‘যত দ্রুত সম্ভব সবাইকে কোভিড-১৯ বুস্টার শট দিতে হবে’

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক 
01 August, 2021, 03:20 pm
Last modified: 01 August, 2021, 03:25 pm
শতভাগ কার্যকর টিকার অভাবে এই মানুষগুলো পরিণত হবেন চলন্ত বাহকে। এই সুযোগে করোনার বর্তমান ধরনগুলো রূপান্তরিত হতে হতে জন্ম নেবে টিকাকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন ধরন।

২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নোভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে বিশ্ব। ৪২ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এ ভাইরাসের সংক্রমণে। এখনো ভাইরাসটির বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়নি। অদূর ভবিষ্যতেও যে করোনার বিস্তার রোধ করা যাবে, সেরকম কোনো লক্ষণ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রে ফের নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে নতুন সংক্রমণের ঘটনা ১৩১ শতাংশ বেড়ে গেছে। টিকা বেশ কার্যকর হলেও কয়েক মাস পর এর কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। এই সুযোগে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের মতো ষাটোর্ধ্বদের টিকার তৃতীয় ডোজ দেওয়ার চিন্তা চলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অবশ্য মধ্য ও নিম্ন আয়ের দরিদ্র দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষকে টিকার প্রাথমিক ডোজ দেওয়ার আগে ধনী দেশগুলোতে তৃতীয় ডোজ দেওয়ার বিরোধিতা করেছে। তাদের এই বিরোধিতা ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা নাকে ও মুখে করে করোনার ডেল্টা ধরন বহন করতে পারেন। তাদের সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত হতে পারেন টিকা না নেওয়া ব্যক্তিরা।

শতভাগ কার্যকর টিকার অভাবে এই মানুষগুলো পরিণত হবেন চলন্ত বাহকে। এই সুযোগে করোনার বর্তমান ধরনগুলো রূপান্তরিত হতে হতে জন্ম নেবে টিকাকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন ধরন।

এজন্য তৃতীয় ডোজ টিকা নেওয়ার ব্যাপারটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত। প্রথম দেশ হিসেবে দেশের সব মানুষকে গণটিকার আওতায় এনেছিল ইসরায়েল। তারপর দেশটি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক চলাফেরার অনুমতি দেয় নাগরিকদের, তুলে নেয় সব বাধ্যবাধকতা। কিন্তু জুলাইয়ে ইসরায়েলে পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা নতুন করে ডেল্টা ধরনে সংক্রমিত হতে থাকেন।

টিকা নেওয়ার পরও করোনায় সংক্রমিত হলে মৃত্যুর আশঙ্কা না থাকলেও ভোগান্তি কম পোহাতে হয় না। আক্রান্ত ব্যক্তিকে কয়েক মাস ধরে তীব্র অবসাদ, বিষণ্ণতা, দুর্বলতা, স্মৃতিবিভ্রাটে ভুগতে হয়।

প্রাকৃতিকভাবে বা টিকার মাধ্যমে—যেভাবেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হোক না কেন, একজন মানুষ দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হলে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য চারটি জিনিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে করোনাভাইরাসের পৃষ্ঠ থেকে বেরিয়ে থাকা স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক অ্যান্টিবডি তৈরি করা। এই স্পাইক প্রোটিনের কারণে ভাইরাস মানুষ ও সব স্তন্যপায়ীর দেহকোষে দৃঢ়ভাবে যুক্ত হয়ে যায়। এই শত্রুকে পরাজিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে অ্যান্টিবডির।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো 'বি' সেল। অ্যান্টিবডি তৈরি হয় 'বি' সেলে। বি সেল হলো রক্ত ও লসিকায় শ্বেতণিকা। এই বি সেলগুলোকে 'স্মৃতি' ধরে রাখে। অর্থাৎ অ্যান্টিবডি ছাড়ার কথা মনে রাখে। বি সেলগুলো করোনাভাইরাসকে চেনে এবং একে নিষ্ক্রিয় করার জন্য অ্যান্টিবডি উৎপন্ন করে।

কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য অপরিহার্য তৃতীয় উপাদান হলো সেসব অ্যান্টিবডি যারা ভাইরাসের অন্যান্য অংশকে আক্রমণ করে। এর ফলে করোনাভাইরাস মানবকোষে প্রবেশ করতে পারে না। সর্বশেষ অপরিহার্য উপাদান হলো 'সিডি৮' ও 'সিডি৪' সেল। এদের আহ্বানে শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা ভাইরাসকে খেয়ে ফেলে এবং শরীরের প্রতিটি প্রতিরক্ষা অঙ্গ সতর্ক হয়ে ওঠে।

