিও তোলার অনুমতি দেওয়া হয় না।

ছবি: স্কাই নিউজ

ফিনল্যান্ডের এই যুগান্তকারী প্রকল্পটির কাজ দেখাশোনা করছে 'পোসিভা' নামের একটি কোম্পানি। প্রাতিষ্ঠানটির সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার ও ভূতত্ত্ববিদ সানা মাস্তোনেন জানান, এখানকার মাটির নিচে যে বেডরক (শিলাপাথর) রয়েছে তা প্রায় দুই বিলিয়ন বছর আগে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এবং এতগুলো বছর ধরে একই রকম আছে। তার ভাষ্যে, এই পাথুরে ভিত্তি খুবই শক্ত-মজবুত। এর আশেপাশে কন্টিনেন্টাল প্লেট নেই বলে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয় না। 

কড়া নিরাপত্তা

অন্যান্য দেশের মত ফিনন্যান্ডও মাটির ওপরে শিল্ডেড বাংকারে ব্যবহৃত পারমাণবিক জ্বালানি সংরক্ষণ করছে, যদিও বর্তমানে তারা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খুঁজছে। কিন্তু পোসিভার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিকা পজোনেন বলেন, এ ধরনের বিপজ্জনক বর্জ্য পদার্থ এভাবে ফেলে রাখা খুবই অবিবেচকের মতো কাজ হবে, কারণ যেকোনো মুহূর্তে এটি ভুল মানুষের হাতে পড়তে পারে।  

স্কাই নিউজকে তিনি বলেন, "আপনি ৩০০ বছর আগের ইতিহাস দেখুন, ইউরোপজুড়ে ঠিক কতগুলো যুদ্ধ হয়েছে? এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য মানুষের সক্রিয় উদ্যোগ দরকার এবং এর চারপাশে কড়া নিরাপত্তা দরকার। আর এক প্রজন্ম পরেই এর দিকে তাকিয়ে আপনি সত্যিই বুঝতে বুঝতে পারবেন না যে এই ধরনের ব্যবস্থা যথেষ্ট ঝুঁকিমুক্ত কিনা।"

ছবি: স্কাই নিউজ

পারমাণবিক বর্জ্য সমস্যা সমাধানের জন্য এযাবত অনেকেই অনেক পরামর্শ দিয়েছেন, এই যেমন-এগুলো গভীর মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা, সমুদ্রের পরিখার মধ্যে চাপা দেওয়া কিংবা পৃথিবীর ভূত্বকের ফাটলে ফেলে দেওয়া! কিন্তু সবগুলো পরামর্শই অকার্যকর, ব্যয়বহুল বা পরিবেশগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

সুরক্ষিত থাকবে ১ লাখ বছর!

পোসিভা ফিনল্যান্ডের পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করবে তা হলো- মাটির নিচে খনন করে টানেলের মধ্যে দুই স্তরবিশিষ্ট, বিশালাকার ধাতব ক্যানিস্টার স্থাপন করা এবং এগুলোর ভেতরে ব্যবহৃত পারমাণবিক জ্বালানি ফেলা। 

প্রবেশপথ থেকে ৫ কিলোমিটার হেঁটে পার হওয়ার পর একদম শেষ প্রান্তে টানেলগুলোর দেখা মিলবে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৫টি টানেলের কাজ সম্পন্ন হয়েছে, যদিও আগামী দশকগুলোতে এখানে একশোটিরও বেশি টানেল নির্মাণ করা যাবে।

ক্যানিস্টারগুলোকে টানেলের গায়ে তৈরি করা ছিদ্রের মধ্যে পুরে দেওয়া হবে। এরকম ৩২৫০টি ক্যানিস্টার রাখা হবে টানেলগুলোতে এবং এগুলোর মধ্যে মোট ৬৫০০ টন ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম রাখা যাবে।

