শুধু ছবি আর ছবি: ষাটের দশকের ভ্যাম্প গার্ল, সোসাইটি গার্ল, ক্লাব গার্লদের ফটোবুক

ফিচার

30 July, 2022, 06:20 pm
Last modified: 30 July, 2022, 06:21 pm
১৯৬৬ সালের দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতের পাত্র-পাত্রীদের নিয়ে প্রকাশ হয় একটি ছবির বই। এ বইতে ‘এক্সট্রা’দের সংখ্যাই বেশি। সংকলক বলছেন, ‘পোস্টারে তাদের নাম আসে না। শেষে ওই যে ‘আরো অনেকে’ কথাটি লেখা হয় সেই আরো অনেকের মধ্যেই এরা পড়েন।’

এমটি রহমান ছিলেন শৌখিন আলোকচিত্রী। সম্ভবত ১৯৬৬ সালে, মানে পাক-ভারত যুদ্ধের পরের বছর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতের পাত্র-পাত্রীদের নিয়ে একটি ছবির বই প্রকাশ করেছিলেন। এতে স্থান পাওয়া মোট ৬১ জন পাত্র-পাত্রীর অধিকাংশই এক্সট্রা। 

বইটির প্রাপ্তিস্থান বলা হয়েছে ৭৭ বায়তুল মোকাররম। যারা এজেন্সি নিতে চায় তাদেরকে মালিবাগের শিল্পী কমার্শিয়াল ফটোগ্রাফারসে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। বইটির প্রকাশিকা হিসাবে নাম লেখা মিসেস নেহার বেগমের।

পাতলা খান লেনের মোনালিসা ফাইন আর্ট অ্যান্ড প্রিন্টিং প্রেসের কাজী মামুন রশিদ এমএ ছবির বইটির মুদ্রণের কাজ করেছেন। লিংকম্যান ও শিকদার ব্লক কোম্পানীর নাম লেখা আছে ব্লক মেকারস হিসাবে। বইটি বাঁধাই করা হয়েছে পাতলা খান লেনের বাবুল বাইন্ডিং ওয়ার্কসে। 

শুরুতেই বিজ্ঞাপন আকারে বলা হচ্ছে, প্রায় চারশত ছবিসহ ৩২৫ পৃষ্ঠার একটি মনোরম সংকলন। এরপর 'দুটি কথা' শিরোনামে লেখা ভূমিকা হুবহু তুলে দেওয়া হলো: 

'প্রথমেই বলে রাখি আমি লেখক নই, একজন সৌখীন আলোকচিত্র শিল্পী। ছবি তুলতে গিয়ে তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা যা জানতে পেরেছি তার কিছুটা আপনাদের জানাবার চেষ্টা করেছি মাত্র। পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র জগতের সাথে জড়িত শিল্পী, কলাকুশলীর প্রায় চারশত ছবি এ বইয়ে ছাপা হয়েছে এবং এ ছবি তুলতে গিয়ে একজন ছাড়া আর সব শিল্পীদের কাছ থেকেই আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি। তাঁদেরকে জানাচ্ছি আমি আন্তরিক ধন্যবাদ। ছাপায় এবং লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি রয়ে গেছে, আশাকরি সে জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। দ্বিতীয় সংখ্যায় বাকী চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, নাট্য এবং সৌখীন শিল্পীদের ছবি ছাপাবার আশা রইল। …

ইতি-

বিনীত

টি. রহমান'

সূচিপত্রে একষট্টিজনের মধ্যে প্রথমে আছেন রোজী, তারপর নাজনীন, তারপর শবনম, রবীন ঘোষ, সুভাষ দত্ত, আশীষ কুমার লৌহ, কবরী প্রমুখ। তারপর শ্যামা, সুপ্রিয়া গুপ্তা, আভা, শোভা, ইনাম আহমেদ, রহিমা খাতুন, রুবিনা, শহীদ, শর্মিলী, মঞ্জুশ্রী, শাহিদা রশীদ, জয়ন্তী, মুস্তফা, রেশমা, রঞ্জনা, নূরুল ইসলাম, কল্পনা, রাজ, জয়শ্রী, সিরাজ, মীরা গুপ্তা, মায়া হাজারিকা, চিত্রা জহির, সুলতানা, শওকত আকবর, জলিল আফগানি, কে কুমার, সালোনা, লবণা, তন্দ্রা, নাগিনা, সুরভী, নায়না প্রমুখ। শাবানা, রাজ্জাক, আমজাদ হোসেন, সুচন্দা, অঞ্জনাও আছেন তালিকায়। শেষ হয়েছে নৃত্যশিল্পী ঝুলা রশিদকে দিয়ে।

