জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দেশীয় ডেটিং গ্রুপ
ভালোবাসার কোন রূপরেখা হয় না, হয় না গন্ডি বা সীমানা। সময়ের সাথে ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যমে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি পরিবর্তন এসেছে ভালোবাসার মানুষ খুঁজে নেওয়ার তরিকাতে। ভাবুন তো আপনার বাবা-মা আপনার জন্যে জীবনসঙ্গী ঠিক করেছেন যাকে আপনি কোনদিন দেখেননি, কিন্তু আপনি তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। কি অবাক হচ্ছেন! ভাবছেন অসম্ভব! যাকে চিনি না জানি না- তাকে বিয়ে করবো কীভাবে! দুই দশক আগেও এইরকম বিয়ের ঘটনা প্রচুর ঘটতো। সময়ের সাথে বদলেছে সেসব প্রথা ও রীতিনীতি। বর্তমানে প্রযুক্তি ও যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তরুণ-তরুণীরা নিজেরাই খুঁজে নিচ্ছেন নিজেদের জীবনসঙ্গী।
প্রেমপত্র আদান-প্রদান ও চিঠির যুগের কথা মনে পড়ে কি? যখন ডাকপিয়ন হাঁকডাক দিয়ে বলতো "চিঠি আছে চিঠি"। সেসময় যোগাযোগ থেকে শুরু করে প্রেয়সীকে প্রেম নিবেদন- সবকিছুই চলতো চিঠির মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া বাসু চ্যাটার্জির বিখ্যাত সিনেমা 'হঠাৎ বৃষ্টি'-তে চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে প্রেমের দৃশ্যকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেখানে অপরিচিত দুজন মানুষ একে অপরকে ভালোবাসা থেকে খুঁজে পাওয়া সবকিছুই ঘটে চিঠির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এখনকার প্রেমিক যুগলের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য আছে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামের মতো একাধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেখানে সেকেন্ডের মধ্যে মনের বার্তা পৌঁছে যায় ভালোবাসার মানুষটির নিকট। কেউ আর তীর্থের কাকের মতো চিঠির পথ চেয়ে দীর্ঘ অপেক্ষা করে না।
বিশ্বব্যাপী ডেটিং সাইট টিন্ডার, বাম্বল, তানতান এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও বাংলাদেশের তরুণদের এসবে বিচরণ কম। অ্যাকাউন্ট খোলা, তথ্য পূরণ, কনফিগারেশনের ঝক্কির জন্যে অনেকেই এই সাইটগুলো ব্যবহার করতে পারেন না। তবে তরুণদের একটা বড় অংশ সামাজিক মাধ্যমে সরব। এই মাধ্যমগুলোকেই তারা বেছে নিচ্ছেন নিজেদের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেতে। ফেসবুকে গ্রুপ খুলে অপরিচিত তরুণ-তরুণীরা একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছে। কেউবা সেখান থেকেই ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে বাঁধছেন গাঁটছড়া।
অনলাইন গ্রুপে মিলবে মনের মানুষের সন্ধান
করোনায় ঘরবন্দী সময় একাকীত্ব কাটাতে একজন সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা কতোখানি, তা যেন তীব্রভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলো। প্রেমিকাহীন জীবনে সঙ্গী খুঁজতে মজার ছলে মেহেদী হাসান ইমন নামের এক তরুণ ২০২০ সালে ফেসবুকে একটি ডেটিং গ্রুপ খোলেন। গ্রুপের নাম দেন- 'দ্য পার্ফেক্ট ম্যাচ' অর্থাৎ মনের মতো সঙ্গী। প্রথমদিকে পরিচিত ও বন্ধুরা মিলে গ্রুপে নিয়মিত আড্ডা দেওয়া শুরু করে। যেখানে তাদের সংখ্যা ছিল ১৫ জন। একে অপরের পরিচিত বন্ধুদের গ্রুপটিতে 'ইনভাইট' রিকুয়েস্ট দেওয়ায় ধীরে ধীরে গ্রুপে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময় গ্রুপটি অপরিচিত ছেলেমেয়েদের কাছেও জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। এভাবেই চলতে চলতে বর্তমানে গ্রুপটির সদস্য দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজারের ওপর। যাদের সকলেই তরুণ ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
মজার ছলে ডেটিং গ্রুপ খোলা ইমন নিজের মনের মানুষটিকে এই গ্রুপ থেকেই খুঁজে পেয়েছেন। ২০২১ সালে গাঁটছড়া বেঁধেছেন তার সেই প্রেয়সীর সঙ্গে। গ্রুপের আরেকজন এডমিন শম্পা আহমেদ রিয়া। শম্পাও গ্রুপ থেকে নিজের মনের মানুষের সাথে প্রণয় থেকে বিয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছেন । আরও একাধিক ব্যক্তিরা পেয়েছেন নিজেদের ভালোবাসার মানুষ।
মনের লেনদেন বনে যাওয়ায় সামনে আরও যারা বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছেন তাদের একজন প্রজ্ঞা।
