‘ব্ল্যাক উইডো’ কিলার: সায়ানাইড দিয়ে প্রেমিকদের হত্যা করতেন যে বৃদ্ধা

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
26 September, 2021, 04:55 pm
Last modified: 26 September, 2021, 06:53 pm
তিন প্রেমিককে খুন ও একজনকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে ৭৪ বছর বয়সী চিসাকো কাকেহির মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অবশ্য সেই রায় এখনো কার্যকর হয়নি।

৭৫ বছর বয়সে এসেও জাপানের ইসাও কাকেহি ছিলেন একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষ, মনের মধ্যে ভালোবাসার ইচ্ছাটাও ছিল প্রবল।

২০১৩ সালে একটি জাপানি ম্যাচমেকিং এজেন্সির মাধ্যমে তিনি খুঁজে পান ৬৭ বছর বয়সী বিধবা নারী চিসাকো কাকেহিকে। দু'মাসের মধ্যেই প্রণয় রূপ নেয় পরিণয়ে। বিয়ে করে কিয়োটোর মুকো শহরে নিজেদের নতুন সংসার শুরু করেন এই দম্পতি।

দুজনে মিলে নতুন বছর উদযাপন উপলক্ষে রাইস কেকও বানিয়েছেন। কিন্তু নতুন বছরের আলো দেখার সৌভাগ্য হয়নি ইসাও কাকেহির!

২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর তিনি খুন হন। এর মাধ্যমে জাপানের কুখ্যাত 'ব্ল্যাক উইডো' খুনির চতুর্থ ও সর্বশেষ শিকারে পরিণত হন ইসাও কাকেহি।

তিন প্রেমিককে খুন ও একজনকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে ৭৪ বছর বয়সী চিসাকো কাকেহির মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অবশ্য সেই রায় এখনো কার্যকর হয়নি।

৬১ বছর বয়সে খুন করা শুরু করেন চিসাকো। কিন্তু সর্বশেষ খুনটির আগে প্রতিবারই আইনের হাত ফসকে বেরিয়ে যান তিনি। ইসাও কাকেহির মৃত্যুর পর পুলিশের তদন্তের সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে তার নাম। ২০১৪ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। 
জাপানের অন্যতম দীর্ঘসূত্রি একটি মামলার শেষ ফলাফল হিসেবে ২০১৭ সালে চিসাকোকে মৃত্যুদণ্ড দেন দেশটির আদালত। চলতি বছরের জুনে তার আরেকটি আপিলও খারিজ হয়ে যায়।

জাপানের পাবলিক ব্রডকাস্টার এনএইচকে সূত্র অনুযায়ী, গত জুনে বিচারক জানান, চিসাকো নামের ওই নারী ম্যাচমেকিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে বয়স্ক পুরুষদের খুঁজে নিতেন। এরপর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের বিষ খাইয়ে হত্যা করতেন।

চিসাকোর এই মামলা নিয়ে জাপানে তোলপাড় শুরু হয়। বিশেষত, বয়স্ক 'সিঙ্গেল' ব্যক্তিদের জন্য অনলাইনে সঙ্গী খোঁজা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন জাগে সবার মনে, কেন নিজের জীবনের সায়াহ্নে এসে প্রেমের ফাঁদে ফেলে মানুষ খুন করেছেন এই নারী?

চিসাকো কাকেহি। ছবি: কিয়োদো

যেভাবে খুনের শুরু

নিজের ভয়ঙ্কর কীর্তির জন্য জাপানজুড়ে কুখ্যাত হয়ে উঠলেও চিসাকো কাকেহির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি।

তার জন্ম জাপানের দক্ষিণপশ্চিম সাগা অঞ্চলে। বড় হয়ে একটি প্রিন্টিং কারখানায় চাকরি নেন। ১৯৬৯ সালে ২৩ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেন। ২৫ বছর সংসার করার পর ১৯৯৪ সালে অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যান তার স্বামী।

২০০৭ সালে ৭৮ বছর বয়সী তোশিয়াকি সুহিরোর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান এই নারী। সেই বছরেরই ১৮ ডিসেম্বর প্রেমিকের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারতে যান। এ সময় প্রেমিক সুহিরোকে 'ওষুধ' খাওয়ানোর নাম করে একটি সায়ানাইড ক্যাপসুল খাইয়ে দেন তিনি। ১৫ মিনিট পরেই অচেতন হয়ে পড়েন সুহিরো। অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, জানান আদালত।