একটু মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, বাংলাদেশের (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম সবাক ছবি মুখ ও মুখোশ নির্মিত হয়েছে ১৯৫৬ সালে আর পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি) থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হতে শুরু করে ১৯৫৯ সালে। তাই ফটোবুকটি প্রকাশের সময় ১৯৬৬ সাল ধরলে তখনো আমাদের চলচ্চিত্রের শৈশবকাল অতিবাহিত হয়নি। সে হিসাবে তখনকার সবাই নবাগত। 

যারা তখন সরাসরি নায়ক বা নায়িকা হয়ে চলচ্চিত্রে এসেছেন তাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল যে, শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারব কি না। আর যারা ছোটখাটো রোলে এন্ট্রি করেছেন তারা স্বপ্ন দেখছেন একদিন বড় হওয়ার। 

এছাড়াও বৃদ্ধের ভূমিকায়, কাজের বুয়ার ভূমিকায়, খলনায়কের, ভ্যাম্প গার্লের, সোসাইটি গার্লের, কমেডিয়ানের, দারোয়ানের, টাইপিস্টের বা খালা-ফুপার ভূমিকায় অনেকে ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিলেন যাদের পরিচয় ছিল 'এক্সট্টা'।

এ বইতে 'এক্সট্রা'দের সংখ্যাই বেশি। সংকলক বলছেন, 'পোস্টারে তাদের নাম আসে না। শেষে ওই যে 'আরো অনেকে' কথাটি লেখা হয় সেই আরো অনেকের মধ্যেই এরা পড়েন।'

সংকলক জহির রায়হান, খান আতা আর ফতেহ লোহানীকেও শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেননি। জহির রায়হানের পোরট্রেট ছেপে যেমন বলা হচ্ছে—কখনো আসেনি, কাচের দেয়াল, সঙ্গম (এফডিসির প্রথম রঙিন ছবি), বাহানার মতো অনেক পরিচ্ছন্ন ছবি তিনি উপহার দিয়েছেন। আদমজী পুরস্কার পাওয়া হাজার বছর ধরে তারই লেখা।

বইটির মূল অংশের প্রথম পাত্রী রোজী

'নৃত্যের তালে তালে রোজী' ক্যাপশন লেখা ছবিটি পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে। তারপরের ছবিগুলোর ক্যাপশন—স্বামী ক্যামেরাম্যান সামাদসহ রোজী, উজ্জ্বল হাসিতে রোজী ও হাসিমাখা মুখে রোজী। পরিচিতি লেখা হচ্ছে এমন—নোয়াখালী জিলার লক্ষ্মীপুরে রোজী এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কবি ওয়ালীউল্লাহ সাহেবও একজন শিল্পরসিক ব্যক্তি। পিতামাতার উৎসাহে এবং নিজের প্রচেষ্টায় রোজী চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। সিনিয়র ক্যামব্রিজ পর্যন্ত পড়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তিনিই একমাত্র দীর্ঘাঙ্গী অভিনেত্রী। রোজী পিতামাতার প্রথম সন্তান। 

