৪১ বছর ধরে ভুয়া পরিচয়ে জমিদারের ছেলে হয়ে ছিলেন যে লোক!

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
05 July, 2022, 10:05 pm
Last modified: 06 July, 2022, 11:08 am
১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎই উধাও হয়ে গেল বিহারের নালন্দা জেলার প্রভাবশালী জমিদার পরিবারের একমাত্র ছেলে কানহাইয়া সিং। এর পর যা ঘটে, তা কোনো অংশেই থ্রিলার উপন্যাসের চেয়ে কম নয়।

১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎই উধাও হয়ে গেল বিহারের নালন্দা জেলার প্রভাবশালী জমিদার পরিবারের একমাত্র ছেলে কানহাইয়া সিং। কিশোর কানহাইয়া সেদিন পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। স্বভাবতই বাবা-মা উদ্বিগ্ন হয়ে পুলিশে রিপোর্ট করেন। আশা ছিল, শীঘ্রই খুঁজে পাওয়া যাবে কানহাইয়াকে। কিন্তু এরপর কেটে গেছে ৪১টি বছর। কানহাইয়ার প্রত্যাবর্তন নিয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল এক রহস্যের জাল, যার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে শঠতা, প্রতারণা, মিথ্যে আশা। কিন্তু কানহাইয়া এখনো জীবিত না মৃত,  তা-ও কেউ জানে না!

ফিরে যাওয়া যাক ৪১ বছর আগের বিহার প্রদেশের মুরগাওয়ান গ্রামে। কানহাইয়া সিং উধাও হওয়ার বেশ কিছুদিন পরেও তাকে খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। ছেলের চিন্তায় জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে কানহাইয়ার বাবা কামেশ্বর সিংয়ের জীবন; হতাশায় মুষড়ে পড়েন তিনি। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ভরসা দিয়ে বলেন, কানহাইয়া বেঁচে আছে, খুব তাড়াতাড়িই সে বাড়ি ফিরবে।

এর চার বছর পর, ১৯৮১ সালে বছর বিশেকের এক যুবক এসে হাজির হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামে। নিখোঁজ কানহাইয়ার বাড়ি মুরগাওয়ান থেকে সেই গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। গেরুয়া পোশাক পরা ছেলেটি জানায়, গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে। এ-ও জানায় যে, সে মুরগাওয়ান গ্রামের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির ছেলে। তারপর কী হয়েছে, তা স্পষ্ট জানা না গেলেও, গুজব রটে যায় যে এই ছেলেই জমিদার কামেশ্বর সিংয়ের হারিয়ে যাওয়া ছেলে কানহাইয়া সিং। এই খবর শুনে কামেশ্বর সিং নিজে ছেলেটিকে দেখতে আসেন। আশেপাশের প্রতিবেশীরাও বলে, এই ছেলেই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কানহাইয়া! অতএব, ছেলেটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন জমিদার।

পুলিশি রেকর্ড থেকে জানা যায়, কামেশ্বর তখন বলেছিলেন, "আমার বয়স হয়েছে, দৃষ্টিশক্তি কমে গিয়েছে, তাকে ভালোমতো চিনতে পারছি না। তোমরা যদি বলো সে-ই আমার ছেলে, তাহলে আমি ওকেই বাড়িতে রাখব।"

বিহারের ছোট্ট গ্রাম মুরগাওয়ানে ১,৫০০ লোকের বাস। ছবি: রনি সেন

চারদিন পর কানহাইয়ার মা রামলক্ষ্মী দেবী পাটনা থেকে বাড়ি ফিরে এসে ছেলের প্রত্যাবর্তনের খবর জানতে পারেন। কিন্তু ছেলেটিকে দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, এই ব্যক্তি আসলে কানহাইয়া সিং নয়। রামলক্ষ্মীর দাবি, তার ছেলে কানহাইয়ার কপালের বাম পাশে কাটা দাগ ছিল। ওই তরুণ তার নিজ স্কুলের একজন শিক্ষককে চিনতেও ব্যর্থ হয়। কিন্তু কামেশ্বর সিং বিশ্বাস করেন, এই লোকটিই তার আসল ছেলে কানহাইয়া।

