ভারতবর্ষে যখন আরব মুক্তা ব্যবসায়ীদের রমরমা ছিল

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
12 August, 2022, 06:00 pm
Last modified: 12 August, 2022, 07:38 pm
গত শতকে কিছু আরব ব্যবসায়ী ভারতবর্ষে এসে মুক্তা ব্যবসা করে প্রভূত অর্থসম্পদের মালিক বনে যায়। ভারতবর্ষেই থিতু হয় অনেকে। বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যাওয়া আরবরা পরিচিত ছিল তুজ্জার নামে।

মুম্বাইয়ের মোহাম্মদ আলি রোডের ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ সেন্ট্রাল রেস্টুরেন্ট। তবে মাত্র এক শতাব্দী আগেই এটি ছিল বোম্বের আরব সমাজের আড্ডার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

সেন্ট্রাল রেস্টুরেন্ট খোলা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলে। স্থানীয় বিষয়ে গল্পগুজব করার জন্য এখানে জড়ো হতো ওই সময়ের আরব সম্প্রদায়ের লোকজন। এই রেস্তোরাঁয় বসে আরবের বিভিন্ন নগরী থেকে আসা মানুষ সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে আরবি খবর শুনতে পারত।

২০১৭ সালে গবেষক সাইফ আলবাদাউই 'পার্ল মার্চেন্টস অভ দ্য গালফ অ্যান্ড দেয়ার লাইফ ইন বোম্বে' শিরোনামের গবেষণা নিবন্ধে লেখেন, সেন্ট্রাল রেস্টুরেন্ট ছিল সামাজিক ভেনু। সারাদিনের কাজকর্ম সেরে মানুষ এখানে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে আসত। নানা ধরনের খাবার খেত। তবে এখানকার সিংহভাগ খাবারে মরিচ ব্যবহার করা হতো না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওই সময় বোম্বে ছিল আন্তর্জাতিক মুক্তা শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র। তাই আরবের বণিকদের আকর্ষণের কেন্দ্রেও ছিল শহরটি।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা কূটনীতিবিদ তালমিজ আহমেদ ২০১৮ সালে 'মিলি গ্যাজেট'-এ লেখা নিবন্ধে বলেন, 'মুক্তা বাণিজ্যের সুবাদে উপসাগরীয় অঞ্চলের কিছু বড় আরব বণিক পরিবার-পরিজন নিয়ে বোম্বেতে আবাস গাড়েন।'

এসব পরিবারের কেউ কেউ ২০ শতকের প্রথম তিন দশকে প্রভূত অর্থসম্পদের মালিক বনে যায়। তৎকালীন পুনায় ফ্ল্যাট ও সামার ভিলা কেনে। তাদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ সালেম আল-সুদাইরাবি নামে একজন ধনকুবের কুয়েতি সওদাগর। ১৯১৮ সালের একটি ছবিতে দেখা যায়, আল-সুদাইরাবি তার তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে পুনায় নিজের বাড়ির সামনে গাড়িতে বসে আছেন।

মুক্তা বাণিজ্যে মন্দা

যেসব আরব প্রভূত অর্থসম্পদের মালিক হয়েছিল তারা পরিচিত ছিল তুজ্জার নামে। বন্দর নগরীর এই বণিকরা বড় পণ্যের ব্যবসা করত। 

কিন্তু বোম্বেতে সত্যিকার অর্থে ধনকুবের পরিবারগুলো ছিল আরব সম্প্রদায়ের অল্প কিছু পরিবার। শহরের বেশিরভাগ আরবই ছিল ছোট ব্যবসায়ী। তারা জাহাজ থেকে মুক্তা কিনে দক্ষিণ বোম্বের বাজারে বিক্রি করত। কিছু আরব ভারতীয় মুক্তা ব্যবসায়ী ও পশ্চিম এশিয়ার ব্যবসায়ীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী দালাল।

সাফল্যের পাশাপাশি ভারতের অর্থনৈতিক সমস্যা ও আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতার কারণে আরব বণিকদের মুক্তা ব্যবসায় মোটা অঙ্কের অর্থ লোকসান দেয়ার বেশ কিছু নজির রয়েছে। বিশেষ করে ১৯১৩ সালটা খুব খারাপ গিয়েছিল তাদের জন্য। 