নাজনীনের ছবির ক্যাপশন—রাম সাগরের পাড়ে নাজনীন, কালো শাড়ি পরা সুন্দরী নাজনীন, বধুবেশে নাজনীন। পরিচিতি লেখা হচ্ছে এমন—১৯৪৪ সালে নারায়ণগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন নাজনীন। তাঁর পিতা আলী আক্স একজন অ্যাডভোকেট। নাজনীন পড়েছেন মডার্ন ও মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে। ১৯৫৯ সালে মেট্রিক পাশ করেছেন। খালু সোনা মিয়ার (কৌতুকাভিনেতা) হাত ধরে তাঁর চলচ্চিত্র জগতে অবতরণ। তারপর এই তো জীবন, শীত বিকেল, জানাজানি, পয়সে, হাম দোনো, ফির মিলেঙ্গে প্রভৃতি ছবিতে নিপুণ শিল্পী হিসেবে অভিনয় করে যান। 

নাজনীনের পর কৌতুকাভিনেতা আশীষ কুমার লৌহের পরিচিতি দেওয়া হচ্ছে। তাঁর ছবির ক্যাপশন—Loha shaving (ইংরেজীতেই লেখা) এবং আশীষ সুখটান দিয়ে তৃপ্তি মিটাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, আশীষ কুমার লৌহ ১৯৪৪ সালে ময়মনসিংহে জন্ম নিয়েছেন। তিনি আইএসসি পর্যন্ত পড়েছেন। তিনি একজন ছোট গল্প লেখকও। সম্প্রতি তাঁর ছোটগল্পের বই অনেক তারার আকাশ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি হারানো দিন ছবি দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে অবতরণ করেন। কারওয়া, বেগানা, ক্যয়সে কহু, নদী ও নারী, সুতরাং, কার বউ ইত্যাদি তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। মালাবদল তাঁর এখনো হয়নি।  

তারপর সেলিনার পরিচিতি। ছবির ক্যাপশন—বার্মিজ ছাতা সেলিনার খুব প্রিয়, Selina going for market (ছবিটিতে সেলিনা সানগ্লাস পরা), মিষ্টি হাসির দুষ্টুমিতে ইত্যাদি। সেলিনাকে নিয়ে লেখা হচ্ছে—খুলনা জিলায় জন্ম নেওয়া সেলিনার আসল নাম সাজেদা বেগম। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। স্বামী আব্দুর রউফ নাট্যকর্মী। স্ত্রীকে তিনি নাটক (থিয়েটার) দেখতে নিয়ে যেতেন। পরে সেলিনাও দু -একটি নাটকে অংশ নেন। সেলিনার উৎসাহ দেখে স্বামী তাঁকে নৃত্য শেখার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর মি. মালেকের সহযোগিতায় সেলিনা বেহুলা ছবিতে একটি এক্সটা (নৃত্যশিল্পীর) চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। পানছিবাওরা, আজ কা পানছি ছবিতে তিনি চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। 

এরপর শুরু হলো পাপিয়ার পরিচিতি। লেখা হচ্ছে—তিন অক্ষরের সুন্দর নাম পাপিয়ার মালিক যিনি তিনি সত্যিকার অর্থেও সুন্দরী। পাবনা জেলার মাছুমদিয়ায় যদিও তাঁর বাড়ি কিন্তু তাঁর জন্মস্থান করাচি। কর্মোপলক্ষে পাপিয়ার পিতা তখন করাচিতে থাকতেন। পাপিয়া সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের নয়টি দরজা পার হয়েছেন। পিতা-মাতার উৎসাহেই সফদর আলী ভূঁইয়ার কাঞ্চনমালা ছবি দিয়ে তার চলচ্চিত্রে অবতরণ। সম্প্রতি তাঁর অভিনীত ইবনে মিজান পরিচালিত জংলী মেয়ে মুক্তি পেয়েছে। এতে তাঁর অভিনয় দেখে মনে হচ্ছে তিনি শীঘ্রই চলচ্চিত্র জগতে তার অবস্থান সুদৃঢ় করে নিতে পারবেন। তিনি এখনো কুমারী। পাপিয়ার ছবিগুলোর ক্যাপশন হলো—বাড়ীর আঙ্গিনায় বসে আছে নবাগতা পাপিয়া, পার্কে পাপিয়া, বধূবেশে পাপিয়া, Teenage girl papia. 

