হেলালের ‘প্রেমের ঠিকানা’ চলছে শারজায়

ফিচার

01 September, 2022, 09:30 am
Last modified: 01 October, 2022, 10:00 am
সোজাসাপটা মানুষগুলোর সোজা সোজা চাওয়া। এই খেটেখাওয়া, সোজাসাপটা মানুষগুলোর বাসনা ক্যামেরায় ধরার এ প্রকল্পের নাম হেলাল রাখলেন লাভ স্টুডিও, যার বাংলা হতে পারে প্রেমপুরী, প্রেমনগরী বা প্রেমের ঠিকানা।

লাভ স্টুডিয়োতে তোলা ছবি

বারো-চৌদ্দ বছর আগে জুরাইন-পোস্তগোলা ছিল শহরের তলানি। গ্রামহারা বা গ্রামছাড়া মানুষের ছিল থিকথিকে ভিড় হেথা। বড় বাসনা সম্বল করে তারা রি-রোলিং মিল, রেস্তোরাঁ, ম্যাচ ফ্যাক্টরি বা গার্মেন্টে এসে কাজ নিত ছোটখাটো। কারোর বাসনা ছিল দুবাই যাওয়ার, কেউ চাইত ব্যান্ড দলের গায়ক হতে, কারোর ইচ্ছা জাগত প্রিয় নায়িকার সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে, কেউবা গুলশানে বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখত। 

তবে ৩১ বছর বয়সী জাভেদ, যে কোনো কাজ জুটিয়ে উঠতে পারেনি, সে চাইত দুর্নীতিবাজদের নিকেশ করতে। আর মিন্টু ও মনির বাসনা ছিল একটা যুগল ছবি তোলার। দেড় বছর হয়ে গেছে তাদের বিয়ের বয়স, অথচ আজো একটা ছবি তোলার সময়-সুযোগ মেলাতে পারেননি। এদিকে রুমা আর সূচনা দুই বান্ধবী, গায়ে হলুদের, জন্মদিনের বা মুসলমানির অনুষ্ঠানে গানের সঙ্গে নাচেন। তাতে রোজগার যা হয় তার চেয়ে গঞ্জনাই জোটে বেশি। তাই তারা ক্ষুব্ধ, রাগ ঝাড়ে সমাজের ওপর—ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই। যদি কোথাও থেকে দুটি রাইফেল জোগাড় করা যেত, তবে দুড়ুম দুড়ুম দেগে দেওয়া যেত বারকয়।

টিপু চায় একটু

টিপুর বাসনাও বেশি বড় নয়, কিন্তু উপায় করা মুশকিল। বয়স তার ১৫-১৬। চায়ের দোকানে হেলপারি করে। সপ্তাহে নিদেনপক্ষে ১টি, ফুরসত মিললে দুটি সিনেমাও দেখে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দোকান ঝাড় দেয়া থেকে শুরু করে, চায়ের কেতলি পরিষ্কির, কাস্টমারকে পানি দেওয়া—সব কাজই সে নিয়মমাফিক ঠিক ঠিক করে যায়; কিন্তু মাথায় ঘোরে নায়িকার ভঙ্গি, চাহনি, চপলতা, চঞ্চলতা, আদর, আবদার, অভিযোগ, বিরহ। 

সামসুল আলম হেলাল

নায়িকার সুখগুলোই টিপুর সুখ হয়ে চলে ফেরে আর তার দুঃখ ঘোচাতে না পারার বেদনায় সে বিমর্ষ থাকে। ইচ্ছে হয় তেমন তেমন সময়ে পাগলি মেয়েটাকে একটু আদর করে দেয়। একটু জড়িয়ে ধরে গেয়ে ওঠে—'ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়'। টিপুর দোকানে হেলাল চা খেতে যায় মাঝেমধ্যে। গল্পে গল্পে টিপুর জীবনের কথা তার জানা হয়ে যায়। বোঝা হয়ে যায়, টিপু বাস করে রিয়ালিটি আর ফিকশনের মাঝখানে। কী হবে তখন যদি ক্ষণকালের জন্যও টিপুর কল্পনা বাস্তবে রূপ নেয়? এই না ভেবে হেলাল বলেই বসেন, নায়িকার সঙ্গে একটা ছবি তুলবে?

