১৪২ বছরের গবেষণায় কয়েক প্রজন্ম ধরে বিজ্ঞানীদের এক গোপন অভিযানের গল্প

ফিচার

নেল গ্রিনফিল্ডবয়েস, এনপিআর
23 April, 2021, 07:00 pm
Last modified: 23 April, 2021, 07:09 pm
মাটিতে এখনো চারটি বোতল অবশিষ্ট রয়েছে। আরও অন্তত ৮০ বছর ধরে এই গবেষণা চলবে বলেই পরিকল্পনা করে রেখেছেন মিশিগানের এই উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা।

ভোর মাত্র চারটা বাজে। সূর্য উঠতে অনেকটা সময় বাকি। একইসঙ্গে হালকা বৃষ্টি এবং তুষারপাতের কারণে প্রকৃতি শীতল। আবহাওয়া ভালো না হওয়ায় হুট করে কারও এদিকে চলে আসার সম্ভাবনাও কম। সেদিক থেকে ভালোই হয়েছে। দলটি চায় না যে এ সময় কেউ তাদের দেখে ফেলুক।

ফ্ল্যাশ লাইট, শাবল, নিড়ানি, মাপার ফিতা সবই নিয়ে আসা হয়েছে। সেই সাথে আছে বহু পুরনো একটি নকশা। দেখতে অনেকটা নীলনকশার মতো। জলদস্যুর মানচিত্রের ন্যায় দেখতে না হলেও, তাতে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা গোপন এক অবস্থান নির্দেশিত আছে। মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা শত বর্ষের পুরনো দুর্লভ এক বস্তুর সংকেত বহন করছে এই নকশা।

গবেষকদের এই দল এখানে জড়ো হয়েছে মাটি খুঁড়ে এক গুপ্তধন খুঁজে পেতে। হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকা ওই বস্তু প্রকৃত পক্ষে একটি গবেষণার অংশ। বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে পরিচালিত এই গবেষণা শুরু হয়েছিল ১৮৭৯ সালে। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণাটিতে যুক্ত আছেন বহু প্রজন্মের বহু বিজ্ঞানী ও গবেষক।

কী সেই বস্তু যার অনুসন্ধান বিজ্ঞানীরা কয়েক প্রজন্ম ধরে করে আসছেন?

জীবদ্দশায় ফল জানবেন না জেনেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিনি

গবেষণাটি শুরু হয় উদ্ভিদবিজ্ঞানী উইলিয়াম বিলের হাত ধরে। মার্কিন এই বিজ্ঞানী দেখতে চেয়েছিলেন, কোনো বীজ কত দীর্ঘ সময় ধরে মাটির নিচে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। আর তাই তিনি অদ্ভুত এক গবেষণার পরিকল্পনা করেন। তার জীবদ্দশায় পূর্ণাঙ্গ ফলাফল জানা যাবে না জেনেও তিনি গবেষণাটি পরিচালনা শুরু করেন।

মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফ্র্যাংক তেলেউস্কি পুরো বিষয়টি ব্যখ্যা করেন। তিনি জানান, বিল প্রথমে ২০টি কাঁচের বোতল নির্বাচন করেছিলেন। 'কাঁচের বোতলগুলোতে তিনি বালু ও বিভিন্ন ধরনের বীজ ভরেছিলেন। বালুময় বীজের মিশ্রণটিতে ২১ প্রজাতির গাছের বীজ ছিল। এর মধ্যে প্রতিটি গাছের ৫০টি করে বীজ রেখেছিলেন তিনি।'

১৮৭৯ সালে এই সুদীর্ঘ মেয়াদী গবেষণার সূত্রপাত করেছিলেন উইলিয়াম বিল [মাঝখানে দাঁড়ানো]

গাছগুলো ছিল অতি সাধারণ কয়েকটি আগাছা। বিলের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের আগাছা নিয়ে অভিযোগগুলোর সমাধানে আসা। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন কৃষকরা সব আগাছা পুরোপুরি তুলে ফেললে, কত দীর্ঘ সময় ধরে জমি আগাছামুক্ত থাকে। এড়িয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে থাকা বীজগুলো থেকে বিরক্তিকর এই আগাছা কতদিন পর্যন্ত বেড়ে উঠতে পারে, তা জানা ছিল বিলের গবেষণার মূল বিষয়।

২০ বছর পর পর বোতল উদ্ধার অভিযান

বিল বোতলগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলেন। তবে তিনি অবস্থানটি গোপন রাখেন, যেন কেউ সেখানে গিয়ে কোনো ধরনের বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তিনি একটি করে বোতল খুঁড়ে বের করে দেখতেন, ভেতরের আগাছাগুলো অঙ্কুরিত হয় কি না।

১৯১০ সালে তিনি অবসরে যাওয়ার পর গবেষণার দায়িত্ব সহকর্মীদের কাছে হস্তান্তর করেন। একইভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার সহকর্মীরাও তাদের উত্তরসূরীদের হাতে গবেষণার দায়িত্ব অর্পণ করে যান।

