যশোরে যেভাবে গড়ে উঠল ‘ব্যাটের গ্রাম’   

ফিচার

22 July, 2022, 11:05 am
Last modified: 22 July, 2022, 11:14 am
সব মিলিয়ে বছরে ৫ লাখ ক্রিকেট ব্যাট উৎপাদন হয় ক্লাস্টারটিতে; আনুমানিক বার্ষিক টার্নওভার ৩০-৪০ কোটি টাকা।

রতন মজুমদার ও রিপন মজুমদার, দুই ভাই প্রায় ২০ বছর ধরে যশোর সদর উপজেলার ১৪ নং ইউনিয়ন নরেন্দ্রপুর গ্রামে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির পেশায় জড়িত। ছোটবেলায় কাঠমিস্ত্রি বাবার হাত ধরেই তাদের এই পেশায় আসা। ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ক্রিকেট ব্যাট বানানো শুরু করেন, বর্তমানে তাদের বার্ষিক টার্নওভার ২ কোটি টাকার অধিক। ইতোমধ্যে এই ব্যবসার আয় দিয়েই গ্রামে তৈরি করেছেন ডুপ্লেক্স ভবন, কিনেছেন জমিও।

রিপন মজুমদার টিবিএসকে বলেন, 'ছোট বেলায় টাকার অভাবে পড়াশোনা ৮ম শ্রেণির বেশি করতে পারি নাই, সংসারে অভাব ঘুচাতে বাবার সাথে কাঠমিস্ত্রির কাজে নেমে পড়ি, বর্তমানে আমাদের সংসারে কোন অভাব নেই। আমাদের কারখানায়ই ১৫ জন কারিগরের কর্মসংস্থান হয়েছে।'

রতন মজুমদার বলেন, 'একসময় আমারা সর্বোচ্চ ১ হাজার ব্যাট বানাতে ভয় পেতাম, যদি বিক্রি না হয় এই ভয়ে। কিন্ত বর্তমানে আমরা দুই ভাই মিলে বছরে ৩০ হাজার ব্যাট তৈরি করি, চারিদিকে আমাদের ব্যাটের সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় দিনদিন ব্যাটের চাহিদা বেড়েই চলছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের ব্যাটের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

গ্রামের অপর সফল ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম, একসময় গ্রামেই কৃষিকাজ করতেন। তিনিও ২০০২ সাল থেকে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির এই ব্যবসায় জড়িত হন। গত ছয় মাসে শরিফুল ইসলামের কারখানায় প্রায় ২২ লাখ টাকার ব্যাট বিক্রি হয়।

শরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'আমি এই ছয় মাসে ২০ হাজার ব্যাট তৈরি করেছি। এই পেশায় কেউ ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে অর্ধেকের বেশি লাভ হয়। আমাদের এখানকার ব্যাটের মূল্য সাধারণত ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫০ টাকার মধ্যে।'

শুধু রতন-রিপন ও শরিফুলই নয়, যশোরের এই কৃষিপ্রধান গ্রামটিতে এখন প্রায় ৫০০ লোক এই পেশায় জড়িত। যারা আজ শ্রমিক, তারাও কাজ শিখে কিছুদিন পর নিজেই বাড়িতে গড়ে তুলছেন ব্যাট কারখানা। শ্রমিক থেকে কারিগর, কারিগর থেকে উদ্যোক্তা বনে যাচ্ছেন। এই গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা এখন ক্রিকেট ব্যাট তৈরি।

যশোর ক্রিকেট ব্যাট উন্নয়ন সমবায় সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে নরেদ্রপুর গ্রামে সারা বছর ধরে অপারেশনে থাকা ব্যাট তৈরির কারখানার সংখ্যা ২৩টি, ক্রিকেট খেলার মৌসুমে আরও প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি ক্ষুদ্র কারখানাও ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী বলরামপুর, রুদ্রপুর ইত্যাদি গ্রামে ছড়িয়ে পড়া ৭০টির বেশি কারখানা গড়ে উঠেছে এ এলাকায়। সব মিলিয়ে বছরে ৫ লাখ ক্রিকেট ব্যাট উৎপাদন হয় ক্লাস্টারটিতে। আনুমানিক বার্ষিক টার্নওভার ৩০-৪০ কোটি টাকা।