পাপিয়ার পরে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে হায়দার শফিকে। বলা হচ্ছে, উর্দু শেখাতে গিয়ে চরিত্রের জন্য মনোনীত হওয়ার ঘটনা কি আশ্চর্যজনক নয়? হায়দার শফির ক্ষেত্রে সেটাই সত্যে পর্যবসিত হয়েছে। তিনি মুস্তাফিজ পরিচালিত তালাশ ছবির বাঙালী পাত্র-পাত্রীদের উর্দু শেখাতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর ডায়ালগ বলবার ক্ষমতা আর সুন্দর চেহারা দেখে মুস্তাফিজ তাকে ডাক্তার চরিত্রের জন্য মনোনীত করেন। সেখানে তাঁর অভিনয় উপস্থিতদের মুগ্ধ করে। সে সময় সৈয়দ আওয়াল তাঁর বালা ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছিলেন, তিনি হায়দার শফিকে নায়কের চরিত্রে চুক্তিবদ্ধ করেন। 

এর পরে আছে শ্যামা পরিচিতি। শ্যামার ছবির ক্যাপশন—প্রতিচ্ছবি (আয়নায়) এবং নৃত্যের আগে ফুলবনে শ্যামা। তাঁর সম্পর্কে লেখা হচ্ছে, রিকশাওয়ালা ছবির নায়িকা শ্যামার আসল নাম আফজাল রহমান। তাঁর পিতা এক ফার্মের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পিতাও একজন শিল্পরসিক। প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে শ্যামা মেট্রিক পাশ করেন। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমি বাফায় কত্থক, ভারতনাট্যম শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি এক রাত এবং ওয়েটিং রুম ছবিতে বিশিষ্ট ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বিয়ের ফুল তাঁর এখনো ফোটেনি।

অনেক ছবির এক্সট্রা আভার গল্প বলা হচ্ছে এরপর। ক্লাব, টুইস্ট, রক এন রোল, বাঈজি নাচকে অনেকে ভালো চোখে দেখেন না, যারা এ ধরনের নাচ করেন তাদেরও কুদৃষ্টিতে দেখে সমাজ, অথচ চলচ্চিত্রে এ ধরনের নাচ করতে যারা এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে আভা একজন। কাঞ্চনমালা, মধুমালা, অভিশাপ, জনম জনম কি পিয়াসি, উলঝান, দিল এক সীসা, তানসেন, মেরে আরমান মেরে স্বপ্নে প্রভৃতি ছবিতে আভা অভিনয় করেছেন। অভিনেত্রী শোভা তার বড় বোন। আভা এখনো কুমারী জীবন অতিবাহিত করছেন। তাঁর ছবির ক্যাপশন—twist lover miss Ava এবং আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে মিস আভা।

পান না খেলে খালার মুডই আসে না

উপরের বাক্যটি রহিমা খাতুনের ছবির ক্যাপশন। লেখা হচ্ছে, হুগলির রহিমা খাতুন এখন ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। স্টুডিওপাড়ায় তিনি খালা নামেই পরিচিত। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান চলে আসেন। হাসপাতালে মিডওয়াইফের কাজ নিয়েছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র কর্ণধার আব্দুল জব্বার খান মুখ ও মুখোশের একটি বৃদ্ধা চরিত্রের জন্য একজনকে খুঁজছিলেন, রহিমা খাতুনকে তিনি ওই চরিত্রে নির্বাচিত করেন আর সেটিই তার প্রথম ছবি। এরপর তিনি আকাশ আর মাটি, সূর্যস্নান, সোনার কাজল, জোয়ার এলো, নাচঘর, ধারাপাত প্রভৃতি ছবিতে সাফল্যের সহিত অভিনয় করেন। তাঁর একটি মস্ত গুণ তিনি সব সমাজে, সবার সাথে অতি সহজে মিশে যেতে পারেন। তাঁর দুই ছেলে এক মেয়ে কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বামীর ঘর তিনি করতে পারেননি। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি বিধবা হন।