তবে বিল যতদিন চেয়েছিলেন, তারচেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। পরবর্তীকালে দায়িত্বপ্রাপ্ত গবেষকরা পাঁচ বছরের পরিবর্তে দশ বছর অন্তর একটি করে বোতল বের করার সিদ্ধান্ত নেন। আরও পরে এসে গবেষকরা দশ বছরের সময়সীমাকে বিশ বছরে রূপান্তর করেন। বর্তমানে, বিশ বছর পর এই বোতল খুঁজে বের করা হয়।

২০০০ সালে সহকর্মীর কাছ থেকে দায়িত্ব লাভের পর তেলেউস্কি একটি বোতল উদ্ধার করেন। সে বছর মাত্র এক জোড়া ভিন্ন আগাছা অঙ্কুরিত হয়েছিল।

বিশ বছর পর ২০২০ সালে তেলেউস্কির দ্বিতীয় বোতলটি বের করার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তা স্থগিত থাকে। তিনি বলেন, 'আমাকে এই দায়িত্ব এখন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে হবে। কেননা, গত বছর আমি ৬৫ বছর পূর্ণ করেছি।' ভাবনা অনুযায়ী এই অধ্যাপক বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ তিন সহকর্মীকে বীজের নতুন তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বেছে নেন। এ বছর বোতল উদ্ধার যাত্রায় তাকে সঙ্গ দেন দলের নতুন সেই তিন সদস্য।

তাদেরই একজন ডেভিড লরি। ২০ বছর আগে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় স্নাতকের শিক্ষার্থী থাকাকালে প্রথম এই বিখ্যাত গবেষণার বিষয়ে জানতে পারেন। লরি বলেন, 'দীর্ঘমেয়াদী এই গবেষণা এবং শুরু হওয়ার সময়কাল আমাকে বিমোহিত করেছিল। কখনো ভাবিনি, এই গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারব।'

কয়েক বছর আগে লরির অফিসে যান তেলেউস্কি। তার হাতে ম্যাপটি তুলে দিয়ে বলেন, 'যদি আমার কিছু হয়, তাহলে তোমার কাছে নকশাটি থাকল।' এর মাত্র কয়েক মাস পরই তেলেউস্কি স্ট্রোক করেন। 'অবশ্য ভাগ্যক্রমে তিনি সে যাত্রায় সেরে উঠেন। তবে একটা সময় ছিল যখন তিনি দায়িত্বটা আরেকজনের হাতে তুলে দিয়ে নির্ভার হতে পেরেছিলেন,' বলেন লরি।

অভিযান শুরু!

নকশা এবং তেলেউস্কি নিজে দলটির সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও খনন করার জায়গাটি খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। তার ওপর অন্ধকারে সঠিক অবস্থানটি নির্ণয় করাও ছিল কঠিন। এমনকি প্রথম দফায় দলটি ভুল করে অন্য জায়গায় খোঁড়াখুড়ি শুরু করে। ভুল বুঝতেই আবার নতুন করে শুরু হয় মাটি খোঁড়ার কাজ।

ততক্ষণে পাখিদের ঘুম ভেঙে কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেছে। সূর্য ওঠার আগেই কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় দলটি।

গবেষকদলের অপর নতুন সদস্য লার্স ব্রাডভিগ। তিনি জানান, অতীতে যত গবেষণা করেছেন, সেগুলোর সঙ্গে এই গবেষণা অভিজ্ঞতার যোজন যোজন ফারাক।

ব্রাডভিগ বলেন, 'বড় একটি প্রক্রিয়ার খুব ছোট অংশ হিসেবে আমি নিশ্চিত করতে চাই, কাজটি যেন ঠিকভাবে সম্পন্ন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বিষয়টি কেবল অতীত প্রজন্মে কাজ করে যাওয়া উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যারা এই কাজে যুক্ত হবেন, তাদের জন্যও নিশ্চিত করা জরুরি।'

ব্রাডভিগ ও লরির সঙ্গে কাজ করতে আসা দলের তৃতীয় নতুন সদস্য মারজরি ওয়েবার। এই উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মধ্যে একমাত্র নারী সদস্যও তিনি। ওয়েবার মাটিতে ঝুঁকে সদ্য খোঁড়া গর্তে মুখ বাড়িয়ে দেন। বেশ কিছুক্ষণ হাত দিয়ে মাটি হাতড়ে গাছের শিকড় বই কিছু পাননি। অবশেষে, মসৃণ কিছু স্পর্শ করতেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার মুখ।

'মনে হয় আমি জিনিসটা পেয়ে গেছি,' উত্তেজিত কন্ঠে বলেন তিনি। দলের সবাই মুহূর্তেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই সেই উচ্ছ্বাসে জল ঢেলে দিলেন ওয়েবার নিজেই। 'দাঁড়ান! মনে হয় না... ওহ, এটা আসলে একটা পাথর!' এবার আর কারও কণ্ঠে হতাশা ও বিরক্তি লুকায়নি।

দলের উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ছিলেন অণুজীব বিজ্ঞানী রিচার্ড লেনস্কি। তিনি জানান, সবাই যখন খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত, তখন তিনি বৃষ্টি আর তুষারের থেকে ম্যাপটিকে বাঁচাতে সেটি জ্যাকেটের নিচে ধরে ছিলেন। 'আমার জন্য কাজটিই অনেক কঠিন ছিল। ভাবছিলাম, কখন না পুলিশ এসে হাজির হয়!'

