জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কি সত্যিই অতীত দেখতে পারে?

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
26 September, 2022, 09:30 pm
Last modified: 26 September, 2022, 09:42 pm
ধ্রুবতারা থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ৩২৩ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ আপনি যখন আকাশে ধ্রুবতারা দেখেন, তখন ওই তারার যে আলো আপনার চোখে ধরা পড়ে, তা মূলত ৩০০ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো আলো।

এ বছরের ১১ জুলাই মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা'র জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) মহাশূন্যের নক্ষত্রখচিত একটি ছবি পাঠিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এটি মহাবিশ্বের এখন পর্যন্ত তোলা সবচেয়ে গভীর অংশের ছবি।

অন্য টেলিস্কোপগুলোর তুলনায় মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরতম অংশে দৃষ্টিনিক্ষেপ করার পাশাপাশি ওয়েব টেলিস্কোপের আরেকটি আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। তা হলো, এ টেলিস্কোপটি অন্য টেলিস্কোপের চেয়ে বেশি অতীতের দৃশ্যও দেখতে পারে।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সূচনার কিছু পরের দৃশ্যের ছবিও তুলতে পারে ওয়েব টেলিস্কোপটি। এটি প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন তথা ১৩৫০ কোটি বছর আগে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো কেমন ছিল তা পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম।

কিন্তু এসব কীভাবে সম্ভব? একটা মেশিন কী করে 'অতীতে' তাকাতে পারে? উত্তর হলো, এটা কোনো জাদু নয় বরং স্রেফ আলোর প্রকৃতি।

'টেলিস্কোপ টাইম মেশিন হতে পারে। মহাশূন্যে তাকানোর ব্যাপারটা অনেকটা অতীতে ফিরে তাকানোর মতো,' নাসা'র বিজ্ঞানীরা ওয়েব টেলিস্কোপের ওয়েবসাইটে এভাবেই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন। 'শুনতে জাদুর মতো মনে হলেও, এটা কিন্তু আদতে খুবই সাধারণ একটি বিষয়: মহাশূন্যের বিশাল অঞ্চল পার হয়ে আলোর আমাদের কাছে আসতে সময়ের প্রয়োজন হয়।'

আমাদের হাতের মোবাইল ফোনের আলো থেকে শুরু করে রাতের বেলা আকাশের ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা কোনো তারার আলো- সব দৃশ্যমান আলোরই আমাদের চোখে পৌঁছাতে সময় লাগে। ভালো কথা হলো, আলো অনেক দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে। প্রতি একক সেকেন্ডে আলো প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। সেজন্য মোবাইল বা ঘরের বৈদ্যুতিক বাতি থেকে আলো আমাদের চোখে পৌঁছানোর সময়টা আমরা টের পাইনা।

কিন্তু যখন আমরা কয়েকশ লাখ বা কোটি মাইল দূরত্বে অবস্থান করা কোনো বস্তুর দিকে তাকাই, তখন আমরা যে আলো দেখতে পাই তা আমাদের চোখ পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য ততক্ষণে মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ একটি পথ অতিক্রম করেছে। আর রাতের আকাশে আমাদের দেখা বেশিরভাগ বস্তুই পৃথিবী থেকে কয়েক শত লাখ বা কোটি কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করে।

সূর্যের কথাই ভাবা যাক। আমাদের সৌরজগতের একমাত্র নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে গড়ে ১৫০ মিলিয়ন (১৫ কোটি) কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করে। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় আট মিনিট ২০ সেকেন্ড। তাই আপনি যখন সূর্যের দিকে তাকান (তবে সূর্যের দিকে খালি চোখে তাকানো একদমই উচিত নয়), তখন আপনি যে সূর্যটাকে দেখছেন তা আদতে আট মিনিট আগের সূর্য।

অর্থাৎ আপনার বর্তমান মুহূর্তে সূর্য কেমন তা দেখতে হলে আপনাকে আরও আট মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ, অন্যভাবে বলতে গেলে, আপনি সূর্যকে যখন দেখেন, তখন আসলে আপনি আট মিনিট অতীতকে দেখেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে আলোর দ্রুতি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যের বড় দূরত্ব পরিমাপ করার ক্ষেত্রে মাইল বা কিলোমিটারের বদলে আলোকবর্ষ ব্যবহার করেন। প্রতি একক বছরে আলো যেটুকু পথ অতিক্রম করতে পারে তাকে এক আলোকবর্ষ বলে। এ দূরত্ব প্রায় ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার।