ওই বছর ব্যাংকিং সংকটে পড়ে গিয়েছিল ভারত। ক্রেডিট ব্যাংক অভ ইন্ডিয়ার মতো ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হচ্ছিল। আমানতকারীরা তাদের টাকা তুলে নেওয়ার জন্য উন্মত্তের মতো ব্যাংকে ছুটছিল। এই সংকটের প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজার ও মুক্তার বাজার দু-জায়গাতেই। 

১৯১৩ সালের ২৭ অক্টোবর দ্য টাইমস অভ ইন্ডিয়া লেখে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তা রপ্তানিকারী ব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের অর্থ অগ্রিম দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো লোকসান দিচ্ছিল।

ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়, ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা মনে করছিল যে ভারতের মুক্তার দাম অনেক বেশি; তাই তারা মুক্তা কিনছিল না। এর ফলে ব্যাংকগুলো মুক্তা ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধ করতে বললে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়ে যাবে। 

ওই প্রতিবেদনে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়, মুক্তাবাজার পরিস্থিতির উন্নতি হলে ব্যাংকিং খাতের অবস্থাও ভালো হলে। কিন্তু মুক্তাবাজারের পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে শুধু আর্থিকভাবেই নয়, গোটা ভারতীয় বাণিজ্যেই এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

ওই দিনই দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এই সংকটের উপর 'মোর বোম্বে ফেইলিউর' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপে। ওতে বলা হয়, 'এই সংকট চলাকালেই একজন আরব বণিকরা বড় একটি ব্যবসা করতে ব্যর্থ হওয়ায় নতুন ধাক্কা খেলেন। তার দায় ৩ লাখ ডলারের বেশি বলে জানা গেছে।'

মার্কিন সংবাদপত্র যে আরব বণিকের কথা বলেছে, তিনি ছিলেন শেখ আব্দুল রেহমান বিন শেখ আব্দুল আজিজ আল ইব্রাহিম নামে একজন কুয়েতি। তিনি পরিচিত ছিলেন 'মিস্টার লায়ন' নামে। বেশ কয়েকটি ঘোড়ার মালিক ছিলেন তিনি। পুনা ও বোম্বেতের ঘোড়দৌড়ে অংশ নিত সেগুলো। আল ইব্রাহিম তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য আবেদন করেন। আবেদনে এই ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে তার মোটা অঙ্কের ঋণ রয়েছে। মুক্তার দাম পড়ে যাওয়া ও ইউরোপে চাহিদা না থাকার কারণে তিনি এই ঋণ শোধে অক্ষম।

১৯১৩ সালের এক প্রতিবেদনে দ্য টাইমস অভ ইন্ডিয়া বলে, কিছু স্থানীয় ব্যাংক মুক্তার চালানের জন্য প্রচুর পরিমাণে ঋণ দেওয়ায় এ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

বোম্বের ইনসলভেন্সি কোর্টে দায়ের করা আবেদনে চৌপট্টির বাসিন্দা এই কুয়েতি বণিক বলেন, বাজারে তার 'সতেরো লাখ টাকা বা তার বেশি' ঋণ হয়ে গেছে।

আল ইব্রাহিম ছাড়াও বেশ কিছু আরব ও ভারতীয় ক্ষুদ্র মুক্তা ব্যবসায়ী নিজেদের ঋণ পরিশোধে অক্ষম দাবি করে আদালতে যাব।
 
১৯১৩ সালের সংকট

১৯১৩ সালের আর্থিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মুক্তার বাজারের দীর্ঘস্থায়ী মন্দার। ১৯১৮ সাল, অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষতক চলে এই সংকট। এরপর অবশ্য মুক্তার বাজারের অবস্থা ফের ভালোর দিকে যায়। পরের দশকে আরব মুক্তা ব্যবসায়ীরা বোম্বে আসতে থাকে।

আলবাদাউই লিখেছেন, 'বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতে বসবাসকারী উপসাগরীয় আরবদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে মুক্তা সংগ্রহের মৌসুমে ও মৌসুম শেষে তাদের সংখ্যা নিঃসন্দেহে বাড়ত।' ধারণা করা হয়, রমরমা অবস্থায় সর্বোচ্চ ৫০০ জন বণিক ভারতে ছিল।