চিসাকো নিজেই প্রেমিকের সঙ্গে হাসপাতালে যান। তবে  এ সময় অ্যাম্বুলেন্সকর্মীদের কাছে নিজেকে 'হিরাওকা' বলে পরিচয় দেন।

সায়ানাইড খাওয়ানোর পরও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সুহিরো। কিন্তু বিষের প্রতিক্রিয়ায় তিনি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন এবং তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর বেঁচে ছিলেন মাত্র দেড় বছর।

এর কয়েক বছর পর আবার নতুন শিকারের দিকে নজর দেন চিসাকো।

চিসাকোর আরও শিকার যারা

চিসাকোর ফাঁদে পা দেওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তিটির নাম মাসানোরি হোন্ডা। ডায়াবেটিসের মাত্রা কিছুটা কমে যাওয়ায় ২০১১ সালের দিকে প্রায়ই বিভিন্ন স্পোর্টস ক্লাবে দেখা যেত তাকে। তিনি চিসাকোর সঙ্গে কীভাবে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে বন্ধুদের কাছে এই যুগল জানিয়েছিলেন, তারা শিগগিরই বিয়ে করবেন।

পরবর্তী বসন্তেই চিসাকো তার কাজটি সেরে ফেলেন! ২০১২ সালের ৯ মার্চ তিনি একটি দোকানের ভেতরে হোন্ডার সঙ্গে দেখা করেন। এরপর দুজনে বিদায় নিয়ে যে যার পথে রওনা দেন। বিকাল পাঁচটার দিকে মোটরসাইকেল চালানো অবস্থায়ই অজ্ঞান হয়ে যান হোন্ডা। এর দুই ঘণ্টা পর হাসপাতালের ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরবর্তীকালে পুলিশি প্রমাণ থেকে জানা যায়, চিসাকোর আসলে হোন্ডাকে বিয়ে করার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। হোন্ডার মৃত্যুর দু'মাস আগে থেকেই তিনি আরেক ব্যক্তির সঙ্গে গোপনে প্রেম করছিলেন।

দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করতে থাকা মিনোরু হিওকি বেশ একাকী অনুভব করতেন। তবে ২০১৩ সালের দিকে তার ক্যানসার প্রায় সেরে যায় এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। তাই ৭৫ বছর বয়সে তিনি চিসাকোর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান।

হিওকি চেয়েছিলেন এই নারীর সঙ্গে সারা জীবন থাকতে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রেমিকা চিসাকোর সঙ্গে নৈশভোজে গিয়েই তার জীবনাবসান ঘটে।

চিসাকোর দ্বিতীয় স্বামী সুহিরোর মতো হিওকিও হেলথ সাপ্লিমেন্ট হিসেবে পিল খেতেন। তাই চিসাকোর পক্ষে তাকেও সায়ানাইড ক্যাপসুল খাইয়ে দেওয়া কঠিন ছিল না। 

ডিনার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হিওকি অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়েন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় চলে যান এবং হাঁপাতে থাকেন।

এবারও অ্যাম্বুলেন্সকর্মীদের কাছে মিথ্যা বলেন চিসাকো। হিওকির সন্তান আছে এবং তার ক্যানসার সেরে গেছে জানার পরেও তিনি অ্যাম্বুলেন্সকর্মীদের জানান, হিওকির আপনজন কেউ নেই এবং তিনি ফুসফুস ক্যানসারের রোগী। ডাক্তাররা হিওকিকে রিসাসিটেশন প্রক্রিয়ায় (পুনরুজ্জীবন) নিতে চাইলেও চিসাকো সেই অনুমতি দেননি। দুই ঘণ্টার মধ্যেই মারা যান হিওকি।

তার মৃত্যুর মাত্র দু'মাস পরেই ইসাও কাকেহিকে টার্গেট করেন এই বৃদ্ধা। ইসাওকে বিয়ে করার এক মাসের মধ্যেই তিনি গোপনে আরও একজনের সঙ্গে প্রেম শুরু করেন বলে জানান আদালত।

বিয়ের কয়েক সপ্তাহ পর, এক রাতে নতুন স্ত্রীর সঙ্গে ডিনার শেষে কার্ডিওপালমোনারি অ্যারেস্ট হয় ইসাও কাকেহির। চিসাকো নিজেই অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন স্বামীর জন্য। কিন্তু মাত্র এক ঘণ্টা পরেই তিনি মারা যান ইসাও।

