যেভাবে গত তিন দশকে বারবার নিজের রূপ বদলেছে প্রমত্ত পদ্মা

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
08 August, 2022, 06:25 pm
Last modified: 08 August, 2022, 06:28 pm
পদ্মার ভাঙনে নিয়মিত বিলুপ্ত হয় এর পাড়ে থাকা স্থাপনা, বসতি ইত্যাদি। ১৯৬৭ সালের পর থেকে ৬৬ হাজার হেক্টরের বেশি পরিমাণ জমি পদ্মার বুকে বিলীন হয়েছে...

নদী বারবার গতিপথ বদলায়, আকৃতি পরিবর্তন করে। সেজন্য কবি লিখেছেন, 'এ-কূল ভাঙে, ও-কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা।' বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মা। গত ৩০ বছরে পদ্মা নদীর ভূমিরূপ বারবার বদলেছে, নদীর আকৃতি ও গড়নে এসেছে ভিন্ন-ভিন্ন পরিবর্তন। আর বহুরূপী এ চরিত্রের কারণে পদ্মা কখনো কারও জন্য হয়ে উঠেছে আশীর্বাদ, কারও কাছে অভিশাপ।

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা- নাসা তাদের এক নিবন্ধে ব্যাখ্যা করেছে কীভাবে পদ্মা নদী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে। বিগত তিন দশকে পদ্মার আকার বৃদ্ধি পেয়েছে, গঠনে পরিবর্তন এসেছে, এমনকি নদী আগের জায়গা থেকে সরেও গেছে। স্যাটেলাইট ইমেজারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব তথ্য জেনেছে নাসা'র আর্থ অবজারভেটরি।

পদ্মা নদী বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জলপথ। এর পানি চাষাবাদের কাজে ব্যবহার করেন কৃষকেরা। নদীর দীর্ঘ ১৩০ কিলোমিটার তটরেখায় বাস করা মানুষগুলোকে নদীর খেয়ালের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানিয়ে চলতে হয়। পদ্মার ভাঙনে নিয়মিত বিলুপ্ত হয় এর পাড়ে থাকা স্থাপনা, বসতি ইত্যাদি। ১৯৬৭ সালের পর থেকে ৬৬ হাজার হেক্টরের বেশি পরিমাণ জমি পদ্মার বুকে বিলীন হয়ে গেছে।

১৯৮৮ সালের পদ্মা। ছবি: নাসা আর্থ অবজারভেটরি

পদ্মার এ তীব্র ভাঙনের পেছনে দুটো প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, পদ্মা একটি প্রাকৃতিক নদী- এর গতি অবাধ, কিন্তু এর কূল রক্ষায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই। কেবল মাঝেমধ্যে কিছু বালুর বস্তা ফেলে পদ্মার ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হয়। দ্বিতীয় কারণটি হলো, পদ্মার পাড় একটি বড় বালুতটের ওপর অবস্থিত, ফলে খুব দ্রুতই এটি ক্ষয়ে যায়।

বিজ্ঞানীরা পদ্মার প্রশস্ততা, গভীরতা, গড়ন, ও সার্বিক রূপ পর্যবেক্ষণ করে এটির ক্ষয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। স্যাটেলাইট ইমেজে ধরা পড়েছে ১৯৮৮ সালের পর থেকে পদ্মার আকৃতিতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে। নাসা'র ল্যান্ডস্যাট স্যাটেলাইটের সহায়তায় পদ্মার এই বিবর্তনের ছবিগুলো পাওয়া গিয়েছে।

১৯৯২ সালের পদ্মা। ছবি: নাসা আর্থ অবজারভেটরি

ল্যান্ডস্যাট কৃত্রিম উপগ্রহ এ ধরনের ছবি তোলার জন্য শর্টওয়েভ ইনফ্রারেড, নিয়ার ইনফ্রারেড, ও দৃশ্যমান আলোর সহায়তা গ্রহণ করে। পদ্মার এ ছবিগুলো শুকনো মৌসুমে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে তুলেছে নাসা'র স্যাটেলাইট।

বছরের পর বছর পদ্মার সর্পিল নকশা ও চরের বৃদ্ধি দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পদ্মা একটি আঁকাবাঁকা নদী, এর প্রবাহ সর্পিল। এ ধরনের নদীর ক্ষেত্রে বাইরের কিনারা আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যায় বলে নদীর চ্যানেল প্রশস্ত হয়। অন্যদিকে ভেতরের কিনারায় স্রোতের শক্তি কম থাকে, ফলে নদীতে পলি জমে। সর্পিল নদীগুলো মাঝেমধ্যে স্থান ও গতি পরিবর্তন করে। তবে পুরনো গতিপথে নিজের একসময়ের অস্তিত্বের চিহ্ন রেখে যায় নদীগুলো।

১৯৯৬ সালের পদ্মা। ছবি: নাসা আর্থ অবজারভেটরি

সর্পিল নদীগুলোর চলার পথে অনেক চ্যানেল তৈরি হয়। এ চ্যানেলগুলো একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে কিছুদূর পরপর আবার মিলিত হয়। নদীর বুকে পলি জমতে জমতে কখনো কখনো তা চরে পরিণত হয়। ফলে নদীর প্রবাহের দিক বদলে যায়।

নদীর এ পলির উৎস বিভিন্ন। একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে ঘটা এক ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ভূমিধ্বসের অবশিষ্টাংশই বর্তমানে পদ্মার পলিতে পরিণত হয়েছে। গবেষকেরা মনে করেন, বালুর মতো অসূক্ষ্ম উপাদানগুলো নদী দিয়ে প্রবাহিত হতে সময় নিয়েছে প্রায় অর্ধশত বছরের মতো।

২০০০ সালের পদ্মা। ছবি: নাসা আর্থ অবজারভেটরি

গত তিন দশকে পদ্মা নদী সরু থেকে বিস্তৃত হয়েছে। একইভাবে এর সোজা গতিপথ বদলে গিয়ে তা সর্পিলাকার নিয়েছে। পদ্মার বুকে অনেক চর জেগেছে। তবে সাম্প্রতিককালে পদ্মা আবার সোজা পথে প্রবাহিত হচ্ছে।

নাসার ছবিতে দেখা যায়, হরিরামপুর উপজেলার কাছে উজানের পদ্মা সবচেয়ে বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। ১৯৯৮ সালের বন্যায় পদ্মার দুই পাড় ভেসে যায়। তখন ভারত ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়ায় নদীতে পানির পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল।

২০১৪ সালের পদ্মা। ছবি: নাসা আর্থ অবজারভেটরি

ভাটির দিকে চর জানাজাতের কাছে সর্পিল ভাঁজগুলো ভূমিতে আরও ক্ষয় ঘটিয়েছে। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সালে পদ্মার বাঁকগুলো সবচেয়ে পরিণত ও শক্তিশালী ছিল। ১৯৯২ সালে পদ্মায় বাঁক তৈরি হয়, এরপর ২০০২ সালে সেগুলো ক্রমে উধাও হয়ে যেতে শুরু করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পদ্মার ভাঙন, সর্পিল গতি, ও চর তৈরি হওয়ার হার কমেছে। তবে তার মানে এ নয় যে পদ্মার আশপাশে ক্ষয়ের ঝুঁকি থেকে পুরোপুরি মুক্ত। বন্যা, ভূমিধস, অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদির কারণে এখানকার ইকোসিস্টেমে কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে তার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে নদীর ভূমিরূপের ওপর।


  • সূত্র: আর্থ-অবজারভেটরি ডটনাসা ডটগভ 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.