সুবিধাবঞ্চিতদের প্রতি ভালোবাসার হাত

ফিচার

সিলেট প্রতিনিধি
24 June, 2020, 12:30 pm
Last modified: 24 June, 2020, 12:34 pm
সিলেটের ভবঘুরে-পথশিশু-মাদকসেবী-যৌনকর্মীদের পুণবার্সনের উদ্যোগ, দেড়মাস ধরে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ। প্রথমদিকে ৫০-৬০ জনকে খাবার দেওয়া হতো। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ জনে।

মেয়েটির গায়ের রং শ্যামলা। ধরা যাক তার নাম শ্যামলী। সিলেট নগরীর মাঝখানে ধনুকের মতো যে সেতু, যার নাম কিন ব্রিজ; তার নিচেই মেয়েটির বাস। পেশায় যৌনকর্মী। রিকশা-ভ্যান-ট্রাক চালক, ভবঘুরে, মাদকসেবী এরাই তার ক্রেতা। ক্রেতা প্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা পান শ্যামলী। এই টাকাতেই জোটে তার আহার।

গত মাসখানেক ধরে নিজের কাজ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছেন শ্যামলী। কারণ তার একবেলা আহারের জন্য চিন্তা করতে হয় না। রাতের খাবার পাওয়া যায় বিনামূল্যেই।

সিলেট শহরে গালির মতো ব্যবহৃত হয় দুটি শব্দ- 'পুলের তল' মানে সেতুর নিচ। মানে কিনব্রিজের নিচ। কেউ খুব খারাপ কথা বললে বলা হয়- 'মুখে পুলের তলের ভাষা কেন?' কেউ খুব খারাপ কাজ করলে বলা হয়, 'পুলের তলের লোকদের মতো আচরণ কেন?',  'পুলের তল চলে যাও'- এই বলে বন্ধুদের আড্ডায় একে অপরকে হাসি-তামাশা করা হয়।

এই কিনব্রিজ এলাকায় বসবাস এমন শ'খানেক মানুষের। এদের কেউ মাদকসেবী, কেউ যৌনকর্মী, কেউবা ভবঘুরে আবার পথশিশুও আছে অনেকে। এই এলাকায় নানা অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত তারা। কিনব্রিজের নিচেই তাদের বাড়িঘর, এখানেই রাত্রিযাপন। সমাজের মূলধারায় তারা অবাঞ্ছিত। কেউ কেউ তাদের দেখে নাক সিটকান, মুখ ফিরিয়ে নেন। 

এসব 'অবাঞ্ছিত' মানুষদের অপরাধমূলক কাজ থেকে সরিয়ে সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে সিলেটে কর্মরত টেলিভিশন সাংবাদিকদের সংগঠন ইলেকট্রনিক মিডিয়া জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইমজা)। ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের প্রতি।

এই উদ্যোগের প্রথম ধাপে কিনব্রিজ এলাকার বাসিন্দাদের বিনামূল্যে রাতের খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। গত ৯ মে থেকে শুরু হয় এই কার্যক্রম। এরপর টানা দেড় মাস ধরে চলছে খাবার বিতরণের কাজ। নগরীর মদনমোহন কলেজে রান্না করে কিনব্রিজের পাশে সুরমা তীরে প্রতিরাতে খাওয়ানো হয় তাদের। প্রথমদিকে ৫০-৬০ জনকে খাবার দেওয়া হতো। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ জনে।

উদ্যোগ প্রসঙ্গে ইমজা'র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মঈন উদ্দিন মনজু বলেন, কিনব্রিজ এলাকার সুবিধাবঞ্চিত, ভাসমান মানুষগুলো যারা সমাজের চোখে অবাঞ্চিত তাদের পুণবার্সনের একটি উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। তাদের আলোর পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। একবেলা খাবার বিতরণের মাধ্যমে এই উদ্যোগের শুরু হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেব আমরা।

রোববার রাত ১০টায় সুরমা নদীর তীরে চাঁদনীঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, লাইন ধরে ধরে বসে খাওয়া-দাওয়া চলছে। নারী-পুরুষ-শিশু সবাই বসেছেন লাইনে। সবাই একসঙ্গে খাবারের সময় যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে তাই নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে গোল বৃত্ত এঁকে দেওয়া হয়েছে। ইমজার'র স্বেচ্ছাসেবীরা বিতরণ করছেন খাবার।

এখানেই কথা হয় শ্যামলীর সঙ্গে। খাওয়া শেষে তিনি বলেন, সারাজীবন মানুষের কেবল ঘৃণা পেয়েছি। এভাবে কেউ কখনোই আমাদের জন্য এগিয়ে আসেনি। কেউ ভালোবাসা দেখায়নি।
 
শ্যামলী বলেন, এই পেশায় এসেছি তো পেটের দায়ে। ভাত পেয়ে গেলে এই কাজ আর করবো কেন। তাই কাজ অনেক কমিয়ে দিয়েছি। আস্তে আস্তে এসব কাজ ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

ইমজা'র এই মানবিক উদ্যোগে সেচ্ছায় এগিয়ে এসেছেন অনেকে। নানাবিধ সহায়তা দিয়ে তারা শামিল হয়েছেন এই কর্মযজ্ঞে।

কিনব্রিজ এলাকায়ই ইয়াবা বিক্রি করে ১৪/১৫ বছরের এক কিশোর। সে নিজেও ইয়াবায় আসক্ত। রোববার রাতে ওই কিশোর বলে, আমি এখন ইয়াবা খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছি।

এরকম আরও কয়েবজনের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তরা। এই উদ্যোগে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন ইমজা'র সাবেক সভাপতি আশরাফুল কবির। 

তিনি বলেন, করোনার এই সময়ে আরও অনেকের মতো কিনব্রিজ এলাকায় বসবাস করা মানুষগুলোও বিপাকে পড়েছে। এদের অনেকেই কেবল খাবারের ব্যবস্থা করতে এই অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছে। এখন যখন সবখানেই সঙ্কট, তখন খাবার না পেলে তারা আরও বেশি অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। এতে নগরীর এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। এসব ভাবনা থেকেই আমরা প্রথমে এ উদ্যোগ নিই। এরপর যখন দেখলাম এই উদ্যোগের ফলে তাদের অনেকের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে তখন তাদের পূনর্বাসনেরও চিন্তা শুরু করি।

আশরাফুল কবির আরও বলেন, এদের অনেকেই কেবল খাবারের নিশ্চয়তা পেয়ে গেলে অপরাধমূলক কাজ থেকে সরে আসবে। তার কিছু প্রমাণ ইতোমধ্যে আমরা পেতে শুরু করেছি। এখন আস্তে আস্তে সমাজের মূলধারায় তাদের নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। তাদের কিছু ভালো কাজে যুক্ত করারও চেষ্টা করছি। প্রাথমিক অবস্থায় তাদের দিয়ে কিনব্রিজ এলাকা পরিচ্ছন্নতার কাজ করানো হচ্ছে। 

তিনি বলেন, প্রথম এক মাস ইমজার সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এই কার্যক্রম চালিয়েছেন। এখন খবর পেয়ে অনেকেই সহায়তা নিয়ে আসছেন। এমনও হয়েছে একদিন একজন তার বাবার শিরনির পুরো খাবার আমাদের দিয়ে দিয়েছেন। বিদেশ থেকেও সহায়তা করছেন অনেকে। 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.