ডিম কেন দুনিয়াজুড়ে আমিষের সস্তা উৎস, বাংলাদেশে কেন দাম বেড়েই চলেছে?

ফিচার

টিবিএস রিপোর্ট 
16 August, 2022, 07:15 pm
Last modified: 16 August, 2022, 08:53 pm
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০২০ সালের তথ্যানুসারে, প্রতিবছর বাংলাদেশিরা মাথাপিছু ১০৪.২৩টি ডিম খান। সংস্থাটির মতে, সুস্বাস্থ্যের জন্য বছরে অন্তত ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ, গড় হিসাবে নিচের দিকেই ছিল বাংলাদেশিদের ভোগের পরিমাণ। মূল্যস্ফীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে তা আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে...

দুনিয়াজুড়ে আমিষের সস্তা উৎস বলে সুখ্যাতি আছে ডিমের। তাই ভূগোলকের প্রায় সর্বত্র গোল ডিমেরই রাজত্ব। স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের অন্যতম উৎস এটি। বাংলাদেশেও নিম্ন আর সীমিত আয়ের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে পোল্ট্রি পণ্যটির অবদান আছে। 

কিন্তু, দেশে গত বছরের ৪ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত দুই দফায় বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। এতে বেড়ে গেছে দ্রব্যমূল্য। বিশ্ববাজারে কৃষিপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং দেশে ডলার সংকটও এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।  

সরকারি সংস্থা- ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা ধরে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত নভেম্বর থেকে মোটা চালের দাম ১৪%, মসুর ডাল ২৩%, খোলা সয়াবিন ১৯%, ডিম ৪৫%, ব্রয়লার মুরগি ১৮%, আটা এক প্যাকেট ৩৮%, চিনি ১৩%, শুকনা মরিচ ৭৫%, আলু ২০%, হলুদ ১৩% এবং দেশী আদার দাম ১৭ শতাংশ বেড়েছে। 

মূল্যস্ফীতির এই চাপে দেশের স্বল্প আয়ের মানুষের প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ কমবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। 

টিসিবির তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৫ আগস্ট তেলের দাম বৃদ্ধির পর গত দুই সপ্তাহের মধ্যে ডিম ৩১%, ব্রয়লার মুরগি ২৯%, পেয়াজ ২৫%, আটা ১০%, চিনি ১০%, শুকনা মরিচ ৯% ও মোটা চালের দাম ৪ শতাংশ বেড়েছে।

তবে বাজারে এসব পণ্যের প্রকৃত দাম টিসিবির দেওয়া হিসাবের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন ঢাকার প্রায় সব বাজারের ব্যবসায়ীরা।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০২০ সালের তথ্যানুসারে, প্রতিবছর বাংলাদেশিরা মাথাপিছু ১০৪.২৩টি ডিম খান।

সংস্থাটির মতে, সুস্বাস্থ্যের জন্য বছরে অন্তত ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ, গড় হিসাবে নিচের দিকেই ছিল বাংলাদেশিদের ভোগের পরিমাণ। মূল্যস্ফীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মাথাপিছু ডিম খাওয়ায় এগিয়ে যেসব দেশ:

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ডিম খাওয়া হয় মেক্সিকোতে। দেশটির জাতীয় পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের ২০২১ সালের তথ্যানুসারে, ওই বছরে মাথাপিছু ৪০৯টি করে ডিম খেয়েছেন মেক্সিকানরা। 

এক্ষেত্রে জাপানকে ছাড়িয়ে গেছে দেশটি। জাপানে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার বার্ষিক পরিমাণ ৩৩৭টি। এরপরে রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ কলম্বিয়া। সেখানে এই হার ৩৩৪। 

মহামারির পর মেক্সিকোতে মাংসের দাম অনেকটাই বেড়ে গেলে, ডিম খেতে বেশি ঝুঁকে পড়ে সীমিত আয়ের জনগোষ্ঠী। অবশ্য মহামারির আগেও দেশটি এদিক থেকে এগিয়ে ছিল। 

২০২১ সালে মেক্সিকোতে মুরগি ও অন্যান্য পালিত পাখি অন্তত ৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ২২ লাখে। ২০১৭ সালের পর থেকে বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ হারে। সে তুলনায় দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। 

চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকায়, ডিম আমদানিতেও উপরের দিকে অবস্থান মেক্সিকোর। সংশ্লিষ্ট শিল্পের গণমাধ্যম পোল্ট্রি ওয়ার্ল্ড- এর একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, মহামারির আগে ২০১৯ সালে মেক্সিকো মোট ২০ হাজার টন ডিম আমদানি করেছিল। 

ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভ্যিউ সাইটের তথ্যানুযায়ী, জাপানের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৩৯ লাখ। মুরগির মাংস ও ডিম জাপানিদের অন্যতম প্রধান খাদ্য। পরিসংখ্যান সাইট স্ট্যাটিসটা সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে জাপানে মোট ৭৫ কোটি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদিত হয়েছে। 

ডিম উৎপাদনেও শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে জাপান। স্থানীয় উৎপাদনের ৫০ শতাংশ করে বড় কয়েকটি কোম্পানি। জাপানে গত এক দশকে ডিম দেওয়া (লেয়ার) মুরগির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমেছে, কিন্তু বেড়েছে উৎপাদন। আধুনিক প্রযুক্তি আর পালন পদ্ধতির মাধ্যমে এই অর্জন করেছে জাপান।

জাপান বিপুল পরিমাণে ডিম ও মুরগির মাংস আমদানিও করে। ট্রেডিং ইকোনমিক্স সাইট জাপানের শুল্ক বিভাগের বরাতে জানিয়েছে, ২০২২ সালের জুন মাসে ১৯ হাজার ৬৪৪ মিলিয়ন জাপানি ইয়েন সমমূল্যে ডেইরি পণ্য ও ডিম আমদানি করেছে জাপান। মে মাসে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮ হাজার মিলিয়ন ইয়েন।  

শীর্ষ উৎপাদক ৫ দেশ

চীন 

এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের রয়েছে ডিমের বিপুল চাহিদা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০২০ সালের পরিসংখ্যানে জানাচ্ছে, ডিম উৎপাদনে এ সময় শীর্ষ দেশ ছিল চীন। দেশটিতে বার্ষিক প্রায় ৪৬৬ বিলিয়ন ডিম উৎপাদিত হয়। প্রধান প্রধান উৎপাদন অঞ্চল হলো- হেনান, শ্যানডং, হেবেই, লিওনিং ও জিয়াংশু প্রদেশ। 

যুক্তরাষ্ট্র

তারপরেই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটিতে বার্ষিক ডিম উৎপাদন ১০৯ বিলিয়ন পিস। প্রধান উৎপাদক রাজ্যগুলি হলো- ইন্ডিয়ানা, পেনিসিলভানিয়া, আইওয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়া।  

ভারত

উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রতিবেশী ভারত। দেশটিতে বছরে ৯৫ বিলিয়ন ডিম উৎপাদিত হয়। প্রধান উৎপাদন অঞ্চল- অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু, হরিয়ানা ও পাঞ্জাব। 

মেক্সিকো

মেক্সিকোতে বছরে ৫৭ বিলিয়ন পিস ডিম উৎপাদন করা হয়। লাতিন আমেরিকার দেশটির প্রধান উৎপাদন অঞ্চল– ভেরাক্রুজ, টোরিওন, ক্যামপাচে, গুয়ানাহুন্তো এবং ইয়ুকাতান। 

ব্রাজিল

ডিম উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থান ব্রাজিলের। বার্ষিক উৎপাদন ৫৪ বিলিয়ন পিস। প্রধান উৎপাদন অঞ্চল- সাও পাওলো, এস্পিরোতো সান্তো, রিও গ্রান্ডে দো সুল, গোইয়াস, সান্তা কাতারিনা ইত্যাদি। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রাজিলে ডিমের স্থানীয় চাহিদাও বেড়েছে। 

ডিম নিয়ে মজার কিছু তথ্য:

ডিম কেন ডজন ধরে বিক্রি হয়?