এর কিছুদিন পরে রামলক্ষ্মী দেবী ওই যুবকের বিরুদ্ধে জাল পরিচয় দেওয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। অল্প কিছুদিন পরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও মাসখানেক জেল খেটেই তিনি জামিনে মুক্তি পান। এর পরের চার দশকে যা ঘটেছে, তা যেন রোমাঞ্চ উপন্যাসকেও হার মানাবে!

জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরেও নতুন এক পরিচয় ধারণ করেন ওই ব্যক্তি। সেই পরিচয়ে তিনি কলেজে যান, বিয়ে করেন, সংসার করেন এবং একাধিক জাল পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কাজ হাতিয়ে নেন। জাল ভোটার আইডি ব্যবহার করে তিনি ভোট দেন, আয়কর পরিশোধ করেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য বায়োমেট্রিক দেন, বন্দুকের লাইসেন্স পান এবং কামেশ্বর সিংয়ের ৩৭ একর সম্পত্তি বিক্রি করে দেন!

কিন্তু তিনি ওই জমিদারের মেয়ের সঙ্গে ডিএনএন পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে অস্বীকৃতি জানান, যাতে প্রমাণ হতো যে তারা সত্যিই ভাইবোন কি না। এমনকি নকল 'ডেথ সার্টিফিকেট' তৈরি করে তিনি নিজের আসল পরিচয়ও মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন!

এই ছদ্মবেশীর মামলাটি ভারতের কচ্ছপগতির আইনি প্রক্রিয়ার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই মুহূর্তে ভারতের বিভিন্ন আদালতে ১ লাখ ৮০ হাজার মামলা ঝুলে আছে, যেগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কাগজপত্রে ছদ্মবেশী ব্যক্তি নিজেকে 'কানহাইয়াজি' হিসেবে পরিচয় দেন।

এবার গল্পের নাটের গুরুটির আসল পরিচয় জানা যাক! বিহারের জামুই জেলার এক গ্রাম থেকে উঠে আসা এই ছদ্মবেশীর আসল নাম দয়ানন্দ গোঁসাই। আসল কানহাইয়ার গ্রাম থেকে তার বাড়ি প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে।

১৯৮২ সালে দয়ানন্দ গোঁসাইয়ের নিজের বিয়েতে তোলা একটি সাদাকালো ছবি পাওয়া যায়। ছবিতে বরের বেশে, গোঁফওয়ালা একজনকে দেখা যায়। কিন্তু মুশকিল হলো, জমিদার কামেশ্বর সিংয়ের বাড়িতে প্রবেশের পর থেকে তাকে নিয়ে এত বেশি গুজব-গল্প রটেছে যে সেখান থেকে সত্যটাকে ছেঁকে আলাদা করা কঠিন।

দয়ানন্দ গোঁসাইয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কাগজপত্রে তার জন্ম তারিখও বিভিন্ন রকম। হাইস্কুলে তার জন্ম সাল ১৯৬৬, আবার জাতীয় পরিচয়পত্রে ১৯৬০ এবং ভোটার পরিচয়পত্রে তার জন্ম সাল ১৯৬৫। আবার খাদ্যের রেশন কার্ড অনুযায়ী তার জন্ম সাল ১৯৬৪। দয়ানন্দের পরিবার জানিয়েছে, দয়ানন্দ গোঁসাইয়ের আসল জন্ম সাল অনুযায়ী, তিনি ৬২ বছরে পা রাখতে যাচ্ছেন। 

