হাইপারলুপ: বিপ্লব আনবে পরিবহন ব্যবস্থায়?
ভবিষ্যতের যাতায়াত ব্যবস্থা কেমন হবে, একটু ভেবে দেখুন। কল্পনার চোখে হয়তো দেখবেন, সবাই নিজের স্পেসশিপ নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন।
ভার্জিন হাইপারলুপের প্রধান নির্বাহী ও সহপ্রতিষ্ঠাতা জশ জিগেল স্বপ্ন দেখেন- মিনিটের মধ্যে এক শহর থেকে আরেক শহরে চলে যেতে পারবে মানুষ। তার দেখা এই ছবিকে যতটা দূর-ভবিষ্যতের চিত্র মনে করছেন, ততটা হয়তো নয়। প্রযুক্তি কীভাবে আমাদের জীবনযাত্রা ও কাজের ধারা বদলে দিতে পারে, তা নিয়ে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন জিগেল। সেই আলাপ তুলে ধরা হলো টিবিএসের পাঠকদের জন্য।
রয়টার্স: সব ধরনের পরিবহন নিয়েই মানবজাতি এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হাইপারলুপকেই কেন যথার্থ সমাধান ভাবছেন?
জশ জিগেল: বিপুলসংখ্যক মানুষকে এয়ারক্রাফটের বেগে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহনের কথা ভাবছি আমরা। চাচ্ছি তাদের পছন্দের জায়গায় থাকার এবং তাদের পছন্দের কর্মস্থলে কাজ করার সুযোগ করে দিতে। একটা হাইপারলুপ ৩০-লেনের একটা হাইওয়ের সমান মানুষ ও পণ্য পরিবহন করতে পারবে।
রয়টার্স: হাইপারলুপ কাজ করে কীভাবে?
জিগেল: আপনাকে আমরা একটা টিউবে ওঠাব। টিউবের ভেতর বিস্তর সুযোগ-সুবিধা আছে। এ টিউবে বৈরী আবহাওয়ার কোনো প্রভাব পড়বে না। দুর্ঘটনা এড়ানোর প্রায় সব রকম বন্দোবস্তই এতে আছে। টিউবের ভেতর থেকে আমরা সমস্ত বাতাস বের করে নেব। ফলে খুব কম শক্তি খরচে উচ্চ গতিতে ছুটবে টিউব। আমরা চুম্বকীয় উড্ডয়ন প্রযুক্তি ব্যবহার করছি, তাই কোনো ঘর্ষণ হবে না। সব কাজও হয় অত্যন্ত মসৃণ গতিতে, কোনো রকম হাতের ছোঁয়া ছাড়াই। তড়িচ্চুম্বকীয় প্রপালশনের জন্যে—এবং টিউবের প্রতিটি ইউনিট ২০-৩০ জন যাত্রী ধারণ করতে পারে বলে—প্রতি ঘণ্টায় আমরা দশ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারব।
রয়টার্স: আপনি নিজেই তো আপনাদের নেভাডার পরীক্ষাকেন্দ্রে একটা টিউবে চেপেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন?
জিগেল: আমাদের যাত্রা শুরু সাত বছর আগে, একটা গ্যারেজে। সেই সফর এখন একটা টিউবের ভেতরের হোয়াইটবোর্ড পর্যন্ত পৌঁছেছে। জিনিসটার ভেতর বসা…একেবারে জাদুবাস্তব অভিজ্ঞতা।
টিউবটা স্পোর্টসকারের গতিতে ছুটেছে, দারুণ মজা পেয়েছি আমরা। দুইজন মানুষ একটা হাইপারলুপে ঢুকে আবার আস্ত বেরিয়ে এসেছে—এটাই এ পরীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
পরীক্ষাটা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত সবার মনে একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল—'জিনিসটা মানুষের জন্য নিরাপদ তো?' এখন এই প্রশ্নের জবাব আমরা জানি।
রয়টার্স: এটি এক শহর থেকে আরেক শহরে ভ্রমণের গতি কীভাবে বাড়াবে?