টিপুর অবাক হতে বাকি থাকে না। একটি সিনেমার পোস্টার থেকে টিপুর প্রিয় নায়িকার (শিমলা অথবা শাহনাজ) কাটআউট ছবি সংগ্রহ করলেন হেলাল, তারপর সেটির লাইফ সাইজ প্রিন্ট দিয়ে লাগিয়ে দিলেন ককশিটের ওপর। টিপুর তখন নায়িকাকে জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমি করার উপায় মিলে গেল! 

হেলাল পোস্তগোলার ছেলে। পুরো নাম সামসুল আলম। শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজ থেকে ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রি নিয়ে দৃকের পাঠশালায় তিন বছর ফটোগ্রাফি কোর্স করেছেন। তার বড় ভাইয়ের স্টুডিও ছিল। ভাইয়ারা দল বেঁধে এদিক-সেদিক ছবি তুলতে যেত। ফিরে এসে নানান অভিজ্ঞতা বয়ান করত। ভালো লাগত হেলালের। 

পাঠশালায় পাঠ নিতে নিতেই হেলাল স্থির করে ফেললেন, তিনি ফটোগ্রাফারই হবেন। হেলাল চাইলেন তার আশপাশকে (সারাউন্ডিং) সাবজেক্ট করতে। আশপাশের মধ্যে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা আগে পড়ে।

তবে হেলালের ইচ্ছা হলো, দেখা হয় অথচ চেনা হয়নি সেভাবে, সেসব মানুষকে সাবজেক্ট করতে। এই মানুষগুলো কত কত আশা নিয়ে দূর দূর থেকে শহরে এসেছে। তাদের পানীয় জলের সমস্যা, রোগ-বালাই, কাজিয়া-ঝগড়া নিয়ে তো পত্রপত্রিকায় লেখা হয়, কিন্তু যে আশা বা বাসনা বা আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন নিয়ে তারা শহরে এসেছে তার কথা তো সেভাবে জানা হয়নি। তিনি দেখলেন, এখানে অনেক রকমের মানুষ। সবাই লড়ছে। বাঁচতে চাইছে কিন্তু অবসরে তাদের চোখ চলে যায় দূরে, সেখানে কী যেন দেখে তারা। হেলাল তাদের চা খাওয়াতে লাগলেন, আসলে তো মনের ভিতরে উঁকি দেওয়ার ইচ্ছা। 

লাভ স্টুডিয়োতে তোলা ছবি

হেলাল দেখলেন, সোজাসাপটা মানুষগুলোর সোজা সোজা চাওয়া। টিভি মেকানিক খলিলের গল্পটাই বলা যাক। অনেক রাতেই ঘুমাতে যাওয়ার আগে সে ভাবে, কাল সকালে উঠেই দেখবে পেল্লায় এক বাড়ির মালিক হয়ে গেছে, সামনের বড় বাগানটার মাঝখানের এক আমব্রেলা বা ছাতার নিচে বসে সে আয়েশ করে নিষিদ্ধ পানি পান করছে। সোজাসাপটা, খেটেখাওয়া মানুষগুলোর বাসনা ক্যামেরায় ধরার এ প্রকল্পের নাম হেলাল রাখলেন, লাভ স্টুডিও যার বাংলা হতে পারে প্রেমপুরী, প্রেমনগরী বা প্রেমের ঠিকানা। 

 কাদেরও চায় ছবি তুলতে

জুরাইনের আলম মার্কেট চেনে তল্লাটের সকলে। ডায়না, মেঘনা, যমুনা নামের তিন তিনটি সিনেমা হল এর আশপাশে। আলম মার্কেটেই মজমা জমান কাদের। একটা ফ্লাইং সাপ আছে তার কাছে। মানুষের চোখ দেখে বুঝতে পারেন কে বিরহী আর কে মরমী। তার কথায় জাদু আছে। শ পাঁচেক লোককে তিনি একসঙ্গে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন, তাদের পকেট থেকে বের করে আনতে পারেন টাকা।