কৌতুকাভিনেতা মন্জুর পরের এন্ট্রি। তিনি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। দেশভাগের পর পূর্বপাকিস্তানে আসেন। রাজধানীর বুকে ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করবার সুযোগ পান। এখন তিনি পরিচালকের খাতায়ও নাম লেখাচ্ছেন। তাঁর লেখা ও পরিচালনায় প্রথম ছবি সমাপ্তির মহরত হয়ে গেল সম্প্রতি।

তারপর আছেন শর্মিলী। তাঁর ছবির ক্যাপশন, চিন্তিত শর্মিলী। বজলুর রহমান পরিচালিত উর্দু ছবি ঠিকানার নায়িকা লিলি ওরফে মাজেদা খাতুন ওরফে শর্মিলী। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন, তবে এখন রাজশাহীর স্থায়ী বাসিন্দা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এমএ অধ্যয়নরতা। রূপকার পরিচালিত পানছিবাওরায় বর্তমানে তিনি নায়িকার চরিত্র চিত্রণে ব্যস্ত রয়েছেন।

ডকুমেন্টারি ছবি (বিজ্ঞাপনচিত্র) টিবেট স্নোতে পরিচয়হীনা যে ভদ্রমহিলা অভিনয় করে মানুষের মনে দাগ কেটেছিলেন তিনিই হলেন ফকরুল আলম পরিচালিত মানুষ অমানুষ ছবির নায়িকা মঞ্জুশ্রী। শর্মিলীর পরের এন্ট্রি মঞ্জুশ্রীর।

কৃষ্ননগরে মঞ্জুশ্রী বিশ্বাসের জন্ম, বর্তমান নিবাস পাবনা, শিক্ষাগত যোগ্যতা মেট্রিক। গল্পলেখিকা হিসাবেও তাঁর নাম আছে। অভিনেত্রী হবার ইচ্ছা তার ছিল না, কিন্তু প্রীত জানে না রীত ছবিতে অফার পেয়ে অভিনয়ে নেমে পড়েন এবং পরে আরো অনেক ছবিতে অভিনয় করেন। ২২টি বসন্ত পেরিয়ে গেলেও বিয়ে তিনি সহসা কাউকে বিয়ে করবেন না।

মঞ্জুশ্রীর ছবিগুলোর ক্যাপশন এমন—আগুন নিয়ে খেলার শুটিং অবসরে শওকত আকবরসহ মঞ্জুশ্রী, সোসাইটি গার্লের ভূমিকায় ও নাচের মহড়ায়।

তারপর দেওয়া হচ্ছে শাহিদা রশীদের পরিচিতি। তিনি নিজাম এস্টেট হায়দ্রাবাদে ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। উর্দু মিডিয়ামে মেট্রিক পাশ করেছেন। আব্দুল জাব্বার খানের নাচঘর ছবিতে প্রথম তিনি অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। তারপর দুবছর বিরতি শেষে মালান ছবিতে অফার পেয়ে ফিরে আসেন আর একে একে আব ক্যায়া হোগা, উনকে রাহে, পিয়াসে, লাখো মে এক, উলঝান ছবিতে অভিনয় করেন। মিসেস শাহিদা রশীদ বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসেন।

জয়ন্তীর পরিচয় দিতে গিয়ে সংকলক বলছেন, 'সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী জয়ন্তীকে আমি এতোদিন হিন্দু বলেই জানতাম। হঠাৎ ফটো তুলতে গিয়ে সে ভুল আমার ভেঙে গেল। পিতার নাম জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, মনজুর রহমান। আমি আঁতকে উঠলাম, সে কী! সে বলল, হ্যাঁ আমরা মুসলমান।'

তাঁর জন্মস্থান কলকাতা, দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তাঁরা প্রথমে খুলনা ও পরে ঢাকা আসেন। তার পিতা একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ আলোকচিত্রী। গেন্ডারিয়ার মডার্ন স্টুডিওর তিনি মালিক। আসিয়া ছবিতে তিনি প্রথম একটি ছোট রোল করেন। তারপর কসকো সোপ ডকুমেন্টারিতে অভিনয় করেন। আওর গম নেহী, রাজা সন্ন্যাসী, চাওয়া পাওয়া তার অভিনীত ছবি। তিনি ক্লাব ডান্স, টুইস্ট, বাঈজি ইত্যাদি সব নৃত্যই প্রদর্শন করতে পারেন। অবসরে ঘরকন্না, সেলাই ও বই পড়তে ভালোবাসেন। সুন্দরী জয়ন্তীর বিয়ের ফুল কিন্তু এখনো ফোটেনি।

