অ্যাডভেঞ্চারে যাবেন? তাঁবু-পনচো-মগ-বালিশ-গাট্টি-বাত্তি সব জোগান দেবে যে অ্যাডভেঞ্চার শপ!

ফিচার

27 July, 2022, 10:30 pm
Last modified: 27 July, 2022, 11:36 pm
পিক সিক্সটি নাইন যখন শাহবাগের আজিজ মার্কেটে ছিল- তখন সেখানে খুব আড্ডা জমত বিকালে। এক যুগ পার করে ফেলেছে অ্যাডভেঞ্চার শপটি। দেশের অভিযানপ্রিয় মানুষদের কাছে এখন এটি পরিচিত নাম। 

পাহাড়ে চড়ার, দৌঁড়ানোর, সাঁতরানোর, বনবাসের সবরকম সাজ-সরঞ্জাম পাওয়া যায় পিক সিক্সটি নাইনে(Peak 69)। পান্থপথের বসুন্ধরা শপিংমলের দ্বিতীয় তলায় এ অ্যাডভেঞ্চার শপ। রুদ্র রহমানকে পাওয়া গেল শপের ক্যাশ কাউন্টারে। তিনি এর কর্মী, পাশাপাশি একজন পর্বতারোহী। একে একে বলতে থাকলেন কোনটার কী নাম আর কী তার কাজ।

পনচো দিয়ে হলো শুরু। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তৈরি পরিধেয় এই পনচো। তবে রেইনকোটের সঙ্গে এর ফারাক রয়েছে প্রশস্ততায়। কাঁধে রাখা ব্যাকপ্যাকও পনচোর ভেতরে পুরে নেওয়া যায় অনায়াসে; যা রেইনকোটে সহজ হয় না। আন্দেজ ও পাতাগোনিয়ার আদিবাসী আমেরিকানরা মধ্যযুগ থেকে পনচো ব্যবহার করে আসছে । কুয়েচুয়া ভাষার পুঞ্চুকে স্পেনীয়রা বলল পনচো আর সেটাই ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। এই পোশাকে বাতাস চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য হাতের দিকগুলো খোলা থাকলেও নিচের দিকে বোতাম লাগানো থাকে। বাড়তি হিসেবে মাথা ঢাকার হুড থাকে যা বোতাম দিয়ে যুক্ত করা যায়।

১৮৫০ সাল থেকে মার্কিন সেনাদল পনচোর ব্যবহার শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর ব্যবহার বেড়ে যায় কয়েকগুণ। জার্মান বাহিনী তখন প্রতি চারজনের জন্য চারটি পনচো বরাদ্দ করতো। তা জোড়া দিয়ে চারজনের থাকার তাঁবুও হয়ে যেত। পঞ্চাশের দশকে নতুন হালকা নাইলনের পনচো তৈরি শুরু হয়। শিকারি, ক্যাম্পার (তাঁবু বা শিবিরে বসবাসকারী) এবং অনুসন্ধানী দলের মধ্যে এর ব্যবহার বাড়তে থাকে।

ক্লিন্ট ইস্টউড। ছবি: ইন্টারনেট সূত্রে

এমনকি পনচোর প্রসারে হলিউড অভিনেতা ও নির্মাতা ক্লিন্ট ইস্টউডেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। 'দ্য ম্যান উইদ নো নেম', 'ফর আ ফিউ ডলারস মোর' বা 'দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি' মুভিতে পনচো ছাড়া তাকে কমই দেখা গেছে। পিক সিক্সটি নাইনে নাইলন ও সিলিকনের তৈরি পনচো পাওয়া যায়, দাম পড়ে হাজার টাকা প্রায়। রুদ্র দেখালেন, এগুলো থ্রি ইন ওয়ান, বৃষ্টি থেকে বাঁচায় আবার ম্যাট ও ছাউনি হিসাবেও ব্যবহার করা যায়। পিক সিক্সটি নাইন নিজেরাই দেশে পনচো তৈরি করে থাকে।

এরপর সাইক্লিং ব্যাগ দেখালেন রুদ্র। এগুলো শরীরের সঙ্গে এঁটে থাকে 'স্লিম ফিট' জামার মতো। এদিক সেদিক দুলতে থাকলে সাইক্লিস্টের কষ্ট হবে, তাই এমনভাবে ব্যাগগুলো ডিজাইন করা হয়- যেন শরীরের সঙ্গে মিশে থাকে। এগুলোতে পানি রাখার ব্লাডার থাকে; যার ওপরভাগ থেকে একটি পাইপ বেরিয়ে আসে মুখের কাছে।

