পয়সা উসুল শামসের আলীর ভুনা খিচুড়িতে! 

ফিচার

08 September, 2022, 12:05 pm
Last modified: 08 September, 2022, 02:09 pm
'মন-প্রাণ উজাড় করে রান্না করলাম বিখ্যাত সব ঢাকাইয়া খাবার নুইনার শাক দিয়ে গরুর গোস্ত, আনারস, পাকা আমড়া ইত্যাদি দিয়ে গরুর গোস্তের নানা পদ। সাথে ছিল খিচুড়িও। এরপর কয়েকদিন বেশ ভয়ে ভয়েই ছিলাম, কি জানি কি আছে কপালে! একদিন ডিসি স্যার তার অফিসে ডেকে বললেন- 'আরে শামসের মিয়া আপনি তো কামাল করে দিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনার হাতের রান্না তৃপ্তি সহকারে খেয়েছেন।'

চাল, ডাল, মশলাসহ যাবতীয় জিনিস একত্রে দিয়ে অদ্ভুত এক খাবার তৈরির প্রক্রিয়া আয়ত্ত করেছে উপমহাদেশের লোকেরা। সেই খাবারের নাম দেওয়া হলো খিচুড়ি। এই খিচুড়িই এ অঞ্চলের মানুষের– বাঙালি কিংবা ভারতীয়–কাছে সময়ের সাথে সাথে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অবস্থা এমন যে— একদল লোক বৃষ্টিভেজা রাত কিংবা দুপুরের খাবার হিসেবে খিচুড়ির তুলনা অন্য কিছুর সাথে করতেই নারাজ। তাই তো বৃষ্টি এলেই প্রায় বাসার উনুনেই ওঠে খিচুড়ির হাঁড়ি। যাদের বাসায় রান্না হয় না, তারাও বেরিয়ে যান খিচুড়ির খোঁজে। 

খিচুড়ির সাথে বাঙালির এই সখ্যতার পেছনের রহস্য খুঁজতে গিয়ে দেখি এর ইতিহাস বেশ পুরোনো। ধারণা করা হয়, মোটামুটি ১২০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে এ এলাকায় খিচুড়ির আবির্ভাব ঘটে। 

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' বলছে প্রাকৃত শব্দ 'কিস' বা 'কৃসরা' থেকে ক্রমান্বয়ে খিচরি (রী/ডি/ড়ী) হয়ে আজকের অপভ্রংশ এই খিচুড়ি শব্দের বিবর্তন। গ্রিক সম্রাট সেলুকাস ভারত আক্রমণের সময় 'খিসরি' নামে এক প্রকারের খাবারের উল্লেখ করেন যেটি চাল ও ডাল সহযোগে তৈরি করা হতো। 

যাইহোক, আগেকার দিনে উচ্চবিত্ত লোকজন আহারের শেষের দিকে ডালের স্বাদ নিতেন। মাছ সহজলভ্য হওয়ায় গরিবকে ডালের মুখাপেক্ষী থাকতে হত না। অবশ্য মঙ্গল কাব্যের সময় থেকে সাহিত্যে ডালের উল্লেখ পাওয়া গেলেও নীহাররঞ্জন রায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, 'প্রাচীন বাঙালীর খাদ্য তালিকায় ডালের উল্লেখ কোথাও দেখিতেছি না।'

তবে প্রশ্ন জাগে, ডাল না থাকলে ডালেচালে মেশানো খিচুড়ি হলো কি করে? অবশ্য, ডাল মধ্যপ্রাচ্য থেকে এ অঞ্চলে এসেছে বলে অনেকে মত দেন। সে হিসেবে ডাল এ অঞ্চলের খাবার নাও হতে পারে। তবে এর আগমন যে অনেক আগেই হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।     

যাইহোক, বিখ্যাতজনদের লেখায় বিশেষ এই খাবারের বর্ণনা রয়েছে ভুরিভুরি। আলবেরুনি তার 'ভারততত্ত্ব'-তে যেমন খিচুড়ি প্রসঙ্গ এড়াননি তেমনি এড়িয়ে যাননি 'মনসামঙ্গল' কাব্যের স্রষ্টা বিজয়গুপ্তও। মনসামঙ্গল কাব্যমতে, পার্বতীকে ডাবের জল দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি রান্নার ফরমায়েশ করছেন শিব। বিজয়গুপ্ত লিখেছেন 'আদা কাসন্দা দিয়া করিবা খিচুড়ি'। 

ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত

শোনা যায় মোগল আমলেও খিচুড়ির প্রচলন ছিল। হুমায়ুনকে তার বেগম হামিদা খিচুড়ি তৈরি করে খাওয়াতো বলেও শোনা যায়। মুগল আমল কিংবা তার আগে হোক বা পরে— সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও এটি নিশ্চিত যে এর সাথে বাঙালীর পরিচয় বেশ পুরোনো।

বৃষ্টি এলে তাই বোধহয় বাঙালিরা খিচুড়ির চাহিদাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না— পারি না আমিও। এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় খিচুড়ির তালাশে পুরান ঢাকায় গেলাম। ভাবলাম খিচুড়ি বিক্রি করে এমন কোন দোকান চোখের সামনে পড়লেই ঢুকে পড়ব নতুবা আগের সেসব রেস্টুরেন্টই ভরসা। রিকশা করে বৃষ্টির দিনে পুরান ঢাকায় যাওয়া বেশ সাহসের কাজও বটে। খানাখন্দে কখন রিকশা উল্টে যায়, কে জানে!    

যাইহোক, যেই ভাবা সেই কাজ। রিকশায় চড়ে বসলাম, চালককে বললাম পুরান ঢাকার দিকে ঘোরাবেন। যেখানে খিচুড়ির দোকান পাবেন, থামবেন– সে পর্যন্তই যাব। পুরান ঢাকার আবুল হাসনাত রোডে গিয়ে থামলেন রিকশা চালক। বললেন, এখানে একটা দোকান আছে। কোনমতে গিয়ে দোকানের ভেতর উঠলাম– দেখি ব্যস্ত হাতে কাজ চালাচ্ছেন খাবার পরিবেশকরা। 

অর্ডার করতেই হাসিমুখে এক পরিবেশক বললেন, 'আপনারা একেবারে শেষের খাবারটা পাবেন। আজকে বৃষ্টির কারণে আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। শুধু 'স্পেশাল লেগ পিস ফুল খিচুড়ি' বাকি আছে।' সেটিই নিয়ে আসতে বললাম। ঘড়ির দিকে খেয়াল করে দেখলাম মাত্র সাড়ে আটটা বাজে। দাম ছিল ৩৭০ টাকা। 

খাবার আসলো মিনিট পাঁচ পরেই। গরম গরম খিচুড়ির ঘ্রাণ মাতোয়ারা করে তুলল। তর সইছিলো না দুজনের কারোরই— হাত ধুয়ে পেটপুজোয় লেগে পড়লাম। 

ছবি- আফছার মুন্না/ টিবিএস

খাবারের উপরে মুগ ডালগুলো দেখতে বেশ আকর্ষণীয় লাগছিল। লোকগবেষণা করে বের করলাম, অর্ধেক চাল আর বাকিটা ডালসহ বাকিসব উপকরণ। তার উপরে সালাদ নিয়ে এক লোকমা মুখে তুললাম। এবারে ঘ্রাণটা একেবারে গৌণ হয়ে উঠল— মনে হল স্বাদের জন্য বারবার আসা যায়। খিচুড়িতে ঢাকা মাংসের টুকরো বের করে আনতে গেলাম– ধরে তোলার চেষ্টা করা মাত্রই হাড় থেকে খাসির মাংসের টুকরো আলাদা হয়ে গেল। হাড়টাই থেকে গেল হাতে। একটু মাংস তুলে নিয়ে মুখে দিতেই মোলায়েম সেই মাংস গলে যেতে থাকল। 

খিচুড়িতে যেন কিছুর কমতি থেকে গেল! ঠিক সেসময়ে ওয়েটার এসে আপেল আকৃতির বক্সটির দিকে ইশারা করে বললেন, 'আচার দিয়ে ট্রাই করতে পারেন। ভালো লাগবে আশা করি।' বক্সের ঢাকনা তুলতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। জলপাইয়ের আচার তুলে নিলাম বেশ কিছু— এবারে পারফেক্ট। 