চিসাকো কাকেহি। ছবি: সংগৃহীত

যেভাবে ধরা পড়লেন খুনি

জাপানে কারও মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত করার তেমন প্রচলন নেই। শুধুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হলেই ময়নাতদন্ত করা হয়। সে কারণেই হয়তো চিসাকোর সঙ্গীদের খুনের রহস্য সবার নজর এড়িয়ে যায়।

কিন্তু ইসাও কাকেহির মৃত্যু রহস্যজনক বলে সন্দেহ করায় লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। তাতেই বোঝা যায়, তার হৃদযন্ত্র, রক্ত ও পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণ সায়ানাইড আয়রন রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তাকে পাউডার রূপে সায়ানাইড খাওয়ানো হয়েছে।

পুলিশ চিসাকো কাকেহির ঘর থেকে সাপ্লিমেন্ট পিল ও খালি ক্যাপসুল জব্দ করে। ধারণা করা হয়, তিনি হেলথ সাপ্লিমেন্ট খালি করে তার মধ্যে সায়ানাইড ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

২০১৪ সালে চিসাকোর ফেলে দেওয়া একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ উদ্ধার করেন তদন্ত কর্মকর্তারা, যার ভেতরে সায়ানাইডের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

আদালত জানান, চিসাকো এই সায়ানাইডগুলো তার কর্মস্থল প্রিন্টিং কারখানা থেকে সংগ্রহ করেন।

দুই মাস পর পুলিশ চিসাকো কাকেহিকে গ্রেপ্তার করে এবং তিনি তার তিন প্রেমিককে সায়ানাইড খাইয়ে হত্যার কথা স্বীকার করে নেন। 

টাকার জন্য খুন

চিসাকো কাকেহির চক্রান্তের শিকার হওয়া চার ব্যক্তির মধ্যে একটিই মিল ছিল- তাদের চারজনই ছিলেন যথেষ্ট পরিমাণ টাকাপয়সা ও সম্পদের অধিকারী। সেইসঙ্গে তাদের বৃদ্ধ বয়স ও সিঙ্গেল স্ট্যাটাসের কারণে সহজেই তারা ওই নারীর পারফেক্ট নিশানায় পরিণত হয়েছেন।

প্রথম টার্গেট সুহিরোর কাছ থেকে চিসাকো ৪৮ মিলিয়ন ইয়েন ধার নেন। এই টাকা পরিশোধের দায় এড়াতে তিনি তাকে খুন করেছেন বলে আদালতের ধারণা।
  
চিসাকোর আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট না জানা গেলেও চার শিকারের কাছ থেকে তিনি যে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, তাতে তার খুনের উদ্দেশ্য আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না।
 
আসাহি নিউজ সূত্র জানায়, চিসাকো তার সঙ্গীদের কাছ থেকে সব মিলিয়ে ৫০০ মিলিয়ন ইয়েন (প্রায় সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা) হাতিয়ে নিয়েছেন।

চিসাকো কাকেহি। ছবি: সংগৃহীত

ডিমেনশিয়া ডিফেন্স 

কোটি কোটি টাকা লুফে নেওয়ার পরেও চিসাকো কাকেহি কেন খুন করা চালিয়ে গেলেন, তা এখনো অস্পষ্ট। আদালতের ধারণা, তিনি সঙ্গীদের বিশ্বাস ও ভালোবাসার 'সুযোগ' নিয়েছেন। নিজের সব অপরাধ স্বীকার করলেও মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাননি এই নারী। এর পেছনে তার 'আত্ম-প্রতিফলনের অভাব' রয়েছে বলে মনে করছেন আদালত।

কিন্তু চিসাকোর আইনজীবীরা তার সাক্ষ্য প্রমাণে ধারাবাহিকতার অভাব এবং তিনি ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন বলে আপিল দাঁড় করান। যদিও তাদের এই যুক্তি ধোপে টেকেনি; আপিলে হেরে যান তারা।

আদালতে দেওয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী, চিসাকো এমন এক নারীর প্রতিচ্ছবি, যিনি নির্দ্বিধায় নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন; আবার অপরাধের পক্ষে যুক্তিও দিয়েছেন।

২০১৯ সালে স্থানীয় সংবাদপত্র ইয়োমিউরি নিউজ'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চিসাকো বলেন, 'আপনি যতই নিজের কৃতকর্মের দিকে পেছন ফিরে তাকান না কেন, তাতে আপনার পাপ ধুয়ে যাবে না। এটা মৃতদের কাছে পৌঁছাবে না।' 


  • সূত্র: সিএনএন

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.