‘ব্যাকটেরিয়া থেকে আসে, ব্যাকটেরিয়ার কাছেই ফেরে’: প্লাস্টিক বিকল্পের ভবিষ্যৎ

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
16 October, 2021, 04:50 pm
Last modified: 16 October, 2021, 05:33 pm
গ্রাহকদের চাপের মুখে আন্তর্জাতিক বহু প্রতিষ্ঠানই এখন প্লাস্টিকের বিকল্প উপাদান খুঁজছে। কোকাকোলা, মারস এবং ইউনিলিভার পরীক্ষামূলকভাবে প্লাস্টিকের বিকল্প উপাদান ব্যবহার শুরু করেছে।

১৯৫০ সালের পর বিশ্বে প্রায় ৮.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছে। এর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শেষ পর্যন্ত ভাগাড়ে গেছে, নয়তো মাটি, নদী বা সমুদ্রে মিশে দূষণের সৃষ্টি করছে। বন্য ও জলজ প্রাণীর জীবন বিপন্নকারী প্লাস্টিক বিশ্ব জলবায়ু সংকটের অন্যতম কারণ।

কেবল দূষণই নয়, জ্বালানি খাতেও চাপের সৃষ্টি করেছে প্লাস্টিক। অধিকাংশ প্লাস্টিক তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। বর্তমান গতিতে উৎপাদন চলতে থাকলে চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল স্রেফ প্লাস্টিক উৎপাদনেই ব্যয় হবে।  

সমস্যা হলো জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর এই প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা সহজ নয়। প্লাস্টিক সত্যিই জাদুকরী এক জিনিস। উৎপাদনে সস্তা, হালকা ওজন ও টেকসই হওয়ায় প্লাস্টিকেও চাহিদাও অনেক। টেকসই হওয়ার বিষয়টি ব্যবহারকারীদের জন্য আকর্ষণীর হলেও, পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। প্লাস্টিকের ক্ষয় হতে কয়েক শতাব্দীর প্রয়োজন হতে পারে।

প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে টেকসই ও সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত কোনো উপাদান খুঁজে পাওয়াও কঠিন। তবে, অসংখ্য বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠান এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেখে নেওয়া যাক প্লাস্টিকের কিছু বিকল্প উপাদান।

বায়োপ্লাস্টিক

বাজারের এক শতাংশেরও কমজুড়ে ব্যবহৃত হলেও প্লাস্টিকের জনপ্রিয় বিকল্প হিসেবে বায়োপ্লাস্টিকের নাম সামনে এসেছে। আখ, শৈবাল এমনকি কলার খোসা এবং চিংড়ি বা শামুকের মতো শক্ত খোসার শেলফিস থেকে নির্মিত হয় এই প্লাস্টিক। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি সহজেই মাটিতে মিশে যায় বলে বায়োপ্লাস্টিকের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।

তবে, মুদ্রার অপর পিঠও আছে। বায়োপ্লাস্টিকের কাঁচামালের আরও ভালো বিকল্প পাওয়া না গেলে শেষ পর্যন্ত তা বন উজাড়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি মানুষের খাদ্য সংস্থানেও বসাতে পারে ভাগ। এছাড়া প্লাস্টিক যত সহজে প্রকৃতিতে মিশে যায় বলে প্রচারিত হয়, তা অনেকটাই বাড়িয়ে বলা। বায়োপ্লাস্টিক ক্ষয় হতেও কয়েক বছর সময় লাগে। অনেকক্ষেত্রে যান্ত্রিক কমপোস্টিংয়েরও প্রয়োজন হতে পারে, যা সহজলভ্য নয়।

উদ্ভিজ্জ প্লাস্টিক

কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দাবি, তারা এই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে গেছে। ডাচ বায়োকেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান অ্যাভানটিয়াম ১০০ শতাংশ উদ্ভিজ্জ প্লাস্টিক উদ্ভাবন করেছে। চিনি থেকে তৈরি এই প্লাস্টিক বোতল ও ফিল্ম তৈরিতে ব্যবহার করা সম্ভব। প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুসারে এই প্লাস্টিক ১০০ শতাংশ পুনঃব্যবহারযোগ্য।

জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর প্লাস্টিকের চেয়ে এর কার্বন ফুটপ্রিন্টও উল্লেখযোগ্যহারে কম। আর প্লাস্টিকের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত গাছপালাও টেকসই চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদিত হবে।