শামসের আলীর ভুনা খিচুড়ি, আচার আর বাইরে ঝুম বৃষ্টি— এর চেয়ে ভালো কম্বিনেশন মনে হয় আর হয় না।  

৩৭০ টাকার এই প্লেট ছাড়াও পরিমাণ অনুযায়ী আরও দুই প্যাকেজে বিক্রি হয় এই খিচুড়ি। ২৫০ টাকায় রেগুলার চাপের মাংস ফুল প্লেট, ২৯০ টাকায় প্রিমিয়াম রানের চাকা মাংস ফুল, আর ৩০০ টাকায় পাওয়া যায় 'বাই ওয়ান গেট ওয়ান' অফার। 

দুপুর ১টা থেকেই খিচুরির পসরা সাজিয়ে বসতে শুরু করেন তারা, রাত ৮টা পর্যন্ত চলে বিক্রি। তবে বৃষ্টির দিনে আবার ৫/৬টার পর গেলেই আর পাওয়া যায় না। 

প্রশংসা মিলেছে গুণীদের কাছেও 

ছবি- টিবিএস

খাওয়া শেষে দোকানের দেয়ালের দিকে চোখ ঘোরাতে লাগলাম। দেখা মিলল অনেকগুলো পেপার কাটিংয়ের। সেখানের একটিতে লেখা, 'মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমার রান্না খেয়ে প্রশংসা করেছেন শুনে ভালো লাগলো'। সেই লেখার সূত্র ধরেই কথা শুরু শামসের আলীর সাথে। 

গত কয়েক বছর আগে ডিএমপি লালবাগ জোনের তৎকালীন ডিসি হারুন অর রশীদ (পিপিএম বার) তাকে বললেন, 'শামসের আলী, এমন কিছু ঢাকাইয়া খাবার রান্না করুন, যা খেয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি চমকিত হবেন।' শুনে তো শামসের খুবই আনন্দিত, আবার ভয়ও কাজ করছিল তার মধ্যে। রাষ্ট্রপতি তার রান্না খাবেন, যদি তৃপ্তি না পান! 

ভয়ে ভয়ে ডিসিকে বললেন- 'স্যার পারবো তো!' ডিসিও সাহস দিলেন শামসেরকে।

শামসেরের ভাষায়, "আল্লার নাম নিয়ে রান্না শুরু করলাম। মন-প্রাণ উজাড় করে রান্না করলাম বিখ্যাত সব ঢাকাইয়া খাবার নুইনার শাক দিয়ে গরুর গোস্ত, আনারস, পাকা আমড়া ইত্যাদি দিয়ে গরুর গোস্তের নানা পদ। সাথে ছিল খিচুড়িও। এরপর কয়েকদিন বেশ ভয়ে ভয়েই ছিলাম, কি জানি কি আছে কপালে! একদিন ডিসি স্যার তার অফিসে ডেকে বললেন- 'আরে শামসের মিয়া আপনি তো কামাল করে দিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনার হাতের রান্না তৃপ্তি সহকারে খেয়েছেন।' মহামান্য রাষ্ট্রপতি খাবারের প্রশংসা করেছেন শুনে প্রচন্ড ভালো লেগেছিলো।" 

শুধু রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদই নন, দেশের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমলা, রাজনৈতিক ও চিন্তকরা এ খাবার খেয়েছেন। বিখ্যাতদের সাথে তোলা ছবিগুলো শোভা পেয়েছে তার সেই দোকানের দেয়ালে।  

যেভাবে রান্নার শুরু

ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত

শামসের আলীর তরুণ বয়সের একটা বড় অংশ কেটেছে প্রবাসে। ১৯৯৭ সালে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন লক্ষ্মীর ভান্ডারের খোঁজে, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। তবে এইসময়ে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল এক ভারতীয়ের সাথে। পেশায় সেই ভারতীয় ছিলেন একজন রন্ধনশিল্পী— অন্যান্য খাবার ছাপিয়ে তার তৈরি মাটন ভুনা খিচুড়ির প্রশংসা ছিল সেখানকার মানুষের মুখে মুখে। একদিন শামসের তার বন্ধুর কাছে এই বিখ্যাত খাবারের পাঁচন প্রক্রিয়া জানতে আবদার করে বসলেন। বন্ধুর আবদার অগ্রাহ্য করতে পারেননি সেই ভারতীয়, শিখিয়ে দিয়েছেন মাটন খিচুড়ি রান্নার পুরো প্রক্রিয়াই।   

