ভারতবর্ষের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় চায়ের অন্ধকার ইতিহাস
ফিচার
সারা বিশ্বে, বিশেষ করে উপমহাদেশে তুমুল জনপ্রিয় পানীয় চা। বিশ্ব অর্থনীতির আন্তর্জাতিকায়নের পেছনের অন্যতম ইঞ্জিন চা—এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না।
চা-কে কেন্দ্র করে যুদ্ধও বেধেছে; জমজমাট হয়েছে ক্রীতদাস ও মাদক ব্যবসা।
বিশ্বব্যাপী কফিকে জনপ্রিয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ভারতীয় উপমহাদেশ।
চা শব্দটি এসেছে মান্দারিন ভাষা থেকে। পানীয়টির জন্মও চীনে।
কয়েক হাজার বছর ধরেই চীনে চা পান হচ্ছিল। ১৭ শতকের প্রথম দিকে ডাচ বণিকরা দূর প্রাচ্য থেকে প্রথম যেব পণ্য নিয়ে যেত, তার মধ্যে চা-ও ছিল।
পানীয়টি খুব শিগগিরই প্রথমে ওষুধ, তারপর নতুন খাবার হিসেবে ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
পরের এক দশকে এই সুগন্ধি কিন্তু তেতো স্বাদের পানীয়টির জনপ্রিয়তা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয়। তবে ওই সময় দুর্লভ এই পানীয়টির স্বাদ চাখার সৌভাগ্য কেবল অভিজাতদেরই হতো।
স্প্যানিশ ও পর্তুগিজরা আখ পরিচিত না করালে চা সমাজের উঁচুতলাতেই আটকে থাকত।
যিশু খ্রিষ্টের আমলে ভারতীয়রা সর্বপ্রথম চিনির কেলাস বানায়।
এশিয়ায় সহস্র বছর ধরে জন্মানো মিষ্টি ঘাসের কাণ্ড চিপে রস বের করে সেটি দিয়ে চিনির কেলাস বানাত।
কিন্তু আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে বড় আকারে আখের চাষ শুরু হওয়ার পরই কেবল বড় পরিসরে চিনি উৎপাদন আরম্ভ হয়। আর এই আখ চাষ সফল হয়েছিল আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা ক্রীতদাসদের ঘাম ও অমানুষিক পরিশ্রমের সুবাদে।
এর পরই প্রথমবারের মতো চিনি ইউরোপজুড়ে সহজলভ্য ও সস্তা হয়ে ওঠে।
কিন্তু নতুন এই পণ্য খাওয়া হবে কী করে?
কোথাও কেউ একজনের মাথায় প্রথম এক কাপ চায়ে এক-দুই চামচ চিনি মিশিয়ে দেওয়ার বুদ্ধি আসে।
তারপর চায়ের সঙ্গে দুধ যোগ করার চলও চালু হয়।
তারপর হুট করেই একদিন যে পানীয়টি সমঝদারদের উপভোগের জিনিস ছিল, সেটি চলে এল সবার হাতের নাগালে।
এর ফলে চা, চিনি দুটোর জনপ্রিয়তাই তুঙ্গে ওঠে। আর এর ফলে তৈরি হয় ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়।
আফিম যুদ্ধকে চা যুদ্ধও বলা যেতে পারে। কারণ ১৮ শতকে চা শুধু চীনে জন্মাত।
ব্রিটেন প্রচুর পরিমাণে চা কিনছিল। ওই সময় ব্রিটিশরা চীন থেকে সিল্ক ও চীনামাটির চেয়েও চা বেশি কিনত।
খাদ্যবিষয়ক ইতিহাসবিদ এরিকা র্যাপোর্ট তার 'এ থার্স্ট ফর এমপায়ার: হাউ টি শেপড মডার্ন ওয়ার্ল্ড' বইয়ে লিখেছেন, ১৮৩০ সালের দিকে ব্রিটিশরা প্রতি বছরে প্রায় ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড চা পান করত। এই চা আসত মূলত চীন থেকে।
কিন্তু চা আমদানিতে ব্রিটেনের একচেটিয়া আধিপত্য পছন্দ হয়নি আরেক ব্রিটিশ উপনিবেশ আমেরিকার।
তাছাড়া ব্রিটিশদের তা-তৃষ্ণায় দেউলিয়া হতে বসেছিল গোটা জাতি। কারণ ব্রিটিশরা চা কিনত সোনা ও রুপায়। এতে ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়।
এতদিন চীনের সঙ্গে চা বাণিজ্যে একচেটিয়া রাজত্ব ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। তারা বাণিজ্য ঘাটতি মেটাবার জন্য ভারতবর্ষ থেকে চীনে আফিম রপ্তানি শুরু করে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার আফিম বাজারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। কৃষকদের আফিম উৎপাদন বাড়াতে উত্সাহ দেয়। চাষের নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে।
কিন্তু ১৮৩৯ সালে নেশাগ্রস্ত যুবসমাজ ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে চীনা শাসকরা আফিম আমদানি নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবৈধভাবে চীনে আফিম পাচার চালিয়ে যায়।
