সাবিত্রী মিষ্টি! অর্ডার ছাড়া যে মিষ্টি ভাগ্যে মেলে না

ফিচার

27 July, 2022, 09:30 pm
Last modified: 27 July, 2022, 09:32 pm
তিন পুরুষ ধরে চলে আসা খাঁটি দুধের তৈরি নির্ভেজাল এ মিষ্টির খ্যাতি পৌঁছে গেছে মেহেরপুর ছাড়িয়ে দেশের আরও অনেক জায়গাতেও।

গেল ঈদুল আযহার সপ্তাহখানেক পর মেহেরপুর শহরের ২নং ওয়ার্ডের ব্যবসায়ী সেলিম রেজা গিয়েছিলেন শহরের বাসুদেব গ্র্যান্ডসন্সে। তখন সকাল দশটার কাছাকাছি। তবে সেদিন তার মিষ্টি কেনা হলো না, দোকানি জানালেন এ দোকানে অর্ডারের বেশি মিষ্টি তৈরি হয় না, তাই মিষ্টি অবশিষ্ট থাকে না। শেষে দুই কেজি মিষ্টির অর্ডার দিয়ে বিষণ্ণ মনে ফিরে গেলেন তিনি। তবে পরে ক্রেতাদের প্রতি কারিগরদের শ্রদ্ধাভক্তি আর সাবিত্রীর স্বাদ রেজার সেই কষ্ট দূর করে দিয়েছিল।

মেহেরপুর শহরের বড় বাজারে অবস্থিত বাসুদেব গ্র্যান্ডসন্সের ঐতিহ্যবাহী সাবিত্রী মিষ্টি বিক্রির ধরন এমনই। তিন পুরুষ ধরে চলে আসা খাঁটি দুধের তৈরি নির্ভেজাল এ মিষ্টির খ্যাতি পৌঁছে গেছে মেহেরপুর ছাড়িয়ে দেশের আরও অনেক জায়গাতেও। ব্যতিক্রমী এই মিষ্টির ওপর এখনও আস্থা রেখেছেন এলাকার মানুষ। সাবিত্রী মিষ্টিকে মেহেরপুর জেলার গর্ব বলে মনে করেন এখানকার মানুষজন। প্রবাসীরাও এই মিষ্টি দিয়ে বিদেশিদের মুগ্ধ করেন।

মেহমানদের নাস্তা, আত্মীয় বাড়িতে গমন, ঘনিষ্ঠজনদের উপহার, বিয়ের অনুষ্ঠান ও নানা রকম অনুষ্ঠান আয়োজনে সাবত্রী মিষ্টি ছাড়া যেন চলেই না। সরকারি দপ্তরের অনুষ্ঠানগুলোতেও সাবিত্রী যেন অপরিহার্য। ব্যতিক্রমী স্বাদ আর ভেজালমুক্ত মিষ্টি হিসেবে যুগ যুগ ধরে সাবিত্রী মিষ্টি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে আছে।

যেভাবে সাবিত্রী মিষ্টির জন্ম

চমচমের মতো লম্বা তবে চেপ্টা আকারের এই মিষ্টি দেখতেও সচরাচর মিষ্টির চেয়ে ভিন্ন। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে মেহেরপুর শহরের বড় বাজার এলাকার বাসুদেব সাহা নিজ বাড়িতে মিষ্টি তৈরী করে বিক্রি করতেন। পৈতৃক পেশা হিসেবে তিনি মিষ্টির ব্যবসায় আসেন। সাধারণ মিষ্টি বানাতে গিয়ে তার মাথায় আসে কীভাবে একটি ভিন্নধর্মী ও নির্ভেজাল মিষ্টি তৈরী করা যায়। এভাবে একদিন তিনি সাবিত্রী ও রসকদম্ব মিষ্টি তৈরী করে বিক্রি শুরু করেন। মিষ্টির স্বাদে মুগ্ধ ক্রেতারা তাকে আবার ওই মিষ্টি বানাতে অনুরোধ করলেন।

রসকদম্ব। ছবি: টিবিএস

এভাবে দিন-মাস-বছর ঘুরে সাবিত্রী মিষ্টির প্রশংসা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। জনশ্রুতি রয়েছে যে, তখন জেলার প্রায় সব মিষ্টির কারিগর প্রায় বেকার সময় কাটাতে শুরু করেন। সাবিত্রী ও রসকদম্বের ভিড়ে পেশা বদল করতে বাধ্য হন অনেক কারিগর। এভাবে বংশপরম্পরায় বাসুদেব সাহার তৃতীয় প্রজন্ম তার নাতিরা এখন এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তবে মিষ্টি দুটির স্বাদ ও মান একই হলেও তেমন পরিচিতি লাভ করেনি রসকদম্ব।

বাসুদেব সাহার নাতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গরুর খাঁটি দুধ, দুধ জ্বাল দেওয়ার জন্য উপযুক্ত কাঠ, পাত্র আর পরিমাণ মতো চিনি হচ্ছে সাবিত্রীর প্রধান উপকরণ। এই উপাদানগুলোর সঙ্গে তাদের দাদু (বাসুদেব সাহা) কখনও আপস করেননি। ফলে সাবিত্রীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সেই ধারাবাহিকতায় তারা ব্যবসায় ধরে রেখেছেন। 