এর পরও বেশ কিছুদিন প্রবাসে কাটে শামসেরের। তখন সময় পেলে নিজের জন্য রান্না করতেন এই, খাইয়েছেন বন্ধুদেরও। নিজের জন্য রান্না করতেন প্রবাসে, বন্ধুদেরও খাইয়েছেন রান্না করে। প্রশংসা কুড়িয়েছেন সেখানেও। দেশে ফিরে ঠিক করলেন তার সেই খিচুড়ির রান্নার হাতকে কাজে লাগাবেন। করলেনও তাই, নিজের কিচেন থেকে যাত্রা শুরু করেন দুই কেজি চালের খিচুড়ি করে। প্রথম দিনেই করলেন বাজিমাত! অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানেই সব শেষ। 

এখনও নিজ হাতেই রান্না করেন এই বিখ্যাত খাবার। আগের মতোই অল্প করে রান্না করার পক্ষপাতি এই পাচক। তার মতে, 'আমি কতটুকু বিক্রি করলাম তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ খেয়ে কতটুকু তৃপ্তি পেল সেই প্রশ্নটি। তাই আমি নিজেই রান্না করি, খুবই কম পরিমাণে।' 

সফলতার দেড় যুগ

২০০৪ সালে যাত্রা শুরু হয় এই দোকানের। এক, দুই বছর করে সময় যেতে থাকল। সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকল জনপ্রিয়তাও। শামসেরের খিচুড়ির নাম ছড়িয়ে পড়ল পুরো ঢাকায়। বৃষ্টি কিংবা ঠান্ডা আবহাওয়াকে উপলক্ষ করে উপভোগ করতে এখানে মানুষ আসে দূর দুরান্ত থেকে। 

সুনাম ধরে রাখার প্রয়াস ছিল সেই শুরু থেকেই- তার ফলও মিলেছে। আঠারো বছরে পদার্পণ করেছে শামসেরের খিচুড়ি। মানুষ খাইয়ে তৃপ্তিও পান এই পাচক। তার ভাষায়, "মানুষ তো অনেকের কাছেই খায় কিন্তু খাবারে তৃপ্তিটাই আসল। এখানে খেয়ে মানুষ যে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে তাতেই তৃপ্তি মেলে আমার।" 

ছবি- টিবিএস

যিনি একবার খেয়েছেন তিনি এখানে বারবার আসেন। এর পেছনের রহস্য জানতে চাইলে শামসের আলী সহজ সরল জবাব দেন। 'আল্লাহর রহমত আর আমার আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই খাবার মানুষের মন জয় করেছে, তাই তারা বারবার আসেন এটি খেতে।' 

মানুষের মন জয় না করলে অবশ্য একটিমাত্র খাবারের আইটেম, খিচুড়ি বিক্রি করে প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে টিকে থাকা অসম্ভবই ছিল। 

শামসেরের সাথে হারিয়ে যাবে এই খাবারও

এই সিক্রেট রেসিপি শিখতে তার যে খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তিনি কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক।

পরিবারের বাইরে কাউকে এ সিক্রেট রেসিপি সম্পর্কে জানাতে নারাজ। সন্তানের বয়স এখনও কম বলে সে সুযোগও অবশ্য নেই তার। তারপরে এই ব্যবসার কী হবে জানতে চাইলে খানিক অভিমান নিয়েই বলেন, 'বন্ধ হয়ে যাবে এই দোকান, তবে যদি ততদিনে আমার সন্তান বড় হয় আমি তাকে শিখিয়ে দিব।'  

এই রেসিপি সম্পর্কে কাউকে জানাতে নারাজ বলেই তিনি এখনও এর কোন শাখাও খোলেননি।

দাম চুকিয়ে রিকশা নিলাম, ফেরার পথে নাম না জানা কোন এক কবির লেখা শ্লোক মাথায় ঘুরছিল। 'বৃষ্টি মানেই পিটারপ্যাটার বৃষ্টি মানে টুপটাপ, বৃষ্টি মানেই মায়ের হাতে ভুনি খিচুড়ির উত্তাপ।'

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.