রেশমা ছিলেন জমিদার বাড়ির মেয়ে

বিখ্যাত বলিয়াদী জমিদার ফ্যামিলির মেয়ে ছিলেন রেশমা। তাঁর পিতা মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৬০ সালে মেট্রিক পাশ করেন। হলিক্রস কলেজ থেকে তিনি আইএ পাশ করেছেন। ঢাকায় ড্রামা সার্কেল নামে তখন যে নাটকের দল ছিল তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রেশমা। তাঁর আসল নাম আজমেরী জামান। এ নামেই তিনি রেডিওতে অভিনয় করতেন।

সংকলক বলছেন, 'গত পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে অনেক জ্বালাময়ী কথিকা রেডিওতে প্রচার করে সৈনিক ও মানুষের মনে সাহস সঞ্চার করেছেন। তাহের চৌধুরী পরিচালিত জিনা ভি মুশকিল হ্যায় ছবির মাধ্যমে তিনি প্রথম চলচ্চিত্রে অবতরণ করেন।'

এবার সালাউদ্দিনের রূপভান ছবির তাজেল চরিত্রে রুপদানকারী চন্দনার পরিচয় বলা হচ্ছে। এই ছবি দিয়েই মিস চন্দনার পরিচিতি পূর্ব পাকিস্তানের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। বজলুর রহমানের গুনাই ছবিতে তিনি প্রথম সুযোগ পান নায়িকা হবার, মহুয়া ছবিতেও তিনি ছিলেন নায়িকা, তারপর বনবাসে রূপভানজরিনা সুন্দরীতেও তিনি অভিনয় করেন। অভিনেত্রী রঞ্জনা তার সহোদরা। সংকলক বলছেন, 'মন দেয়া-নেয়া তিনি (চন্দনা) করেছেন কি না জানি না তবে মালা বদলের চিন্তা এখনো করেননি।'

পিতা-মাতার কাছে ফরি বা ফরিদা বলে পরিচিত মায়া হাজারিকা ছোটবেলা থেকেই শিল্পের পূজারি। জুনিয়র ক্যামব্রিজ পর্যন্ত তিনি পড়েছেন, জন্মেছেন ভারতের শিলংয়ে। তিনি বাংলা লিখতে ও বলতে পারেন। ভ্যাম্প গার্লের চরিত্রই তাকে বেশি মানায় আর তিনিও সেই চরিত্র করতে পছন্দ করেন। বৃদ্ধার চরিত্রেও অভিনয় করেন। ক্যায়সে কাহু, গুনাই বিবি তার মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। ছবির ক্যাপশন—শিশুদের পছন্দ করেন মায়া, ভ্যাম্প গার্ল মায়া ইত্যাদি।

জলিল আফগানী এসেছেন মাদ্রাজ থেকে

১৯৫৮ সালে জলিল আফগানী পাকিস্তানে আসেন। মূলত ছিলেন কৌতুকাভিনেতা। চান্দা তার অভিনীত প্রথম সিনেমা। তারপর প্রীত জানে না রীত, কারাওয়া, মিলন, সাত রং, উলঝান, মালা ইত্যাদি তাঁর অভিনীত ছবি।

বইতে বলা হচ্ছে, তিনি বেওয়াকুফ নামে যে ছবিটির পরিচালনা সম্প্রতি শেষ করেছেন সেটি মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আরো যে দুটি ছবির নির্মাণ জলিল আফগানী শুরু করতে যাচ্ছেন সেগুলোর নাম শাহী লুটেরা এবং জঙ্গল কি আগ