বারো সংখ্যার বেশ কিছু ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হলো- যিশুর ঘনিষ্ঠ শিষ্য সংখ্যা হলো ১২। আমেরিকা বারোকে পরিমাপের একক ধরেছে ইংরেজদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ইংল্যান্ডে রানি এলিজাবেথের সময় থেকে ডিম ডজন হিসাবে বিক্রি হতে থাকে। যদিও বারোকে আদর্শ ধরার পেছনের কারণ সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। কবে, কোথায় এটি নির্ধারিত হয়েছিল- তাও অজ্ঞাত।

তবে এখন অনেক দোকানি দাবি করেন, সংখ্যা দিয়ে নয়, ওজন দিয়ে বিক্রি হওয়া উচিত ডিম। কারণ সব ডিমের আকার সমান হয় না। 

ডিমের কালপঞ্জি

খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০০ অব্দ: মুরগি গৃহপালিত হয়। খাবার হিসাবে ডিমের ব্যবহার অবশ্য তারও অনেক আগে থেকেই।  

খ্রিস্টপূর্ব ৭২০০ অব্দ : বনের পাখি পোষ মানানো শুরু।

খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দ: মিশর ও চীনে খাবার হিসাবে ডিমের ব্যবহার ব্যাপক হয়।

খ্রিস্টপূর্ব ১৪২০ অব্দ: মিশরের ফারাও হোরেমহেবের সমাধিতে পাওয়া চিত্র দেখাচ্ছে, এক ব্যক্তি অস্ট্রিচের ডিম উপহার দিতে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ: মুরগি গ্রিসে পৌঁছায়। আগে সেখানে কোয়েল পাখির ডিম বেশি ব্যবহৃত হতো খাবার হিসেবে।

খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ: ইউরোপে মুরগি গৃহপালিত হয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ: মিসর এবং চীন আবিস্কার করে ফেলে গরম মাটির চুলায় ডিম ফোটানোর উপায়। এর ফলে মুরগিকে ডিম ফোটানোর জন্য বসিয়ে রাখতে হলো না- বরং আরো ডিম পারার কাজে নিয়োজিত করা গেল।

আমেরিকায় ডিম উৎপাদন

১৪৯০ খ্রিষ্টাব্দ- কলম্বাস তার দ্বিতীয় যাত্রায় আমেরিকায় মুরগি নিয়ে যান।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ- মার্কিন মুল্লুকের বাড়িগুলোর ব্যাকইয়ার্ডে মুরগির খোয়াড় রাখার ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। তবে সেখান থেকে প্রাপ্ত ডিম পরিবারের চাহিদা মেটাতেই বেশি ব্যবহৃত হতো। উদ্বৃত্ত ডিম কৃষি বাজারে বিক্রি করা হতো।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ- ব্রিটিশ কলম্বিয়ার জোসেফ কয়লে কাগজ থেকে ডিমের কার্টন তৈরির উপায় আবিস্কার করেন।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ- খামার তৈরি হতে থাকে। তবে সেগুলোয় রোগে ভোগার ও  মৃত্যুর হার ছিল উচ্চ। গড়ে একটি মুরগি থেকে বছরে ১৫০টি ডিম পাওয়া যেত।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ- মুরগির খামারে স্বাস্থ্যকর ও শক্তিশালী মুরগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। রোগে ভোগার হার কমতে থাকে।

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ- তারের জালির মেঝে তৈরি হওয়ায় মুরগির খামারগুলোর পরিবেশ ভালো হতে থাকে। আগ্রাসী ও নিরীহভেদে মুরগিগুলো ভাগ করে আলাদা জায়গায় রাখা হতে থাকে। মৃত্যুহার কমে আসে ৫ ভাগে। বছরে একটি মুরগি থেকে ২৪০টি ডিম পাওয়া যেতে থাকে।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ- খামারগুলোতে কনভেয়ার বেল্ট যুক্ত হওয়ায় ডিম সংগ্রহে নতুন মাত্রা যুক্ত হয় আর ডিম পাড়ার পরে তাক পরিচ্ছন্ন করাও সহজ হয়।

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ- বড় বড় খামার তৈরি হতে থাকে। খামারের পরিবেশ অধিক স্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। প্রচুর ডিম উৎপাদিত হতে থাকে একেকটি খামারে। খামারগুলো যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় পরিচালন ব্যয় কমে আসে, ফলে কমে যায় মুরগির ডিমের দামও।

 

 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.