সমুদ্র রক্ষায় ১৪ দেশের চুক্তি
২০১৮ সালে সামুদ্রিক পরিবেশের ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে ১৪টি দেশের নেতারা আলোচনায় বসার পরও এ আলচনা ফলপ্রসূ হবে এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি। দেশগুলোর নেতারা সেসময় ১৪টি আলোচনা সভার পরিকল্পনা করলেও করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার আগে মাত্র দুইবার আলোচনায় বসেন তারা।
এ সপ্তাহেই সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষার এযাবৎকালের সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন এ সময়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনই বলা যায় এ চুক্তিকে। ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমেই পরিচালিত হয় এ চুক্তির আলোচনা।
২০২৫ সালের মধ্যেই নিজ নিজ দেশের সমুদ্রসীমার সার্বভৌম সম্পূর্ণ অঞ্চলকে টেকসই ভাবে পরিচালনার ব্যাপারে একমত হন ১৪টি দেশের নেতৃবৃন্দ। এই দেশগুলোর সীমানাভুক্ত সামুদ্রিক অঞ্চলের আয়তন প্রায় আফ্রিকা মহাদেশের সমান। নিজেদের সীমানাভুক্ত সামুদ্রিক অঞ্চলের ৩০ শতাংশ সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারেও একমত হন তারা।
১৪টি দেশের উদ্যোগ
উপকূলবর্তী দেশগুলোর নিজস্ব সামুদ্রিক অঞ্চল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সব প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের অধিকার থাকে। টেকসই সামুদ্রিক অর্থনীতির প্যানেল গঠন করা এ ১৪টি দেশ একত্রে বিশ্বের ৩০ শতাংশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অধিকারী।
দেশগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, তাদের এ প্রতিশ্রুতির ফলে দেশগুলোর সামুদ্রিক অঞ্চলে অত্যধিক ও অবৈধ মাছধরা, সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ রোধ ও কৃষিবর্জ্যের কারণে সৃষ্ট মৃত অঞ্চল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
স্মিথসনিয়ান ইন্সটিটিউশনের মেরিন বিজ্ঞানী ন্যান্সি নোলটন জানান, "পরিবেশ রক্ষায় তারা দলবদ্ধভাবে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগে দেশগুলো একই সাথে একই পরিকল্পনায় কাজ করলে সফলতার পথ সুগম হয়।"
'অন্যরকম জোট'
১৪টি দেশের এই দল একদমই সচরাচর অন্যান্য বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণকারী দলগুলোর মতো নয়। বিশাল সমুদ্রসীমা থাকার পরও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি ফ্রান্সকে। বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা রাশিয়াও ছিল না এ দলে।
এ প্রকল্পটির অন্যতম উদ্যোক্তা নরওয়ের সাবেক জলবায়ু ও পরিবেশমন্ত্রী ভিদার হেলগেনসেন জানান, "এধরণের দেশগুলোর সাথে আলোচনা সহজ ব্যাপার নয়। আমরা এমন কিছু দেশকেই বেছে নিয়েছি যাদের অংশগ্রহণে রাজনীতির ভূমিকা থাকবে না এবং আমরা নির্ধারিত লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে পারবো।"
যেসব দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সাথে সমুদ্র জড়িয়ে আছে এবং বৈজ্ঞানিক ভাবেই পরিবেশ রক্ষার সিদ্ধান্তগুলো নিতে প্রস্তুত এমন চিন্তাধারার দেশগুলোর সমন্বয়ে জোট করাই এ উদ্যোগের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল বলে জানান হেলগেনসেন।
ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় সব ধরণের দেশই আছে টেকসই সামুদ্রিক অর্থনীতির এই প্যানেলে। সবগুলো দেশের অর্থনীতিই কোনো না কোনোভাবে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল।
জোটভুক্ত ১৪টি দেশ হলো- অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চিলি, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কেনিয়া, মেক্সিকো, নামিবিয়া, নরওয়ে, পর্তুগাল, ফিজি, জ্যামাইকা ও পালাউ। অন্যান্য দেশগুলোকেও তাদের এ উদ্যোগে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে দেশগুলো।
বিজ্ঞানমুখী পরিকল্পনা
দেশগুলোর এ উদ্যোগের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে ২৫৩ জন বিজ্ঞানীর একটি দল। ইতোমধ্যেই সামুদ্রিক পরিবেশ নিয়ে তাদের পরিচালিত গবেষণাগুলোর ১৬টি প্রকাশিত হয়েছে, এরমধ্যে নয়টি প্রকাশিত হয়েছে ন্যাচার জার্নালে।