সাইক্লিস্টকে তাই পানি পানের জন্য থামতে হয় না, বরং সাইকেল চালানো অবস্থায়ই পানির পিপাসা মেটাতে পারেন তারা। এসব ব্যাগে গুলোতে হেলমেট ঝুলিয়ে রাখার জন্য বিশেষ হুক ও দড়ি থাকে। মাঝখানে বা নীচের দিকেও চেইন থাকে যা দিয়ে কুইক এক্সেস করে চকলেট বা বিস্কুট বের করে আনা যায়; থাকে সফট ওয়াটার বোতল রাখার পকেটও। পিক সিক্সটিনাইন চীনা নেচারহাইক কোম্পানির যে সাইক্লিংব্যাগ বিক্রি করে তা হালকা এবং ব্রিদেবল (ঘাম হওয়া রোধ করে)। এধরনের ব্যাগের দাম পড়ে ১৮০০ টাকা।

পিক ৬৯ বসুন্ধরা শপিংমলে। ছবি: টিবিএস

২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত নেচারহাইকে কেবল পণ্য উৎপাদন করেই কাজ শেষ করে না, বরং মান উন্নয়নে গবেষণা চালায়। সাধ্যের মধ্যে ভালো পণ্য যোগান দিয়ে প্রশংসা অর্জন করেছে নেচারহাইক। সেরার দিক থেকে চীনের আরেক আউটডোর ইকুপমেন্ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হলো কৈলাস। পিক সিক্সটি নাইনে কৈলাসের পণ্য সামগ্রী আছে অনেক। 

রুদ্র কৈলাসের তৈরি হাইকিং বড় ব্যাকপ্যাক দেখাল একটি। মোটাদাগে দুটি চেম্বার আছে ব্যাগটির। মূল চেম্বারে ওজন ধরে ৩৮ লিটার আর কুইক অ্যাক্সেসের জন্য ওপর দিকে যে বাড়তি একটি ছোট চেম্বার (ক্যাঙ্গারু থলে বলেই বেশি পরিচিত) আছে তাতে ধরে পাঁচ লিটার। দুই ধারে পানির বোতল রাখার দুটি পকেট আছে। আছে হাইড্রেশন ব্লাডার, সাইড কমপ্রেশন স্ট্র্যাপ এবং রেইন কাভার। আরো আছে আইস এক্স (বরফ কাটার ছোট্ট কুঠার) এবং ট্রেকিং স্টিক ঝুলিয়ে রাখার লুপ বা গেরো। ঘন নাইলন দিয়ে এটি তৈরি। রুদ্র বলছিলেন, "বয়ে চলা ওজন শরীর জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয় ব্যাকপ্যাক। না নিচের দিকে ঝুলে পড়ে- না ওপরে বোঝা তৈরি করে। ওজন কোমড়ে স্থিত করার জন্য নিচে মোটা স্ট্র্যাপ থাকে।" ব্যাকপ্যাকটির দাম প্রায় ১২ হাজার টাকা।

তারপর কয়েকটি ডে ব্যাগ দেখাল রুদ্র। এগুলো এক দুদিনের সফরের জন্য উপযোগী। এগুলো ওয়াটার রেসিস্ট্যান্ট বা পানি প্রতিরোধী তবে ওয়াটার প্রুফ নয়। এসব ব্যাগে ডাস্ট বা রেইন কভার থাকে। রাং ত্লাং নামের পিক সিক্সটি নাইনের একটি ডে ব্যাগ আছে যা তারা নিজেরাই তৈরি করে। রকমভেদে জিনিসপত্র আলাদা রাখার জন্য এতে তিনটি কম্পার্টমেন্ট আছে। ভ্যাট যোগ করে এমন একটি ব্যাগের দাম পড়ে ৬৩০ টাকা। উল্লেখ্য, রাং ত্লাং বাংলাদেশের (বান্দরবানে অবস্থিত) তৃতীয় সর্বোচ্চ চূড়া।

