কাগজের দাম বেড়েছে, দাম বাড়বে বইয়েরও 

ফিচার

11 September, 2022, 01:20 pm
Last modified: 11 September, 2022, 01:38 pm
করোনা পরিস্থিতির পর সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালেই প্রথম স্বাভাবিক সময়ে বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। মেলা উপলক্ষে দেশীয় প্রকাশনীগুলোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে এখন থেকেই। দেশে বই বিক্রির সবচেয়ে বড় সেই মৌসুমে বাড়তি দামে বইয়ের বেচাকেনা নিয়ে এখনই চিন্তার ভাঁজ প্রকাশকদের কপালে।
ফাইল ছবি/টিবিএস

দ্রব্যমূল্য নিয়ে হাহাকার চারদিকে, সবকিছুর দাম বেড়ে গেলেও বাড়ছে না আপনার আয়। দৈনন্দিন জীবনে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের পর সঞ্চয় হচ্ছে না কিছুই। এই অবস্থায় আপনার কোথাও ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে, পছন্দের কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে আবার অনেকদিন ধরেই উইশলিস্টে থাকা একটা বই কেনার কথাও ভাবছেন। কিন্তু বর্তমান সামর্থ্য অনুযায়ী এই মুহূর্তে যেকোনো একটি ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতাই আপনার আছে। কোনটি করবেন?

প্রশ্নটি করেছিলাম পরিচিত কয়েজনকে। যাদের সবাই উচ্চশিক্ষিত, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মক্ষেত্রে নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত আবার বৈচিত্র্যময় তাদের আগ্রহের বলয়। দশজনের মধ্যে সাতজনের উত্তরই ছিল যেকোনো একটিকে বাছতে হলে ঘুরতে যাওয়াকেই বেছে নেবেন তারা। দুইজন বেছে নেবেন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার ইচ্ছেকে। মাত্র একজন কিনতে চান তার উইশলিস্টে থাকা বইটি। ছোটখাটো এই জরিপের ফলাফলেই অনেকটা উঠে এসেছে বই কেনায় আমাদের মনোভাব। কাগজের দামের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে যেভাবে বাড়তে চলেছে বইয়ের দাম সেক্ষেত্রে বই কেনার চাহিদায় বড়সড় পরিবর্তন আসবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।

করোনা পরিস্থিতির পর সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালেই প্রথম স্বাভাবিক সময়ে বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। মেলা উপলক্ষে দেশীয় প্রকাশনীগুলোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে এখন থেকেই। দেশে বই বিক্রির সবচেয়ে বড় সেই মৌসুমে বাড়তি দামে বইয়ের বেচাকেনা নিয়ে এখনই চিন্তার ভাঁজ প্রকাশকদের কপালে।

নয়াবাজারের কাগজের দোকান; ছবি- শেহেরীন আমিন সুপ্তি

পুরান ঢাকার নয়াবাজারের কাগজের ডিলারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত এক বছরে টনপ্রতি বইয়ের ছাপার কাগজের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা। এক বছর আগে যে 'প্রিন্টিং পেপার' এর দাম ছিলো প্রতি টন ৮০ হাজার টাকার আশেপাশে এখন তা ১ লাখ ২০-২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বই ছাপার কাগজগুলো মূলত দেশে উৎপাদিত হলেও কাগজের মিলগুলো নির্ভরশীল বিদেশী কাঁচামালের উপর। তাই বিশ্ববাজার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে কাগজের দাম বাড়ছে হু হু করে।

নয়াবাজারের কাগজ ব্যবসায়ী মেসার্স আলম এন্ড কোং-এর আমজাদ হোসেন বলেন, "৬ মাস আগে যে কাগজের দাম ছিল ১ লাখ টাকা এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কাগজের 'র' ম্যাটেরিয়ালসহ একদম প্রোডাকশন থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত যতগুলো আইটেম আছে সব কিছুর দামই এখন বাড়তি। কাঁচামালগুলো সবই আমদানিনির্ভর। পরিবহন খরচও এখন বাড়তি। আবার বিশ্ববাজারের সবকিছু স্বাভাবিক হলে কাঁচামালের প্রাইসও কমতে পারে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে কাগজের দাম অলরেডি ৫ হাজার টাকা কমেছে। বিশ্ববাজার পরিস্থিতি, ডলারের দাম সবকিছুর উপর নির্ভর করেই কাগজের দাম বাড়ছে বা কমছে।"