ব্যাকটেরিয়া থেকে উৎপাদিত প্লাস্টিক

উদ্ভিদ-নির্ভর প্লাস্টিকের বাইরে গিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক উৎপাদনের চেষ্টা করছে। যুক্তরাজ্যের 'শেলওয়ার্কস' সমুদ্র ও মাটিতে পাওয়া জীবাণু থেকে প্লাস্টিক উৎপাদন শুরু করেছে। কার্বন উৎসের ওপর নির্ভরশীল এই জীবাণু নিজেদের মধ্যে চর্বির মতো শক্তি সঞ্চয় করে। এই চর্বি বের করা হলে ঠিক প্লাস্টিকের রূপ ধারণ করে করে বলে জানান শেলওয়ার্কসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আমির আফসার।

যখন এই প্লাস্টিক প্রকৃতিতে ফিরে যায় তখন ঠিক একই ব্যাকটেরিয়া একে খাবার হিসেবে বেছে নিয়ে খেতে শুরু করে। "এটা ব্যাকটেরিয়া থেকে আসে, ব্যাকটেরিয়ার কাছেই ফিরে যায়," বলেন আফসার।

বিভিন্ন প্রসাধন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টিউব, বোতল ও কমপ্যাক্ট উৎপাদনের চুক্তি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই পণ্যগুলো সাধারণত ভাগাড়ে ফেলেন দেওয়া হয়। শেলওয়ার্কসের অপর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইনসিয়া জ্যাফারজি জানান, ব্যবহার শেষে আমাদের পণ্যগুলো খাদ্যবর্জ্যের মতোই পচনশীল। এর জন্য বাড়তি কোনো ব্যবস্থার দরকার নেই।

গ্রিনহাউজ গ্যাস থেকে উৎপাদিত প্লাস্টিক

বিজ্ঞানীদের অনেকে জলবায়ু সংকট নিরসনে গ্রিনহাউজ গ্যাস থেকে প্লাস্টিক উৎপাদনের চেষ্টাও করছেন। ভবিষ্যতে বায়ু থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে তা থেকে প্লাস্টিক উৎপাদনই তাদের উদ্দেশ্য।

রাটগারজ ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যার মাধ্যমে পানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে বিভিন্ন প্লাস্টিকের উৎপাদন সম্ভব। এটি পিইটি এবং পলিয়েস্টার সুতাকেও প্রতিস্থাপন করতে পারবে। ফ্যাশন শিল্পে অন্তত ৬০ শতাংশ পোশাকের কাঁচামাল হলো প্লাস্টিক। ফলে, প্লাস্টিকের দূষণ বহুলভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

কাগজের তৈরি বোতল

বিশ্বব্যাপীই বাড়ছে প্লাস্টিক সচেতনতা। গ্রাহকদের চাপের মুখে আন্তর্জাতিক বহু প্রতিষ্ঠানই এখন প্লাস্টিকের বিকল্প উপাদান খুঁজছে। মারস এবং ইউনিলিভার প্লাস্টিকের বদলে কাগজ দিয়ে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চালাচ্ছে।

চলতি বছর কোকাকোলাও হাঙেরিতে কাগজের বোতল নিয়ে পরীক্ষা চালানো শুরু করে। কাগজের পাল্প থেকে তৈরি বোতলগুলোর ক্যাপ অবশ্য প্লাস্টিকেরই রাখা হয়েছে।

প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় দুটি প্রশ্ন হলো এর উৎস কী? এবং শেষ পর্যন্ত তা কোথায় যাবে? কাগজের তৈরি প্লাস্টিকের বিকল্প সহজে পরিবেশে মিশলেও তা বনায়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এছাড়া, এই উপাদানগুলো বছরে ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে কি না, সেই প্রশ্নও থাকছে।

তবে, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে উচ্চপর্যায় থেকেও পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। পরিবেশ থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ ও পুনরুদ্ধার বাড়ানোর পাশাপাশি এর পুনরুৎপাদন ও পুনর্ব্যবহার জরুরি। তবে, যেখানে একদম অব্যবহৃত প্লাস্টিকের দরকার, এখন স্রেফ সেখানেই নতুন উদ্ভাবিত বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক ব্যবহারের পরামর্শ গবেষকদের।

বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্লাস্টিকের বিকল্প খুঁজতে জোর অনুসন্ধানে নেমেছে। কিন্তু, সমস্যা সমাধানে বিকল্প অনুসন্ধানের পাশাপাশি পুরো কাঠামোতেই পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

  • সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.