চীনের সম্রাট প্রতিবাদ করলেও ব্রিটিশরা তাতে কান দেয়নি। অবশেষে তিনি ২০ হাজার চেস্ট আফিম বাজেয়াপ্ত করার পরই ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যায়। এ নিয়ে চীন ও ব্রিটেন দুবার যুদ্ধে জড়ায়, ইতিহাসে যা আফিম যুদ্ধ নামে পরিচিত।
প্রথম যুদ্ধে ব্রিটিশরা যেতে। এই পরাজয়ের জেরে চীনারা ব্রিটিশদের কাছে বাণিজ্যের জন্য (আফিম বাণিজ্যসহ) বন্দর উন্মুক্ত করে দিতে এবং হংকং দ্বীপ ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়।
এদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় কর্তারা চায়ের বাজারের ভবিষ্যৎ বাধাবিঘ্ন এড়ানোর জন্য পরিকল্পনা তৈরি করছিলেন।
আর এ কাজের জন্য উপযুক্ত জায়গা ছিল ভারত।
১৮৩০-এর দশকে চীন থেকে আনা চা গাছ ব্যবহার করে ভারতের আসাম রাজ্যে প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়।
চিনির (আখ) মতোই, চা চাষও অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কাজ। আর এ কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল ক্রীতদাস।
কিন্তু ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করা হয়।
তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধূর্ত কর্তারা এবার বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করার মিশনে নামলেন। এবং সেই মিশনে তারা সফলও হলেন।
ক্রীতদাসদের বদলে চা বাগানগুলো চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক—চুক্তিতে স্বাক্ষর করা মুক্ত নারী-পুরুষ—ব্যবহার করত। স্বাক্ষর করা চুক্তির জন্য তারা একটি নির্দিষ্ট সময় জন্য কাজ করতে বাধ্য হয়।
চা বাগানে কাজ করার জন্য দালাল শ্রেণির লোকজন উড়িষ্যা, অন্ধপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিম বঙ্গ ও উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে আনে। সমাজের বঞ্চিত, লাঞ্ছিত নিম্নবর্গের এই মানুষদের চা বাগানে কাজ করতে আনা হয় নানা প্রলোভন দেখিয়ে। এই মানুষগুলো সপরিবারে চা বাগানগুলোতে এসে বুঝতে পারে যে তাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু ইংরেজ সাহেব ও তাদের দোসররা নানা কৌশলের মারপ্যাঁচে এই মানুষগুলোকে চা বাগানে আটকে ফেলে।
এই শ্রমিকদের অবস্থা কিন্তু কোনো কালেই ক্রীতদাসদের চেয়ে খুব একটা ভালো ছিল না। ব্রিটিশ আমলে চা শ্রমিকদের বলা হতো 'কুলি'।
চা শ্রমিকরা সেই তখন থেকেই বঞ্চিত, নিপীড়িত। ক্রীতদাসের মতোই কাটে তাদের জীবন। অধিকার আদায়ের জন্য তারা বহুবার তারা আন্দোলনে নামলেও লাভের লাভ হয়নি কিছুই।
যেমন ১৯২১ সালে মুলুক ফিরে চলা আন্দোলন শুরু করেন চা শ্রমিকরা। ওই বছরের ২১ মে সিলেট অঞ্চলের ৩০ হাজার শ্রমিক বিক্ষোভ নিজ এলাকায় ফেরার উদ্যোগ নেন।
কিন্তু চা শিল্পের মালিকদের সঙ্গে আঁতাত করে রেল দপ্তর শ্রমিকদের টিকিট দেওয়া বন্ধ করে দেয়। অগত্যা শ্রমিকরা হেঁটেই চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটের পানে রওনা। কিন্তু তাদের ওপর চলে গুলি। প্রাণ হারান শত শত শ্রমিক, আহত হন হাজার হাজার।
কেউ কেউ পালিয়ে যেতে পারলেও বাকি শ্রমিকদের ধরে নিয়ে ফের চা বাগানে ক্রীতদাসের মতো কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
কিন্তু এত শত আন্দোলনেও পরিবর্তন আসেনি চা শ্রমিকদের জীবনে। তাদের দৈনিক মজুরি এখন মাত্র ১২০ টাকা। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে এই টাকায় চা শ্রমিকদের কাটাতে হয় মানবেতর জীবন। দৈনিক মজুরি ন্যূনতম ৩০০ টাকা করার জন্য তাদের নামতে হয় আন্দোলন, ধর্মঘটে। অথচ দেশে অন্যান্য খাতের দিনমজুরদের দৈনিক গড় মজুরি এর কয়েক গুণ।
তাই মাঝেমধ্যে ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দেওয়ার সময় আমাদের স্মরণ করা উচিত সেইসব বঞ্চিত, নিপীড়িত শ্রমিকদের কথা যাদের রক্ত, ঘাম লেগে রয়েছে এই পানীয়তে।
- সূত্র: বিবিসি
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.