আফগানী সাহেব বিবাহিত। ছয়টি সন্তানের জনক।

তারপর আসে সালোমীর কথা যিনি ১৯৬৪ সালে কোলকাতায় এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানকার এক কনভেন্টে তিনি মেট্রিক পর্যন্ত পড়েছেন। তখনই মুসলমান এক যুবকের প্রেমে পড়েন আর পরে তাঁরা বিয়ে করে পাকিস্তান চলে আসেন এবং ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

অতিথিশিল্পী হিসাবে বেওয়াকুফ ছবিতে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন সালোমী। তারপর অভিনয় করেন জংলী ফুল ছবিতে। সোসাইটি গার্ল এবং ভ্যাম্প রোলে অভিনয় করতে পছন্দ করেন। টুইস্ট ডান্স এবং ক্লাব ডান্সে পারদর্শী। সালোমীর ছবির ক্যাপশন—সোসাইটি গার্ল সালোমী এবং হ্যাট পরিহিতা সালোমী।

সালোমীর পরই নাগিনার কথা পাওয়া যায়। তাঁর আসল নাম সাবিহা। গুনাই ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন, তারপর ভাইয়াউলঝানে। প্রেমে কারুর সাথে না পড়লেও যৌবনে তিনি পদার্পন করেছেন। ঢাকায় তিনি জন্মগ্রহণ করলেও বাংলা লিখতে পারেন না তবে উর্দু ভালো বলতে পারেন। পঞ্চদশী নাগিনা তার সুন্দর মুখের জন্য উন্নতি করবেন—এ আশা রাখছেন সংকলক এবং আরো জানাচ্ছেন, টুইস্ট, ক্লাব, বাঈজী ও সাঁওতালি নাচে সালোমী খুব পারদর্শী।

সাইদা বানু ও ঝুলা রশিদ দিয়ে শেষ

নায়না নামের সিনেমার মেয়েটির আসল নাম সাইদা বানু। রাওয়ালপিন্ডিতে তার জন্ম হলেও শৈশব ও যৌবনের অনেকটা কেটেছে বোম্বেতে (এখনকার মুম্বই)। ওখানে থাকার সময়ই তিনি পরিচালক ওয়াস্তির ব্যসরে কিসলু ছবিতে অভিনয় করেন।

পাকিস্তানে সাইদার প্রথম ছবি পরিচালক হুমায়ুন মীর্জার বড়া আদমী। তারপর পহেলা কদম, রাত কে রাহী, ইনসাফ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। পূর্ব পাকিস্তানে তিনি বেবী ইসলাম পরিচালিত তানহা ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। চরিত্রাভিনেতা গরজ বাবু তাঁর স্বামী ছিলেন কিন্তু কিছুদিন হলো তাঁর কাছ থেকে তিনি তালাক নিয়েছেন।

বইটির শেষ এন্ট্রিতে আছেন ঝুলা রশিদ নামের এক নারী নৃত্যশিল্পী। সংকলক বলছেন, একটি ছন্দময় নাম ঝুলা রশিদ। নৃত্যসাধনার মধ্য দিয়েই তিনি পেয়েছেন অনেক প্রশংসা, অনেক স্বীকৃতি। নক্সীকাঁথার মাঠ, অধিক খাদ্য ফলাও, জ্বলছে আগুন ক্ষেতে খামারে, সোনার ফসল প্রভৃতি একাধিক নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করে তিনি দর্শকসমাজে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

১৯৫৮ সালে ঝুলা রশিদ বাফায় ভর্তি হন। জি এ মান্নান তাকে যত্ন করে নাচ শিখিয়েছেন। পরবর্তীতে অজিত দের নিকট ক্লাসিক্যাল এবং সমর দে'র নিকট কত্থক ও ভারতনাট্যম শেখেন।

বর্তমানে ঝুলা নিক্কন ললিতকলা কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত। তিনি বহু রাষ্ট্রীয় অতিথির সামনে নৃত্য পরিবেশন করেছেন, তাদের মধ্যে গণচীনের চেয়ারম্যান লিও শাও চি, নেপালের রাজা মহেন্দ্র, মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট নে উইন, কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, মহামান্য আগা খান এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান উল্লেখযোগ্য। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.