জিগেল: হাইপারলুপ সব হিসাব বদলে দেবে। ম্যানহাটনে একটা চক্কর মেরে আসতে এখন কতক্ষণ লাগবে ভেবে দেখুন। মিনিট চল্লিশ বোধহয়। নিউ ইয়র্ক সিটি থেকে ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে যেতে এখন অনেক কম সময় লাগবে। মাত্র চল্লিশ মিনিটে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে লাস ভেগাসে পৌঁছে যেতে পারবেন।
রোমান রাস্তা, স্প্যানিশ জাহাজ আর বিমান যে বৈপ্লবিক কাজ করেছিল, আমরাও ঠিক তা-ই করছি। পথ পাড়ি দেওয়ার সময়কে কমিয়ে আনছি।
রয়টার্স: হাইপারলুপ কবে থেকে চালু করার পরিকল্পনা আছে?
জিগেল: কাজটা করার জন্য ১০–২০ বছর লাগবে না। শহরগুলো এখনই তাদের পরিকল্পনার মধ্যে হাইপারলুপকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
জিনিসটা কোথায় প্রথম চালু হবে, তা বলতে পারি না। তবে আমেরিকার পাশাপাশি ভারত, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো জায়গাগুলোর দিকেও আমরা নজর দিচ্ছি। ২০২৫–২৭ সালকে লক্ষ্য করে এগোচ্ছি আমরা।
রয়টার্স: আপনারা যেহেতু ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান, সে হিসেবে স্যার রিচার্ড ব্র্যানসনের সঙ্গে আপনার মিথস্ক্রিয়া কেমন হয়েছে?
জিগেল: তিনি এমন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি আমরা যা করার চেষ্টা করছি সেটার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। রিচার্ডের যে ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে তা হলো—এই মানুষটা কেবল শূন্য থেকে নিজের ব্যবসা শুরু করেননি, উনি একজন দুঃসাহসী অভিযাত্রীও।
আমরা যে কেবল নতুন ধরনের পরিবহনব্যবস্থাই তৈরি করছি, তা নয়; সেইসাথে যাত্রীদেরও নতুন একটা জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভার্জিন আটলান্টিক থেকে শুরু করে ভার্জিন ক্রুজ, সেখান থেকে ভার্জিন গ্যালাক্টিক পর্যন্ত রিচার্ড এই কাজই করেছেন। গ্রাহকদের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে জানেন তিনি।
রয়টার্স: এই প্রযুক্তি যদি জনপ্রিয় হয়, এটা কি মানুষের জীবন এবং কাজের ধারা বদলে দেবে?
জিগেল: অবশ্যই। আমার ছেলের বয়স দুই। ও যেভাবে জীবন কাটাবে, তা এই মুহূর্তে আমাদের কল্পনারও বাইরে।
ভবিষ্যতের শহরগুলোর কথা যদি ভাবেন, দেখবেন মানুষ বাস করতে চাইবে এক এলাকায়, আর কাজ করতে চাইবে অন্য এলাকায়। মহামারিকালে তো ইতিমধ্যে এটা দেখেছি আমরা। আমার স্বপ্ন হচ্ছে, ইয়োসেমাইটির কাছাকাছি থাকা আর লস অ্যাঞ্জেলেসে দলের সঙ্গে কাজ করা। হাইপারলুপ আপনাকে দুটো ইচ্ছেই পূরণের সুযোগ দেবে।
রয়টার্স: এই প্রযুক্তি সম্পর্কে মানুষকে কী জানাতে চান?
জিগেল: বড় আইডিয়াগুলোকে কাজে পরিণত করার জন্য লম্বা সময়ের দরকার নেই। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সামান্য গ্যারেজ থেকে বৈপ্লবিক কোনো কোম্পানি প্রতিষ্ঠার আইডিয়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
এই দশকের শেষ দিকেই হয়তো কোটি কোটি মানুষকে হাইপারলুপে চড়তে দেখবেন। যারা ভাবছেন এই প্রযুক্তি আসতে আরও বহু বছর বাকি, তাদের বলছি—আমি নিজে এমন একটা টিউবে চেপেছি। হাইপারলুপ প্রযুক্তি এখন মূর্তিমান বাস্তব।
- সূত্র: রয়টার্স