জানা যায়, ১৯৮৬ সালের দিকে সঞ্জীব মজুমদার নামে এক ব্যবসায়ী কলকাতায় ব্যাট প্রস্তুত করার পদ্ধতি দেখে এসে নিজ গ্রাম নরেন্দ্রপুরে কোন ধরণের প্রশিক্ষণ-প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ছাড়াই ব্যাট বানানো শুরু করেন। সেবছরই সেগুলো রূপদিয়াসহ স্থানীয় বাজারে বিক্রি শুরু করে বেশ সাফল্য পান তিনি। সঞ্জীবের ব্যবসার সফলতা দেখে গ্রামের আরও অনেকে ব্যাট তৈরি শুরু করেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যশোর শহর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দূরে নরেন্দ্রপুর গ্রাম। এই গ্রামের মিস্ত্রিপাড়া এবং মহাজেরপাড়া মূলত 'ব্যাটের গ্রাম' হিসেবে বিশেষ পরিচিত। এসব কারখানায় শুরুতে সব কাজ ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে করা হলেও বর্তমানে অনেকেই তা মেশিনে করছেন। এতে কাজের গতির পাশাপাশি আয়ও বেড়েছে উদ্যোক্তাদের।

ব্যাট তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় নিম, হাইব্রিড নিম, জীবন, পুয়ো, পিটেল, কদম, দেবদারু, ছাতিয়ান,  পিঠেগড়া, আমড়াসহ বিভিন্ন প্রকার দেশীয় গাছের কাঠ। এছাড়াও হাতল সংযোগের জন্য আঠা, ফিনিশিংয়ের জন্য রং এবং স্টিকার ব্যবহার করা হয়। ব্যবহৃত মৌলিক যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে ইলেক্ট্রনিক স', ম্যানুয়াল ফাইল, উড রাইটার, ম্যানুয়াল প্ল্যানার, হাতুড়ি ইত্যাদি।

শ্রমিকদের পাশাপাশি বাড়ির বউ-ছেলেমেয়েরাও টুকটাক কাজ করেন। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে ব্যাটে পুডিং লাগানো, ঘষামাজা করা, স্টিকার লাগানো, প্যাকেটজাত করা ইত্যাদি।

নারী শ্রমিক তনু মজুমদার টিবিএসকে বলেন, 'ব্যাট বানিয়ে দিলে সাধারণত দৈনিক ৩০০-৩৫০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়। আমি বাসার কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে ব্যাটের স্টিকার লাগিয়ে গত বছর প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করেছি।'

তবে কারখানার মালিক আবু বকর বলেন, 'করোনার প্রভাবে এখানকার প্রায় ২০টি ক্ষুদ্র কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এখানকার উদ্যোক্তাদের মূল সমস্যা হলো- তারা স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী জামানতবিহীন পর্যাপ্ত ঋণ পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো থেকে। এছাড়াও এলাকাটির রাস্তা কাঁচা হওয়ার কারণে যোগাযোগেও অনেক বেগ পেতে হয়।'

এ ব্যাপারে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'দেশজুড়ে ক্রিকেট ব্যাটের অন্যতম যোগানদাতা এখন যশোরের নরেন্দ্রপুর। এই গ্রামে দেশীয় প্রযুক্তিতে এখন এত বেশি ক্রিকেট ব্যাট তৈরি ও বিপণন হচ্ছে যে স্থানীয়রা এখন নরেন্দ্রপুর গ্রামকে চেনে 'ব্যাটের গ্রাম' নামে। এ পেশায় এসে ভাগ্য পরিবর্তন করে ফেলেছেন এ গ্রামের বাসিন্দারা।' 

তিনি আরও বলেন, 'করোনাকালে আমরা পিরোজপুর ও যশোরের এই ক্লাস্টারে ৫ কোটি টাকার ঋণ প্রদান করেছি, ব্যাংকগুলোকে আবারও সুপারিশ করবো তাদেরকে প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ প্রদানের জন্য, ইতোমধ্যে আমরা এই ক্লাস্টারের উদ্যোক্তাদের ঢাকায় নিয়ে কিছু ‍উন্নত প্রশিক্ষণও দিয়েছি, আগামীতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রদান ও আরও বেশি কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়ার চিন্তা রয়েছে। আমরা চাই এই নরেন্দ্রপুর গ্রামকে একটি বিশ্বমানের ক্রিকেট ব্যাট তৈরির শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে।'     

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.