এমআরএনএ প্রযুক্তির টিকাসহ বাকি সব টিকাই এই কাজগুলো করে। তবে একেক টিকার কর্মক্ষমতা একেক রকম। বিশেষ করে ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে এই কার্যকারিতার পার্থক্য অনেক বেড়ে যায়।

যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে করোনার প্রথম তিনটি ধরন ছড়িয়ে পরার পরও বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এগুলোর বিরুদ্ধে টিকা বেশ কার্যকর। কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছে, ততই করোনার এই পরিবর্তিত রূপগুলোর বিরুদ্ধে টিকা কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন এই ধরনগুলোর বিপক্ষে নিষ্ক্রিয়করণ অ্যান্টিবডি তুলনামূলক কম তৈরি হয়। যদিও টিকা এখনও পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। কিন্তু গবেষকরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, জনসংখ্যার বড় একটি অংশকে টিকার আওতার বাইরে রাখলে এরচেয়েও বিপজ্জনক ধরনের আবির্ভাব ঘটতে পারে। ফলে গুরুতর বিপদে পড়তে পারে টিকাবঞ্চিত এবং টিকা নিতে অনিচ্ছুক জনগোষ্ঠী।

গবেষকদের আশঙ্কাকে অনেকাংশে সত্যি প্রমাণিত করে গত মধ্য-মার্চে ভারতজুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে করোনার ডেল্টা ধরন। দেশটিতে জুলাইয়ের মধ্যে সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে ৪ লক্ষ মানুষ মারা যান। বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশই এখন ডেল্টার বিরুদ্ধে যুঝছে। চীনেও নতুন করে শুরু হয়েছে সংক্রমণ। করোনা মহামারির প্রকোপে বিধ্বস্ত আফ্রিকা মহাদেশ।

ডেল্টা ধরন অসংখ্যবার রূপান্তরিত (মিউটেশন) হওয়ার কারণে এটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। দেহকোষের সঙ্গে ভাইরাসকে যুক্ত করে যে স্পাইক প্রোটিন, সেটিও বদলে গেছে ডেল্টা ধরনে। ফলে এ ধরনকে আটকানো শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে গেছে। ভাইরাসটি এখন অনেক বেশি দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে নিজের অনুলিপি তৈরি করতে পারে। ডেল্টা ধরন করোনার প্রথম ধরনের চেয়ে প্রায় এক হাজারগুণ বেশি সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন।

এসব কারণে যারা এখন ভাইরাসটির বাহক হিসেবে কাজ করেন, তারা সে কথা জানতেও পারেন না। কারণ ডেল্টা ধরন শরীরে প্রবেশ করলে এখন কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না।

ফাইজার জানিয়েছে, টিকার কার্যকারিতা প্রতি মাসে ৬ শতাংশ করে কমে। ছয় মাস পর ভাইরাস আটকানোর আসল কাজ করে 'বি' সেল। কিন্তু ডেল্টা ধরনে ভাইরাসের সংখ্যা একে তো অনেক বেশি থাকে, তার ওপরে এই ধরন শরীরে প্রবেশ করে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। এ কারণে পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়ার ছয় থেকে আট মাস পর ডেল্টা ধরনকে আটকানো 'বি' সেলের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে।

সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, টিকা নেওয়া এই ব্যক্তিদের নাক ও গলার ভেতর শত শত কোটি ভাইরাস ঢুকে যেতে পারে। এই মানুষগুলো তখন পরিণত হবেন ভাইরাসের বাহকে। টিকা না নেওয়া ব্যক্তি আক্রান্ত হলে তার মৃত্যুর ঝুঁকি তখন অনেক বেশি থাকে। এ কারণে ইসরায়েল তৃতীয় রাউন্ড টিকা দেওয়া শুরু করেছে।

ফাইজার আমেরিকাকেও তৃতীয় ডোজ টিকাদান কার্যক্রম শুরু করার অনুরোধ করেছে। এদিকে আমেরিকা ২১ দিনের ব্যবধানে দুই ডোজ টিকা দিয়েও সম্ভবত ভুল করেছে। গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, দুই ডোজ টিকা মধ্যে যেন অন্তত কয়েক মাসের—সম্ভবত ছয় মাস—ব্যবধান থাকে। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা থিতু হওয়ার সময় পায়।

গোটা বিশ্ব এমন এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে যা প্রতিনিয়ত রূপ বদলাচ্ছে। এই ভাইরাসকে যত বেশি সময় দেয়া হবে এটি সম্ভবত তত বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এ বিপদ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় সব দেশের সিংহভাগ মানুষকে গণটিকার আওতায় আনা—এবং সম্ভব হলে তৃতীয় ডোজ টিকা দেওয়া।


  • সূত্র: ফরেন পলিসি

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.