এক বছরের ব্যবধানে বইয়ের উৎপাদন খরচে পার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিবলিওফাইল পাবলিকেশনের প্রকাশক সাব্বির হোসেন বলেন, "১০ ফর্মার একটা বইয়ের ৫০০ কপির সংস্করণে যেখানে কোয়ালিটিভেদে আগে প্রোডাকশন খরচ পড়তো ২০-৩০ হাজার টাকার মতো এখন সেই বই মিনিমাম কোয়ালিটির কাগজে ছাপাতেই সবমিলিয়ে খরচ পড়বে ৩৫-৪০ হাজার টাকার উপর। ১০০ গ্রামের কাগজে প্রিন্ট করলে এই খরচ ৫০ হাজার টাকার কাছাকাছি চলে যাবে।"

ভূমি প্রকাশের জাকির হোসাইন জানান, "রিম অনুযায়ী যে কাগজের দাম বেড়েছে ৪০% এর মতো। একবছর আগে যে কাগজ এক রিম ১৭০০-১৮০০ টাকায় কিনতাম, তা এখন ২৮০০ টাকায় বা তারও বেশি টাকায় কিনতে হচ্ছে। ছাপার জন্য যে প্লেটটা ব্যবহার করি তা আগে কিনতাম ১৬০-১৭০ টাকায়, এখন সেটা কিনছি ২৮০ টাকায়। যে বইটা আগে বাইন্ডিং এ ২০ টাকা খরচ হতো তাতে এখন খরচ হয় ২৭-২৮ টাকা। প্রতি বইতে এখন উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে ৩৫%।"

নয়াবাজারের কাগজের দোকান; ছবি- শেহেরীন আমিন সুপ্তি

এই বাড়তি খরচে সামঞ্জস্য আনতে কোনো কোনো প্রকাশনী হয়তো নিজের লাভের মার্জিন কমিয়ে আনার চেষ্টা করবে। আবার কোনো কোনো প্রকাশনী পুরোটাই চাপিয়ে দেবে পাঠকের উপর।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর আরিফুর রহমান নাঈম বলেন, "২০০০ সালে প্রথম যখন প্রকাশনার কাজে আসি তখন যে বইটার দাম ছিলো ১০০ টাকা এখন সেটা ৩০০ টাকা। সাধারণভাবেই সবকিছুর দাম বেড়েছে সময়ের সাথে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কাগজসহ বইয়ের অন্যান্য আনুষঙ্গিকের দাম অতিরিক্তই বেড়ে গেছে হুট করে। সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দামও অনেকটাই বাড়বে। এতে গত বছর ছাপানো যে বইটার দাম ৩০০ টাকা ছিলো সামনের বইমেলায় নতুন করে ছাপালে সেটা হয়তো ৩৫০ টাকা হবে। এতে পাঠকেরা বই কিনতে এসে বড় একটা ধাক্কা খাবে। বই বিক্রি হয়তো স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে।"

"দাম বাড়লেও বই প্রকাশ তো বন্ধ হয় না কখনো। অন্যান্য বছর বইমেলায় যে হারে বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা থাকে এবারও তা-ই আছে। এক্ষেত্রে বইয়ের প্রিন্ট রান কমাতে হবে," যোগ করেন তিনি।

ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্রকাশক মাহরুখ মহিউদ্দীনেরও একই মত। তিনি বলেন, "কাগজের দাম বাড়লে আমরা সেটাকে বারবার সহ্য করে নিতে বাধ্য হই। বিজনেস প্রসেসের মধ্যে এডজাস্ট করে তখন পাঠকের উপরই বাড়তি দামের বোঝাটা দিয়ে দেই। এরকম মূল্যবৃদ্ধির একটা প্রক্রিয়া যখন চলছে তখন আমার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো হয়তো কিনবো ঠিকই, কিন্তু বই কেনাটা আসলেই কমে যাবে। তাহলে কি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে না? ভালো বই করার উৎসাহ বা আগ্রহও এতে কমে যাবে আমাদের। আমরা দেখব কোন বইগুলো বেশি বিক্রি হয়, আমাদের খরচ কভার করে সেগুলোই আরেকটু বেশি করে ছাপাবো তখন। আমাদের যে বইগুলো বের করা উচিত বা যেগুলো পাঠকের জন্য রাখা উচিত সেগুলো আমরা কম করবো বাধ্য হয়েই। যেটা খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।"

সাম্প্রতিক সময়ে কাগজের দামটা এত চূড়ান্ত রকমের বেড়েছে, এই ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে। আমার মনে হয় এটা একটু জোর দিয়েই পাবলিশারদের বলা উচিত যে এখানে কিছু একটা করণীয় আছে। অনেক পাবলিশারের কাছে এটা হয়তো কোনো ব্যাপার না, তাদের বই বিক্রির নির্দিষ্ট জায়গা আছে। কোনো না কোনোভাবে তাদের বইগুলো বিক্রি করে ফেলবেন। বইয়ের প্রডাকশন খরচ কত হলো, দাম কত বাড়লো সেটায় শেষ পর্যন্ত তাদের খুব একটা ম্যাটার করে না। কোনো না কোনোভাবে তাদের দাম উঠে আসবে। কিন্তু সত্যিকারের পাবলিশিং-এ, আমরা যারা চেষ্টা করছি পাঠকের জন্য বই করতে তাদের কিন্তু চাপ হয়ে যাচ্ছে।"

বইয়ের কাভার বানানোর কাজ; ছবি- শেহেরীন আমিন সুপ্তি

দেশীয় কাগজের দামের সাথে এর মানের অনেক বেশি পার্থক্য বলেও জানান মাহরুখ। একই কোম্পানির একই কাগজ একেকবার একেক মানের হয়। সাপ্লাই ঠিক থাকেনা কখনো। যে কারণে বইয়ের ছাপার মানও নষ্ট হয়। এত দাম দিয়ে কাগজ কিনেও তাই প্রত্যাশিত ভালো প্রিন্টিং পাওয়া যায় না বইয়ে। একই কাগজের দাম আশেপাশের দেশেও বেশ কম। যে কারণে দেশে ছাপানো বইগুলো দেশের বাইরের বাজারে সেখানকার বইয়ের সাথে প্রতিযোগিতায় যেতে পারেনা।

সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হক কাগজের দাম বাড়ার পেছনে বইয়ের প্রতি, বইমেলার প্রতি সরকারি নীতির অসংগতির কথা উল্লেখ করেন।

"সৃজনশীল বই তো কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকায় পড়ে না। আবার এই ধরনের বই ছাড়া আমরা যেমন জীবন-সমাজ চাই সেটাও অর্জন করতে পারব না। তাই কাগজের দামসহ বই সংক্রান্ত সকল বিষয়ের প্রতি নজর এনে সরকারের একটা সমন্বিত নীতি প্রণয়ন করা উচিত," বলেন তিনি।

বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না বলে তো সবাই জানি। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে দেউলিয়া হওয়ার পথে এসে কয়জন উচ্চমূল্যে সৃজনশীল বই কিনতে রাজি হবে সেটাই ভাববার বিষয়। ১৯৭১ সালে কাগজের দাম বৃদ্ধিকে জাতীয় জীবনের সংকট বলে অভিহিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ২০২২ সালের এই মূল্যবৃদ্ধি যে অবধারিতভাবেই আমাদের জাতীয় জীবনে সংকট আনবে তা বলাই বাহুল্য।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.