দয়ানন্দ গোঁসাইয়ের ১৯৮২ সালের ছবি। ছবি: রনি সেন

তদন্তে জানা যায়, জামুই জেলার এক কৃষকের চার সন্তানের একজন হলেন দয়ানন্দ গোসাঁই। ১৯৮১ সালে বাড়ি ছাড়েন তিনি। অল্প বয়সে বিয়ে করলেও তা বেশিদিন টেকেনি; কোনো সন্তানও হয়নি। দয়ানন্দের স্ত্রী তাকে ছেড়ে যান এবং আবার বিয়ে করেন। শুধু তাই নয়, দয়ানন্দের নিজ গ্রামেও সবাই জানত যে তিনি নালন্দার জমিদার কামেশ্বর সিংয়ের সঙ্গে বাস করছেন। পুলিশ জানায়, স্থানীয় এক কলেজ থেকে ইংরেজি, রাজনীতি ও দর্শন বিষয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রিও নিয়েছেন দয়ানন্দ। তার পরীক্ষার ফলাফলও ছিল সন্তোষজনক।

পরের সংসারে দয়ানন্দ গোঁসাইয়ের দুই ছেলে এবং তিন মেয়ে রয়েছে। জমিদার কামেশ্বর সিংয়ের মৃত্যুর পর তার শতবর্ষী দোতলা বাড়ির অর্ধেকটার দখল নেন দয়ানন্দ।

দয়ানন্দের বড় ছেলে গৌতম কুমার জানান, তার বাবা সাধারণত ঘরেই বসে থাকতেন এবং ৩০ একরের মতো জমি দেখাশোনা করতেন। জালিয়াতির মাধ্যমে দখলকৃত এই জমিতে তিনি ধান, গম আর ডালের চাষ করতেন। গৌতম জানান, তাদের পরিবারে কখনোই দয়ানন্দের ভুয়া পরিচয়ের প্রসঙ্গে কথা ওঠেনি।

"তিনি আমাদের বাবা। আমার দাদা যদি তাকে নিজের ছেলে হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে আমাদের আপত্তি কিসের? আর নিজের বাবাকে বিশ্বাস না করলে চলবে কীভাবে!" বলেন গৌতম। তিনি আরো বলেন, "এত বছর পর এসেও আমাদের পরিচয় সুতোয় ঝুলছে, কারণ আমাদের বাবার পরিচয় কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।"

আদালতে বিচারকদের প্রশ্নের বেশ চটপট উত্তরই দিয়েছিলেন দয়ানন্দ। বিচারক মিশ্রা তার কাছে জানতে চান, ভেক ধরার আগে তিনি কোথায় থাকতেন, কার সঙ্গে থাকতেন। জবাবে দয়ানন্দ জানান, তিনি উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে এক সন্ন্যাসীর আশ্রমে ছিলেন; যদিও এই দাবির সপক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। দয়ানন্দ এ-ও বলেন যে, তিনি কোনোদিন নিজেকে জমিদারের ছেলে বলে দাবি করেননি।

"জমিদার নিজেই আমাকে ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমি ভুয়া পরিচয় দিয়ে কাউকে ঠকাইনি। কারণ আমিই কানহাইয়া।"

নিজের মেয়ের সঙ্গে দয়ানন্দ গোঁসাই (সবার বাঁয়ে), খাটে বসে আছেন কামেশ্বর সিং। ছবি: রনি সেন

কিন্তু ১৬ বছর বয়সে উধাও হয়ে যাওয়া কিশোর কানহাইয়াকে মুগাওয়ান গ্রামের কেউ মনে রাখেনি। সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী স্মৃতিচারণ করে জানান, "কানহাইয়া ছিল লাজুক স্বভাবের একটা ছেলে। আমরা একসাথে বড় হয়েছি। তারপর হঠাৎ একদিন সে উধাও হয়ে গেল, তাতেই এত শোরগোল। কিন্তু ৪ বছর পর যেই লোক ফিরে এলো জমিদারের বাড়িতে, তার সাথে কানহাইয়ার মিল নেই। কিন্তু কামেশ্বর সিং তখন পুত্রশোকে কাতর এবং তিনি জোর দাবি করলেন যে এই লোকই তার ছেলে। এরপর আমাদের আর কী-ই বা করার ছিল!"