আরবদের মালিকানাধীন বেশিরভাগ স্থাপনা ছিল কালবাদেবীর মতি বাজার ও মোহাম্মদ আলী রোডে। আলবাদাউই আরও লিখেছেন, 'উপসাগরীয় ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য সেখানে অনেকগুলো অফিস স্থাপন করেছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ীদের নিজস্ব ভবন ছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন হুসেন বিন এসা ও তার ছেলেরা।'

বিন এসা ১৯ শতকে বর্তমানের সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বোম্বে চলে আসেন। তিনি ছিলেন সবচেয়ে সফল মুক্তা ব্যবসায়ীদের একজন।

মোহম্মদ আলি রোডে ছিল ক্ষুদ্র আরব মুক্তা ব্যবসায়ী, দালাল ও জাহাজ মালিকদের অফিস। এসব জাহাজ যে কেবল পণ্য ও ব্যবসায়ীদের পরিবহন করত তা নয়, মুসলিম হজত্রীরাও যাতায়াত করতেন এসব জাহাজে। কাছেই পিধোনিতে অনেকগুলো ছোট ও মাঝারি আকারের হোটেল ছিল। অল্প সময়ের জন্য যেসব আরব ভ্রমণকারী আসত, তারা উঠত এসব হোটেলে। এই হোটেলগুলোর কয়েকটি আজও টিকে আছে।

সাংস্কৃতিক বিনিময়

ভারতে আরবরা অনেকদিন থাকার ফলে চিন্তার আদানপ্রদান ঘটে এবং বিশ্বের উভয় অংশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়।

অনেক ধনী আরব পরিবার তাদের সন্তানদের ভারতে ইংরেজি পড়তে পাঠায়। তারা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিল যে তারা দেশে ফিরে একই রকম স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা চালাতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। 

ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা উপসাগরীয় দেশগুলোর স্বাধীনতাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯২৮ সালের গোড়ার দিকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত আরবদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে একটি প্রস্তাব পাস করে।

১৯২০-এর দশকজুড়ে মুক্তার ব্যবসা করে বিপুল লাভ আসতে থাকে। কিন্তু ওই দশকের শেষের দিকে কয়েকটি কারণে এ ব্যবসায় মন্দা শুরু হয়। 

জাপানে কালচারড মুক্তার উদ্ভাবন, ১৯২৯ সালে নিউইয়র্কে শেয়ার বাজার বিপর্যয় ও তৎপরবর্তী মহামন্দা ইউরোপে উপসাগরীয় অঞ্চলের মুক্তার চাহিদায় ধস নামে। লোকসান সইতে না অনেক আরব ব্যবসায়ী বোম্বেতে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়ে স্থায়ীভাবে উপসাগরে নিজ দেশে ফিরে যায়।

কিছু বণিক অবশ্য বোম্বে থেকে যায়। তারা অবশ্য অন্য ব্যবসায় নামেন। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে বৈশ্বিক শহর বোম্বেতে আরবদের সংখ্যায় বড় ধস নামে। 

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বোম্বের সঙ্গে আরবদের সম্পৃক্ততা কমে গেলেও কিন্তু পুরোপুরি শেষ হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, কুয়েত রাজপরিবার ১৯৫০-এর দশকে মেরিন ড্রাইভে দুটি ভবন কেনে—আল সাবাহ কোর্ট ও আল জাবরিয়া কোর্ট। দুর্ভাগ্যবশত, বিগত কয়েক দশক ধরে দুটো ভবন নিয়েই বিবাদ চলছে।

১৯৭০-এর দশকে উপসাগরীয় তেলের উত্থান হওয়ার পর বোম্বে ফের আরবদের জন্য জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে ওঠে। 

১৯৭৫ সালে লেবানন গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর আরবরা রাতের জীবন, বর্ষা ও শপিং উপভোগ করার জন্য বোম্বে আসতে থাকে। অল্পবয়সি ও ধনী আরবরা এখন পশ্চিমা শহরগুলোতে যেতে পছন্দ করলেও, মুম্বাই—১৯৯৫ সালে বোম্বের নাম বদলে মুম্বাই করা হয়—উপসাগরীয় অঞ্চলের অনেক মানুষের কাছেই শহরটি এখনও জনপ্রিয় গন্তব্য। 

মুক্তা বাণিজ্য ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও মুম্বাই আজও ভারত ও আরব বিশ্বের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংযোগ হিসেবে টিকে আছে।


  • সূত্র: স্ক্রল ডটইন

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.