অবশেষে অপেক্ষা যেন ফুরোল। 'ঠিক আছে... আমার মনে হয় এবারেরটা আসল...পেয়ে গেছি...', ভোরের নীরবতা ভেঙে ফেলেন ওয়েবার। তেলাউস্কি এবার আনন্দে স্বয়ং বোতলকেই সম্ভাষণ জানান। তিনি যেন অনেক দিন পর পুরনো বন্ধুর দেখা পেয়ে বলে ওঠেন, 'ওহ দারুণ! হ্যালো বোতল!'

ওয়েবার জানান, মাটির নিচ থেকে বোতল বের করার কাজটি তার কাছে দারুণ লেগেছে। 'যে মানুষ সর্বশেষ এই বোতল ধরেছিলেন, তিনি অধ্যাপক বিল। তাও সেটা ১৪০ বছর আগে, এমন একজন মানুষ যিনি ডারউইনকে চিঠি লিখতেন!'

তুলে আনা বোতলের ভেতরে থাকা বীজগুলো ট্রে-তে রেখে দেখছেন ফ্রাঙ্ক তেলেউস্কি

অপেক্ষার পালা

গবেষকরা দ্রুত বোতলটি ল্যাবে নিয়ে যান। বোতলের সব উপাদান তারা পটে রাখা মাটিতে ছড়িয়ে দেন।

মলিকিউলার জীববিজ্ঞানী মার্গারেট ফ্লেমিং কয়েকটি বীজ আলাদা করেন। এর মধ্যে একটি প্রজাতির বীজ গত ১০০ বছরেও অঙ্কুরিত হয়নি। উদ্দেশ্য হলো, বীজটির অভ্যন্তরে কোনো কোষ এখনো সক্রিয় আছে কি না, তা যাচাই করে দেখা। এমনকি বীজটি অঙ্কুরিত না হলেও জিনগত প্রযুক্তি ব্যবহারে তা দিয়ে এমন অনেক কিছু করা সম্ভব, যা বিলের সময় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

আরেকটি দারুণ বিষয় হলো, ফ্লেমিং ও ওয়েবার ১৪২ বছরের ইতিহাসে গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রথম দুই নারী বিজ্ঞানী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু প্রযুক্তিই নয়, আরও অনেক বিষয় পরিবর্তনের ইঙ্গিতই মিলবে এই গবেষণা থেকে।

বাকি বীজগুলোর জন্য গবেষকদের অপেক্ষা করতে হবে। যেকোনো দিন এখান থেকে কোনো বীজ অঙ্কুরিত হতে পারে। তেলেউস্কি চান যেন অন্তত একটি বীজ হলেও অঙ্কুরিত হয়। তিনি ও তার সহকর্মীরা ২০ বছর আগে অঙ্কুরোদগমের পর যেই অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, তা যেন এখনকার এই তরুণ দলও উপভোগ করে, সেটাই তার প্রত্যাশা। 

শতবর্ষ ধরে চাপা পড়ে থাকা বস্তুতে নতুন প্রাণের আভাস দেখতে পারা প্রবীণ এই বিজ্ঞানীর এক অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা।

ওয়েবার বলেন, 'আমরা জানি, বীজ দীর্ঘ সময় ধরে সিড স্টোরেজ ভোল্ট বা পারমাফ্রস্টে সক্রিয় থাকতে পারে।' বিল প্রশ্নের অনুসন্ধান করছিলেন, তা এখনো প্রাসঙ্গিক বলে জানান ওয়েবার। 'আমরা এখনো জানি না, মাটিতে বীজ কত দীর্ঘ সময় সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে,' বলেন তিনি।

ওয়েবার ও নতুন তত্ত্বাবধায়কদের প্রত্যেকের বয়স এখন ত্রিশ থেকে চল্লিশের কোঠায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকেও গবেষণাটি চালিয়ে যেতে অপেক্ষাকৃত তরুণ উত্তরসূরীদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে হবে। 

তেলেউস্কি মনে করেন, ২০৪০ সালে পরবর্তী খননের আগেই তাদের এই দায়িত্ব পালন করা উচিত।

'ভাগ্যবান হলে, তখন আমার বয়স ৮৫ হবে,' বলেন তেলেউস্কি। 'আশা করি আমি তখন সেখানে দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারব। সেই সঙ্গে দলটিকে তাদের নতুন সহকর্মীদের নিয়ে খনন করতে দেখব,' বলেন তিনি।

তবে বিলের মতো বর্তমান দলের কেউ এই গবেষণার শেষ দেখে যেতে পারবেন না। মাটিতে এখনো চারটি বোতল অবশিষ্ট রয়েছে। আরও অন্তত ৮০ বছর ধরে এই গবেষণা চলবে বলেই পরিকল্পনা করে রেখেছেন মিশিগানের এই উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা।

  • এনপিআর থেকে অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.