উদাহরণস্বরূপ, ধ্রুবতারা থেকে পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ৩২৩ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ আপনি যখন আকাশে ধ্রুবতারা দেখেন, তখন ওই তারার যে আলো আপনার চোখে ধরা পড়ে, তা মূলত ৩০০ বছরের বেশি সময়ের পুরোনো আলো।

সুতরাং, অতীতকে দেখার জন্য আপনাকে পয়সা খরচ করে টেলিস্কোপ কিনতে হবে না। খালি চোখেই সেটা আপনি প্রত্যক্ষ করতে পারছেন। কিন্তু সত্যিকারের সুদূর অতীতের দিকে তাকানোর জন্য বিজ্ঞানীদের জেডব্লিউএসটি-এর মতো টেলিস্কোপ প্রয়োজন। এ অতীত হতে পারে আমাদের মহাবিশ্বের জন্মলগ্ন পর্যন্ত।

সব ধরনের আলো কিন্তু আমরা চোখ দিয়ে দেখতে পাইনা। যে আলো খালি চোখে দেখা যায় তাকে দৃশ্যমান আলো বলে। দেখা না যাওয়া আলোর মধ্যে একটি হচ্ছে অবলাল আলো বা ইনফ্রারেড লাইট। এ অবলাল আলো মানবচোখে অদৃশ্য হলেও ওয়েব টেলিস্কোপ কিন্তু এটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ধরতে পারে।

মানুষ সহ আরও অনেক কিছু অবলাল শক্তি হিসেবে তাপ নির্গত করে। খালি চোখে এটি দেখা না গেলেও যথাযথ যন্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে অবলাল তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করে মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুগুলোও খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

এর কারণ, দৃশ্যমান আলোর তুলনায় অবলাল বিকিরণ মহাশূন্যের ঘন, ধুলোবালিপূর্ণ এলাকা দিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না পড়ে বা শোষিত না হয়ে পরিভ্রমণ করতে পারে। অনেক দূরের তারকা ও গ্যালাক্সিগুলোর দৃশ্যমান আলো মহাশূন্যের ধুলার মেঘের বাইরে বেরোতে পারেনা। কিন্তু অবলাল আলো সহজেই এ ধরনের বাধা অতিক্রম করতে পারে বলে ওয়েব টেলিস্কোপ এটিকে ব্যবহার করে দূরবর্তী বস্তুর ছবি তুলতে পারে।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের সবচেয়ে কার্যকরী বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো এর ইনফ্রারেড আলো চিহ্নিতকরণের ক্ষমতা। এ প্রযুক্তির কল্যাণে এ টেলিস্কোপ ১৩০০ কোটি বছর আগে সবচেয়ে পুরনো নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলো যে আলো নিঃসরণ করেছিল তাও পর্যবেক্ষণ করতে পারে।

আর এভাবেই গত জুলাই মাসে গভীর মহাবিশ্বের বিখ্যাত সেই ছবিটি তুলেছে ওয়েব টেলিস্কোপ। আর এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেই আরও বেশি অতীতে অনুসন্ধান চালাবে ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি করা এ টেলিস্কোপটি। মহাবিস্ফোরণের কয়েকশ মিলিয়ন বছর পরের নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলো কেমন ছিল সে ছবিও তুলতে পারবে এটি।

অতীতের যে তারাগুলোর ছবি তুলবে ওয়েব, সেগুলো এতদিনে মৃতনক্ষত্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। কিন্তু তাদের নিঃসৃত আলো মহাশূন্যের সসীম তথাপি বিস্তৃত অঞ্চল পরিভ্রমণ করে আমাদের তৈরি টেলিস্কোপের চোখে ধরা পড়লে আমরা আমাদের নশ্বর চোখ দিয়ে এক প্রকার অতীত ভ্রমণ করে আসতে পারব।


সূত্র: লাইভ সায়েন্স

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.