নিজের পেশাকে ভালোবাসেন কাদের। মানুষের মন পড়ার নেশা তাকে ছাড়ে না। যদিও জানেন, তাবিজ-কবচ সবই বুজরুকি; তবু তার এটাই ভালো লাগে। তার ইচ্ছা ফ্লাইং সাপটা গলায় পেঁচিয়ে একটি ছবি তুলবেন। হেলাল একটা স্টুডিও বানিয়েছেন শুনে নিজের আগ্রহেই ছবি তোলাতে আসেন। 

স্টুডিওটা হেলালের বন্ধুর। ফিল্মের সময় পার হয়ে তখন ডিজিটাল আমল এসেছে। বন্ধুটির ডিজিটাল সবক নেওয়া হয়নি বলে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার জোগাড়। হেলালকে তাই একটুআধটু দেখিয়ে দিতে বলেছিলেন। হেলাল যতটা পেরেছেন জানিয়েছেন। বন্ধুটি তাই কৃতজ্ঞ ছিলেন। এখন হেলালের লাভ স্টুডিওর জন্য একটি স্টুডিও দরকার। বন্ধুটিকে বলতেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। 

এরপর খোঁজ পড়ল একজন চিত্রকরের যে সিনারি আঁকতে জানে, যেমনটা আগের দিনের স্টুডিওগুলোয় থাকত। বনি গোপালের কথা জানতে পারলেন হেলাল। তাকে ও তার সঙ্গীকে দিয়ে কয়েকটি সিনারি আঁকালেন হেলাল। একটায় ধরা পড়ল সূর্যোদয়ের মুহূর্ত, অন্যটায় দুবাইগামী বিমান, আরেকটায় বিলাসবহুল বাড়ি, সাজানো বাগান ও দামি গাড়ি। বনমাঝে ঝরনাও আঁকা হলো। নদী, হাঁস আর নৌকাও আঁকা হলো।

লাভ স্টুডিয়োতে তোলা ছবি

দেশে বড় দুখরে

যে রুমাকে আগে আমরা দেখেছি সূচনার সঙ্গে রাইফেল হাতে দাঁড়াতে এবার তিনি মোটরসাইকেল চালাবেন। বারো-চৌদ্দ বছর আগে পুরান ঢাকা তো বটেই, নতুন ঢাকাতেও নারী মোটর সাইকেল চালকের সংখ্যা ছিল কম। 

রুমার সঙ্গে এসেছেন তাদের ডান্স টিমের সদস্য কামরুল। হেলাল বাসা থেকে নিয়ে এসেছেন একটি মোটর সাইকেল। পাহাড়ঘেরা এক নদীর দৃশ্যের ধারে সাইকেলটি রাখা হলো। রুমা নিজে থেকেই চালকের আসনে গিয়ে বসল আর কামরুল পিছনের সিটে দাঁড়িয়ে কোনো এক মহানায়কের মতো দুই হাত ছাড়িয়ে গান গেয়ে উঠলেন—'এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো, তুমি বলো তো'। 

এবার একটু পলাশের কথা বলা যাক। পলাশের বয়স তখন ছিল ৩২। কাজ করতেন এক রি-রোলিং মিলে। তার একার আয়ের ওপর পুরো সংসার নির্ভরশীল। বেতন যা পান তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই পলাশ বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সেখানে তিনি ভালো রোজগার করবেন আর তা দিয়ে সংসার চলবে ভালোভাবে।

মেঘের ফাঁক দিয়ে উড়ে চলা এক বিমানের দৃশ্যের সামনে এমনভাবে বসানো হলো পলাশকে যেন ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষমাণ। তখন তার গায়ে পোলো শার্ট, চোখে কালো গগলস, ডান হাতটা ট্রাভেল ব্যাগের হ্যান্ডেলের ওপর রাখা। 

এবার দেড় বছরের শিশু জুঁইয়ের কথা বলা যেতে পারে। তার পিতা একটা রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করেন। কিন্তু তিনি চান জুঁই কমপক্ষে এইচএসসি পাশ করুক আর একটা ভালো চাকুরি করুক এবং ধনী জীবনযাপন করুক। জুঁইকে যে দৃশ্যের সামনে বসানো হয়েছে তার পেছনে একটা দামি লাল গাড়ি। 