ছবি: পিক সিক্সটি নাইনের ফেসবুক পেইজ থেকে।

এরপর রুদ্র দেখালো হ্যামক, নাম এক্সট্রিম টু। আগের এক্সট্রিম সংস্করণকে উন্নত করে এটি তৈরি করা হয়েছে। দুই গাছের মাঝখানে এটি সহজে ঝুলিয়ে দেওয়া যায়। রিবক নাইলনের তৈরি এ হ্যামক ব্রিদেবল, হালকা এবং শক্তপোক্ত। ভিজলে দ্রুতই শুকায়। ১০০ কেজি পর্যন্ত ওজন বইতে পারে এটি। গুছিয়ে ছোট এক থলিতে ঢুকিয়ে রাখা যায়। দাম ১৪০০ টাকার কিছু বেশি। এছাড়া নেচারহাইকের তৈরি হ্যামকও বিক্রি করে পিক সিক্সটিনাইন; যেগুলোর দাম ৩ হাজার টাকার আশেপাশে।

পিক সিক্সটি নাইনের নিজেদের তৈরি স্লিপিংব্যাগের নাম রেমাক্রি। সফট নাইলন দিয়ে তৈরি স্লিপিং ব্যাগটি কিছু মাত্রায় পানিরোধী, ওজন ১১০০ গ্রাম, দাম ২৩০০ টাকা। রাজহাসের পালক পুরে তৈরি নেচারহাইকের স্লিপিং ব্যাগও আছে অ্যাডভেঞ্চার শপটিতে যার দাম প্রায় ১০ হাজার টাকা।

কৈলাস ও নেচারহাইকের তৈরি বেশ কয়েক রকমের তাঁবু আছে পিক সিক্সটি নাইনে। কোনোটি দুই জনের উপযোগী কোনোটিবা চারজনের। তাঁবুর রকমফের আবার সিজন ধরেও হয়। যেমন বরফ জমা প্রান্তরে যে তাঁবু পাতা যায় তাকে বলে ফোর সিজন টেন্ট। কেবল শীত আর গ্রীষ্মের জন্য উপযোগী তাবুগুলোকে বলে টু সিজন টেন্ট আর যেগুলো বর্ষাও মোকাবেলা করতে পারে সেগুলোকে বলা হয় থ্রি সিজন টেন্ট। নেচার হাইকের ফোর সিজন টু পারসন ইগলু ৭০ডি তাঁবুর দাম প্রায় ৩৩ হাজার টাকা। অন্যদিকে তিন-চারজন থাকতে পারে, দরজায় পোকামাকড়রোধী নেট লাগানো, বেসিক ওয়াটার প্রুফ (নন ব্র্যান্ড) তাঁবুর দাম ৪ হাজার টাকা প্রায়। এর বডির সঙ্গে রেইন ফ্লায়ার, খুঁটি বা পোল, গজাল বা নেইলস, দড়ি এবং বহনকারী ব্যাগ পাওয়া যায়।

ছবি: পিক সিক্সটি নাইনের ফেসবুক পেইজ থেকে

এরপর কিছু বালিশ দেখলাম। দুই রকম বালিশ আছে, অটো এবং এয়ার। অটো পিলোর কেবল মুখ খুলে দিলেই হয়, বাতাস টেনে নিয়ে আপনা থেকেই মোটাতাজা হয়ে যায়। নেচারহাইকের তৈরি অটো পিলোর দাম পড়ে দেড় হাজার টাকার কিছুটা কম।

এবার কিছু রানিং অ্যাকসেসরিজ দেখালো রুদ্র; যেমন- রানিং ব্যাকপ্যাক, স্পোর্টস সকস বা মোজা, ওয়েইস্ট বা কোমড়ে পরার প্যাক, হেডব্যান্ডস, ব্রিদেবল রিফ্লেক্টিভ ভেস্ট ইত্যাদি। নেচারহাইকের ওম্যান স্পোর্টস সকস তৈরি করা হয় কটন ও পলিস্টার মিশিয়ে। স্পোর্টস সকসের কাপড় মোটা হয়, ফোস্কারোধী হয় এবং ছোটখাটো আঘাত থেকে পা-কে বাঁচায়। দাম ৩০০ টাকার মতো। ব্রিদেবল রিফ্লেক্টিভ ভেস্ট তৈরি হয় পলিস্টার দিয়ে। এগুলো ঘাম রোধ করে এবং রাতের বেলায় কিছু আলো তৈরি করে। এগুলোতে বেশ কয়েকটি পকেট থাকে, সেগুলোয় পানির বোতলও বহন করা যায়। সাইক্লিং, ক্যাম্পিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং এরকম প্রায় সব আউটডোর ইভেন্টেই এগুলো ব্যবহারযোগ্য।