বন্ধুত্ব থেকে প্রণয় ও বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রজ্ঞা বলেন, "আমাদের গ্রুপের প্রত্যেকে এখন একে-অপরের সাথে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রথমদিকে আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না। গ্রুপের সবাই মিলে আমরা রাতভর আড্ডা, গল্প ও কথা বলি। মাঝেমধ্যে আমরা গ্রুপের সদস্যরা দেখাও করি। এভাবেই পাঁচ মাস আগে আশিক ও আমার মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। একসময় বন্ধুত্ব থেকে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা জন্মে, আর সেখান থেকে আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। এখন সে আমার বাগদত্ত। খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করবো।"
গ্রুপের নিয়ম অনুযায়ী ইচ্ছুক সদস্যরা নিজেদের ছবিসহ বৃত্তান্ত পরিচয় লিখে পোস্ট করেন। সেখান থেকে বাকিরা তাদের সম্পর্কে জানতে পারেন। এবং ভালো লাগলে সেই ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী, অপর ব্যক্তি আগ্রহী না হলে মেসেজ দিয়ে বিরক্ত করা যাবে না। কেউ বিরক্ত বোধ করলে তা জানানো হয় গ্রুপ মডারেটরদের নিকট। মডারেটররা অভিযুক্ত ব্যক্তির অভিযোগ প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রুপ থেকে বের করে দেন, বা তার অ্যাকাউন্টটি ব্লক করে দেন। তাই ডেটিং এই গ্রুপটি মেয়েদের জন্যে নিরাপদ প্লাটফর্ম। যারা বন্ধুত্ব গড়তে ও অন্যদের কে ভালোভাবে জেনে নিতে চান, তারা যুক্ত হয়ে যান ম্যসেঞ্জার গ্রুপে। গ্রুপের সদস্যদের নিয়ে কয়েকটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। যেখানে চলে রাতভর আড্ডা, গল্প ও গান। এ পর্যন্ত গ্রুপ থেকে প্রেমে জড়িয়ে যারা বিয়ে করেছেন, তাদেরকে গ্রুপের সদস্যদের পক্ষ থেকে বিয়েতে পাঠানো হয়েছে শুভেচ্ছা উপহার। এ যেন অচেনা দুজন মানুষের চির আপন হয়ে উঠার নতুন এক অধ্যায়ের শুরু।
ডেটিং গ্রুপে কি সবাই-ই ভালোবাসার মানুষ খুঁজতে আসে? এই কথার উত্তর জানালেন গ্রুপের আরেকজন সক্রিয় সদস্য মারজানা (ছদ্মনাম)। তিনি নিজেও গ্রুপ থেকে মনের মানুষের খোঁজ পেয়েছিলেন। তারপর প্রেম করে নিজেরা বিয়েও করেছিলেন। কিন্তু সে ভালবাসা যেন পরিণতি পেয়েও হারিয়ে গেল। বিয়ের মাত্র তিনদিনের মাথায় সদ্য বিয়ে করা স্বামীকে সড়ক দুর্ঘটনায় হারান। এরপর হতাশা ও মানসিক চাপে ভেঙে পড়েছিলেন মারজানা। এই গ্রুপের অন্য সদস্যরা তখন পাশে দাঁড়ান মারজানের। রাতভর গ্রুপের আড্ডা, গল্পে নিজের হতাশা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছেন মারজান।
তিনি বলেন, "গ্রুপের কারও সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না, কিন্তু এই মানুষগুলো এখন আমার কাছের মানুষ। আমার খারাপ সময়ে এই মানুষগুলো আমার জীবনে বড় ছাপ রেখেছে। এখন আমি সুস্থ- স্বাভাবিক আছি এই গ্রুপের সদস্যদের জন্যই। এটা ডেটিং ও কাপল গ্রুপ হলেও এখান থেকে আমি ভাই, বন্ধু, বোন খুঁজে পেয়েছি। যারা এখনো আমাকে আগলে রেখেছে।"
করোনার সময় 'Subtle Elish Dating' নামে আরও একটি ফেসবুক ডেটিং গ্রুপ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। গ্রুপটিতে ছেলে-মেয়েরা নিজেদের পরিচয় বিবরণ দিয়ে পোস্ট করতো। পোস্টকারী ব্যক্তির কী ভালো লাগে? কী করতে পছন্দ করে? এমনকি বদঅভ্যাস ও নেতিবাচক দিকসহ সবকিছুর উল্লেখ থাকতো নিজেদের পরিচয় পর্বের পোস্টে। ফেসবুকে এই গ্রুপটি এখনো আছে, কিন্তু আগের মতো সক্রিয় অবস্থায় নেই।
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা ডেটিং গ্রুপ
বিভিন্ন ধর্মের মানুষরা নিজেদের সঙ্গী খুঁজে নিতে ফেসবুকে আলাদা আলাদা ডেটিং গ্রুপ খুলেছেন। যেমন আমাদের দেশে মুসলিম ছেলেমেয়েদের ভিড়ে একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির নিজের সঙ্গী খুঁজে নেওয়ার ব্যাপারটা একটু জটিল। কিন্তু যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে সেটিও সম্ভব হয়ে উঠেছে। Subtle Hindu couple matching (হিন্দু জোড়ি ম্যাচিং) ও Hindu couple matching platform (HCMP) নামের ফেসবুকে দুটি প্রাইভেট গ্রুপ রয়েছে। যেখানে সদস্য সংখ্যা যথাক্রমে ৩৫ হাজার ও অন্যটিতে ১২ হাজারের অধিক। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের মনের মতো সঙ্গী পাওয়ার জন্যে এই গ্রুপগুলো খুলেছেন। এখানে ছেলেমেয়েদের ছবিসহ বৃত্তান্ত পোস্ট করা হয়।
আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। তাইতো জীবনসঙ্গী খুঁজে নিতে অভিভাবক ও আশেপাশের চেনাজানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই কেউ। ডেটিং সাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো প্রেম, বিয়ের মতো কঠিন ব্যাপারগুলোকে সহজ করে তুলেছে। কিন্তু সম্পর্কে জড়ানোর পূর্বে ও বড় কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কেননা অনেকেই অনলাইনে ভুয়া পরিচয় ধারণ করে। তাই মনের মানুষটিকে চিনে নিতে হবে নিখুঁতভাবে।