সাবিত্রীর নামকরণ

মিষ্টি তৈরির জাত কারিগর বাসুদেব সাহা ভাবতেন কীভাবে মানুষকে শতভাগ খাঁটি মিষ্টি খাওয়ানো যায়। সাবিত্রী তৈরির তার যাত্রার প্রতিটি পদে পদে ছিল খাঁটি জিনিসের সমাহার। ফলে তার তৈরি মিষ্টিও খাঁটি হিসেবে মানুষের হৃদয় জয় করে। বাছাইকৃত গরুর দুধ আর এই দুধ জ্বাল দেওয়ার জন্য তেঁতুল, নিম, বাবলা, ও বেল জাতীয় ভারি কাঠের খড়ি ব্যবহার করা হয়। মান নিশ্চিত করতেই অন্য কোনো উপাদান ব্যবহার না করে কেবল দুধ আর চিনি দিয়েই তৈরি হয় মিষ্টিটি। সনাতন ধর্মের পৌরাণিক চরিত্র সতী সাবিত্রী থেকেই সাবিত্রীর নামকরণ করা হয়।

যেভাবে বানানো হয় সাবিত্রী

কৃষকের বাড়িতে পালা দেশি জাতের গাভীর দুধ কেনা হয় সাবিত্রীর জন্য। মিষ্টির অর্ডারের কথা মাথায় রেখে দুুধের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এ দুধ ভারি কাঠ দিয়ে চুলায় জ্বাল দেওয়া হয়। সারাদিন নেড়েচেড়ে জ্বাল দেওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে ওই দুধ ঠান্ডা করার জন্য রেখে দেওয়া হয়। এই দুধ দিয়েই পরদিন সকালবেলা সাবিত্রী বানিয়ে বিক্রি শুরু হয়।

ছবি: টিবিএস

সাবিত্রীর দেখতে সন্দেশের মতো। তবে কিছুটা নোনতা লাগে। মিষ্টির কারিগরেরা জানান, খাঁটি দুধ জ্বাল দিয়ে যখন কোনো মিষ্টি তৈরি করা হয় তখন নোনতা স্বাদ হয়। এটা দিয়েই বিশুদ্ধতা প্রমাণ করা যায়।

সাবিত্রীর বর্তমান কারিগর

বাসুদেব সাহার আগের চার পুরুষ মিষ্টির কারিগর ছিলেন। বাসুদেব ৭০ বছর আগে মারা যান। তার কাছ থেকে সাবিত্রী তৈরী করা শিখেছিলেন একমাত্র ছেলে রবীন্দ্রনাথ সাহা। রবীন্দ্রনাথ সাহার কাছ থেকে তার তিন ছেলে বিকাশ সাহা, অনন্ত সাহা ও লালন সাহা সাবিত্রী তৈরী শিখেছেন।

বর্তমানে তিন ভাই মিলে প্রতিদিন সাবিত্রী ও রসকদম্ব তৈরী করে বিক্রি করেন। প্রতিদিন তারা প্রায় ৬০ কেজি মিষ্টি তৈরি করতে পারেন। সক্ষমতার তুলনায় চাহিদা বা বিক্রি অনেক কম। প্রতি কেজি মিষ্টির দাম ৪০০ টাকা।

পিতামহের আমল থেকেই ব্যবসার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা আর নির্ভেজালে অটুট সাবিত্রীর কারিগরেররা। নিয়ম করে প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। শুক্রবারে সকাল থেকে বেলা একটা পর্যন্ত খোলা থাকে। দোকানে মিষ্টি থাক বা না থাক, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। দোকানের সঙ্গেই রয়েছে তাদের বাড়ি। দাদুর রেখে যাওয়া অল্প জায়গার মধ্যেই বাড়ি, দোকান আর কারখানা।

ঝুঁকিতে সাবিত্রী ও রসকদম্ব

সাত পুরুষ ধরে চলে আসা মিষ্টির ব্যবসায় এখন বেশ হুমকির মধ্যে। বর্তমান কারিগরেরা এ নিয়ে দুশ্চিন্তায়। দুধ, চিনি আর কাঠের দর বৃদ্ধি, অন্যদিকে সময়মতো দুধের জোগান না পাওয়া মাঝে মাঝে সংকট তৈরি করে। খাঁটি মিষ্টি বলে অন্যান্য মিষ্টির চেয়ে দামও বেশি।

এদিকে বর্তমান কারিগর তিন ভাইয়ের কোনো ছেলেমেয়ে এই পেশায় আসেনি। তারা সকলেই লেখাপাড়ায় মনোযোগ দিয়েছেন। দাদু ও পিতার পেশায় তাদের আগ্রহ নেই। ফলে এই তিন ভাইয়ের মৃত্যুর পর সুস্বাদু সাবিত্রী, রসকদম্ব আর পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এছাড়া বাপ-ঠাকুরদার হাতের মিষ্টি তৈরির স্বত্ব তারা অন্য কাউকে দিতেও চান না। কারণ হিসেবে জানালেন, যদি কেউ ভেজাল করে তাহলে দেড়শ বছরের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে সাবিত্রীর।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.