এছাড়া, এগুলো শুকনো রাখার জন্য বেন্টোনাইট (বিড়ালের লিটারে ব্যবহৃত এক ধরনের শোষক পদার্থ) দিয়ে জড়িয়ে রাখা হবে। টানেলগুলোর ছিদ্র পূর্ণ করতেও বেন্টোনাইট ব্যবহৃত হবে। ক্যানিস্টারে ইউরেনিয়াম রাখার পর টানেলগুলোর প্রধান প্রবেশপথ রাবার ও কনক্রিট দিয়ে ভরাট করা হবে।

ছবি: সংগৃহীত

প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে এই সংরক্ষণাগারটি ভরে গেলে এটি সিল করে বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং মাটির উপরে সব চিহ্ন মুছে ফেলা হবে। পজোনেনে বলেন, "বর্জ্যগুলো মাটির নিচে ১ লাখ বছর সুরক্ষিত থাকবে। সেসময় হয়তো এ অঞ্চলে আর কোনো মানুষ থাকবে না। হয়তো তখন এই এলাকা পানির নিচে থাকবে। কিন্তু এটার নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যেন প্রাণীকূলের সংস্পর্শে না আসে।

তবে কিছু কিছু বিজ্ঞানী সতর্ক করেছেন এই বলে যে, পানির সংস্পর্শে এসে বিক্রিয়ার ফলে এই ধাতুর ক্ষয় হতে পারে এবং তেজস্ক্রিয় হয়ে ওঠার ফলে সহস্রাব্দ ধরে উপরে উঠে আসতে পারে।

কিন্তু পোসিভা বলছে, এ প্রজেক্টে একাধিক ব্যারিয়ার ব্যবহার করা হয়েছে যার ফলে বর্জ্য পদার্থ ভেতরেই থাকব এবং পানি ঢুকবে না। আর দৈবাত, যদি কোনো ছিদ্র তৈরি হয়, তা হলেও ১০,০০০ বছরে তেজস্ক্রিয়তা এত কমে আসবে যে ততদিনে তা আর জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হবে না।

এদিকে, ফিনল্যান্ডের এ অগ্রগতি দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে অন্যান্য দেশগুলো। সুইডেন ইতোমধ্যেই নিজস্ব 'জিওলজিকাল ডিসপোজাল সাইট'র নির্মাণকাজ শুরু করেছে। তার পেছনেই রয়েছে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের কামব্রিয়া ও লিংকনশায়ারে এ ধরনের প্রজেক্টের জন্য চারটি এলাকা চিহ্নিত করে সংক্ষিপ্ত তালিকা বানানো হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের 'নিউক্লিয়ার ওয়াস্ট সার্ভিসের'- প্রধান নীতি উপদেষ্টা ব্রুস কেয়ার্নসও মনে করেন, বর্জ্য নিষ্পত্তির জন্য স্থায়ী কোনো সমাধান দরকার। তিনিবলেন, "বিদ্যুৎ উৎপাদন, প্রতিরক্ষা ও সংক্রান্ত নানা কাজের ফলে ইতোমধ্যেই আমাদের ৭০ হাজার বছরের মতো বর্জ্য জমে গেছে। এগুলো সরাতে চাইলে আমাদেরই কাজ করতে হবে এবং দায়িত্বশীলভাবে করতে হবে।

স্থানীয়দের সমর্থন

ফিনল্যান্ডের এই পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণের পেছনে স্থানীয়দের সমর্থন রয়েছে। অংকালো সংরক্ষণাগার থেকে সবচেয়ে কাছের মানববসতি হলো ১০ মাইল দূরের ইউরাজকি। বর্জ্য নিষ্পত্তির করার জায়গা হিসেবে করা সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে এ অঞ্চল নির্বাচিত হয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতিতেই। 

শহরের মেয়র ভেসা লাকানিয়েমি বলেন, "এখানে গত ৪০ বছর যাবত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো রয়েছে। যেসব অঞ্চলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, সেখানকার লোকেরা অবশ্যই অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভালো জানবে। গত চার বছরে আমাদের উপর মানুষের ভরসা অনেকটাই জোরদার হয়েছে।" 

সূত্র: স্কাই নিউজ

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.