এরপর দেখলাম কৈলাসের তৈরি হাইকিং শ্যু বা জুতা। এগুলো ব্রিদেবল এবং ওয়াটারপ্রুফ। পায়ের উঁচু নিচু তলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এগুলো তৈরি করা হয় আর সে সঙ্গে পাথরের খোঁচা থেকেও বাঁচায় পা গুলোকে। হাইকিং শ্যু-তে ভিব্রম প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। এর ইতিহাস খুঁজতে যেতে হয় ১৯৩৫ সালে। ওই বছরের  সেপ্টেম্বর মাসে ভিটালি ব্রামানির ছয় বন্ধুর মৃত্যু ঘটে ইতালীয় আল্পসে। ভালো জুতার অভাবকেও দায়ী করা হয় এ দুর্ঘটনার জন্য। এরপর ব্রামানি পর্বতারোহনের উপযোগী সোল বা জুতার তলা নকশা করার কথা ভাবতে থাকে। দুই বছর পর তিনি রাবারের সোলের (আগে চামড়ার সোল বেশি ব্যবহৃত হতো) পেটেন্ট নেন, পিরেলি টায়ার তাকে এ কাজে আর্থিক সহায়তা দেয়। ব্রামানির এ আবিস্কার মানে ভিব্রম প্রযুক্তি জুতাগুলোকে ওজনবহনে দারুণ পারদর্শী করে এবং ঘর্ষণজনিত ক্ষয় রোধেরও উপযুক্ত করে তোলে। কৈলাসের তৈরি হাইকিং শ্যু পুরোপুরি পানিরোধী। দাম ১১ হাজার টাকার বেশি, ওজনে ৪০০ গ্রামের বেশি।

এভারেস্ট যাত্রায় কৈলাসের তাবু। ছবি: ইন্টারনেট থেকে

তারপর দেখলাম ক্লাইম্বিং হেলমেট। পর্বতারোহীদের জন্য এ হেলমেট দারুণ কাজের। ওপর থেকে যদি ঝুরঝুর করে পাথর খসে পড়তে থাকে তখন হেলমেটটা আপনার মাথায় আঘাত লাগতে দেবে না। অথবা ঝুলছেন ক্লাইম্বিং রোপে, তাল সামলাতে না পেরে পাহাড়ের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেলেন, মাথাটা বাঁচবে ওই হেলমেটের কল্যাণে। এরগোনমিক ডিজাইনে ক্লাইম্বিং হেলমেট তৈরি হয়। অভিযাত্রীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয় এরগোনমিক ডিজাইন। হেড ল্যাম্প বা স্নো গগলস জুড়ে দেওয়ার সুবিধা থাকে এসব হেলমেটে। কৈলাসের তৈরি ক্লাইম্বিং হেলমেটে ছয়টি ফোকড় থাকে যা দিয়ে গরম আর আর্দ্রতা বেড়িয়ে যায়। এর ওজন ৩৩০ গ্রাম আর দাম ১০ হাজার ৩০০ টাকা।

পিক সিক্সটি নাইনে আরো পাওয়া যায় হেডল্যাম্প, ড্রাই ব্যাগ, ক্যাম্প ল্যাম্প, ওয়েস্ট প্যাক, হেডব্যান্ড, টাইটানিয়ামের তৈরি কফি মগ, চেস্ট ব্যাগ, হেডস্কার্ফ, আইস এক্স, ট্রেকিং পোল, ওয়াটারপ্রুফ ক্যামেরা ব্যাগ ইত্যাদিসহ প্রায় ৩০০ পদের পরিধেয় ও ব্যবহার্য জিনিস।

পিক সিক্সটি নাইন যখন শাহবাগের আজিজ মার্কেটে ছিল- তখন সেখানে খুব আড্ডা জমত বিকালে। এক যুগ পার করে ফেলেছে অ্যাডভেঞ্চার শপটি। দেশের অভিযানপ্রিয় মানুষদের কাছে এখন এটি পরিচিত নাম। 

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.