জমিদার কামেশ্বর সিং ১৯৯১ সালে মারা যান, রেখে যান ৬০ একরেরও বেশি সম্পত্তি। তিনি গ্রাম্য কাউন্সিলের নেতা ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সংসদের সদস্যদের সঙ্গেও তার বেশ সখ্য ছিল। কামেশ্বর সিংয়ের ৭ মেয়ের পর কানহাইয়া ছিল তার একমাত্র ছেলে। তাই পুত্র হারানোর শোকে কাতর ছিলেন তিনি। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, শুরুতে কামেশ্বর পুলিশকে বলেছিলেন, দয়ানন্দ তার ছেলে না, এটা প্রমাণিত হলে তাকে ফেরত দিয়ে দেবেন। কিন্তু  তিনি কখনোই থানায় যাননি, উলটো দয়ানন্দকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

চার দশক যাবত প্রায় এক ডজন বিচারকের হাত ঘুরেছে কানহাইয়া সিং নিখোঁজ মামলা। অবশেষে টানা ৪৪ দিনের শুনানি সম্পন্ন হবার পর গত এপ্রিলে আদালত চূড়ান্ত রায় দেন। বিচারক মিশ্রা দয়ানন্দ গোঁসাইকে ভুয়া পরিচয় দিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন।

দয়ানন্দের ছেলে গৌতম কুমার বলছেন, তার বাবা জালিয়াত, এ কথা তিনি বিশ্বাস করেন না। ছবি: রনি সেন

আদালতের রায় নয়ে গৌতম কুমার বলেন, "আমরা এই মামলাকে কখনো অত গুরুত্ব দেইনি। বাবার পরিচয় নিয়ে আমাদের মনে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু আমাদের আসলে উচিত ছিল যথেষ্ট প্রমাণ জোগাড় করা।

এদিকে নকল 'ডেথ সার্টিফিকেট' এই মামলায় আরো জটিলতা সৃষ্টি করে। সেখানে লেখা দয়ানন্দ গোঁসাই ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে মারা গেছেন, যদিও মৃত্যু সনদের তারিখ ছিল ২০১৪ সালের মে মাসের! কিন্তু স্থানীয় পুলিশ বা আদালত কেউই দয়ানন্দ গোঁসাইয়ের মৃত্যুর প্রমাণ পায়নি। পরে দেখা যায়, নিজেকে কানহাইয়া প্রমাণ করতে 'দয়ানন্দ গোসাঁই' পরিচয়কে চিরতরে মাটিচাপা দিতে চেয়েছিলেন দয়ানন্দ। পুলিশের বিশ্বাস, মুরগাওয়ান গ্রামের আরো কিছু মানুষের যোগসাজশে এই দয়ানন্দকে জমিদারবাড়ির ছেলে হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিচারকের ধারণা, দয়ানন্দ নিজেকে কানহাইয়া পরিচয় দিয়ে জমিদারের কাছ থেকে আদায় করা জমি স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে।

১৯৯৫ সালে কানহাইয়ার মা রামলক্ষ্মী দেবী মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনিও দাবি করেছিলেন, তার পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। তার অসুস্থ স্বামীর দুর্বল দৃষ্টিশক্তির সুযোগ নেওয়া হয়েছে।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নকল কানহাইয়ার বিক্রি করা জমি কি সাবেক জমিদার পরিবার ফেরত পাবে? কখন এবং কীভাবে দয়ানন্দের এই ভুয়া পরিচয়ের ইতি টানা হবে?

দয়ানন্দ গোঁসাইয়ের ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেট, ১৯৮২ সালের।

তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কানহাইয়া এখন কোথায়? ভারতীয় আইন অনুযায়ী, কেউ নিখোঁজ হওয়ার পর ৭ বছর পেরিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পুলিশ এখনো কানহাইয়ার মামলা বন্ধ করেনি। তাহলে কি আসল কানহাইয়া বেঁচে আছেন?


  • সূত্র: বিবিসি
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.