তারপর পীরভক্ত এক দোকানির ছবি তুলেছেন হেলাল। তাকে যাওয়া-আসার পথে নানান সময়ে দেখেছেন। পরে একান্ত আলাপে জেনেছেন, মানুষটার স্বপ্ন আজমীরে যাওয়া, যেখানে শায়িত আছেন শেরে খাজা মাইনুদ্দিন চিশতী (রহ.)। লম্বা দাড়িওয়ালা, লালসালু জড়ানো, তাসবীহ হাতের, কালো টুপি মাথার মানুষটিকে অতিপ্রাকৃত দেখায়, যেমনটি তিনি চেয়েছিলেন। 

লাভ স্টুডিয়োতে তোলা ছবি

দুবাই যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলে কেমন হবে তার ছবিও তুলেছেন হেলাল। ঝাঁ চকচকে রাস্তার দুপাশে উঁচু উঁচু ভবন আর রাস্তা দিয়ে চলছে নতুন মডেলের একটা গাড়ি আর সেটিতেই বসে আছে স্বপ্নপূরণকারী দুই যুবক।  

এমন নানা ভাবনার ২০-২২টি ছবি তুলেছেন হেলাল। তৈরি হয়েছে তার লাভ স্টুডিও। সবগুলি সাজিয়ে নিলে গতানুগতিক বাংলা সিনেমার একটি চিত্রনাট্যও তৈরি হয়।

প্রেমের ঠিকানার চিত্রনাট্য

সূর্য উঠল, মানে ভোর হলো। তারপর নায়কের শৈশবকাল। প্রার্থনায় বসেছেন নায়কের পিতামহ। নায়ক চলেছেন বিদেশ। একদিন তার একটি সুন্দর বাড়ি হলো। সেখানে ডান্সাররা আনন্দ করছে। নায়ক প্রেমিকার সঙ্গে মধুর সময় কাটাচ্ছেন। পরিবারসহ নায়ক ঝরনা দেখতে বেরিয়েছেন। এর মধ্যে তাদের গ্রামের কথা মনে পড়ে যায় যেখানে তাদের শেকড়। কিন্তু সেখানে দুর্নীতিবাজ অপরাধীরা শেকড় গেঁড়ে বসেছে। গ্রাম ছেড়ে সাপুড়েকে চলে আসতে হয় শহরে। নায়ককে জড়িয়ে পড়তে হয় সংঘাতে। 

এর মধ্যে একটা মন্তাজ দৃশ্যও তৈরি হয় যেখানে ছাগলের পিছনে লুকিয়ে থাকে বাঘ, যার অর্থ জয় নায়কের জন্যই নির্ধারিত। বিজয় আসার পর নায়িকার মোটরসাইকেলের পিছনে জায়গা নিয়ে নায়ক গাইতে থাকেন, এই পথ যদি না শেষ হয়। 

ছয়মাস ধরে হেলাল লাভ স্টুডিও চালিয়েছেন। ফটো সিরিজটি তৈরি হয়ে গেলে ২০১৩ সালের সপ্তম ছবিমেলায় প্রদর্শিত হলো আর প্রশংসাও পেল। তারপর থেকে সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরছে হেলালের লাভ স্টুডিও। এখন যেমন প্রদর্শিত হচ্ছে শারজায়।

লাভ স্টুডিয়োতে তোলা ছবি

শারজায় চলছে লাভ স্টুডিও

সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ আর্ট ফাউন্ডেশন এবং দিল্লির কিরণ নাদের মিউজিয়াম অভ আর্ট আয়োজন করেছে পপ সাউথ এশিয়া নামের এক বিপুল প্রদর্শনীর। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ শুরু হয়ে এটি চলবে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলংকার শিল্পীরা এতে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে সামসুল আলম হেলালসহ শিশির ভট্টাচার্য, ঢালী আল মামুন এবং লালারুখ সেলিমও আমন্ত্রণ পেয়েছেন। দুইশ বছরকে ব্যাপ্তি ধরে আয়োজকরা প্রদর্শনীর দ্রষ্টব্য খুঁজেছেন বলে রাজা রবি ভার্মা, মকবুল ফিদা হুসেন প্রমুখের শিল্পকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। ২০২৩ সালে এ আয়োজন দিল্লিতেও অনুষ্ঠিত হবে। নভেম্বরের শেষ দিকে শারজায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সামসুল আলম হেলাল।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.