সমুদ্র সুরক্ষার উপায় হিসেবে শুধু সুরক্ষিত অঞ্চল নয়, বরঙ শতভাগ সামুদ্রিক অঞ্চলের সুরক্ষায় কাজ করার কথা বলেন দেশগুলোর নেতারা।
সেইসাথে ম্যানগ্রোভ,সামুদ্রিক শ্যাওলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও সামুদ্রিক ঘাসের তৃণভূমি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়ার কথাও জানান তারা। সামুদ্রিক ঘাস কার্বন শোষণ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট (১ দশমিক৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস) পর্যন্তও কমিয়ে আনতে সক্ষম।
ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড এটমোস্ফেরিক এডমিনিস্ট্রেশনের জেইন লুবচেঙ্কো জানান, "আমরা সমুদ্র সুরক্ষা ও ব্যবহারের মধ্যে একটি বেছে নেই নি। বরঙ সমুদ্রকে সুরক্ষিত রেখেই সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারের অত্যাধুনিক উপায় বেছে নিয়েছি।"
তিনি জানান, প্যানেলের প্রস্তাবিত সমাধানের মাধ্যমে ৪০ গুণ বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এ প্রকল্পে প্রতি ১ ডলার বিনিয়োগে ৫ ডলার সমমূল্যের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত লাভ পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন প্যানেলের অর্থনীতিবিদরা।
প্যানেলের প্রস্তাবিত সমাধানে ৭৪টি কার্যক্রমের উল্লেখ আছে, কিছু কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ঘানার উপকূলে অবৈধ মাছধরা চিহ্নিতকরণের প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য কমাতে সুয়েজ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত প্রস্তাবনা বেশ ব্যয়বহুল এবং বৃহৎ পরিসরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেশ সময় লাগবে। তবে বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ ইতোমধ্যেই একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পণ্য নিষিদ্ধ করেছে এবং থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার প্রধান নদীগুলোতে বর্জ্য নিষ্কাশনের আগে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হওয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
কিছুটা কঠিন লক্ষ্যমাত্রা
দেশগুলোর প্রস্তাবনা নিরর্থক প্রচেষ্টার পুনরাবৃত্তি মনে হতে পারে অনেকের। দেশগুলোর নেতারা জানিয়েছেন সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষায় ছোট উদ্যোগ নেয়ার সময় নেই আর। পৃথিবীর আয়তনের ৭০ ভাগই সামুদ্রিক অঞ্চল। এ অঞ্চল বর্তমানে দূষণের এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, দ্রুত বড় কোনো উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরুর ব্যাপারেই মত দেন তারা।
বর্তমানে বিশ্বের ৮২ শতাংশ মাছের সরবরাহই হয় কোনো অঞ্চলে অত্যধিক মাছ ধরার মাধ্যমে। জাতিসংঘের ২০১৯ সালের একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, সামুদ্রিক পরিবেশ দূষণমুক্ত করার ও সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা না নিলে ২১০০ সাল নাগাদ মাছের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫ শতাংশ কমে যেতে পারে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোর-ইন-রেসিডেন্সের মেরিন বিজ্ঞানী এনরিক সালা জানান, "মাছধরার প্রতি অধিক গুরূত্ব দিলেই যে আমরা বেশি মাছ পাবো ব্যাপারটি এমন নয়।"
কোনো দেশের সামুদ্রিক অঞ্চলের মাত্র ৭ শতাংশ সংরক্ষিত রাখা সামুদ্রিক পরিবেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সহায়ক নয়। এমনকি ৩০ শতাংশ সংরক্ষিত অঞ্চলও যথেষ্ট নয়।
উদ্যোগের সম্ভাব্য ফলাফল
বিশ্বের ১৯২টি উপকূলবর্তী দেশের মাত্র ১৪টি দেশের এই উদ্যোগ তেমন কোনো ভূমিকা রাখবেন না মনে করছেন অনেকেই। তবে এ ধারণার বিপক্ষেও মত দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রভাবশালী দেশ জাপানের এ চুক্তি স্বাক্ষর বেশ শক্তিশালী প্রভাব রাখতে পারে। ইতোপূর্বে কখনো নিজস্ব সীমানাভুক্ত অঞ্চল সংরক্ষিত ঘোষণার ব্যাপারে রাজি হয়নি জাপান। জাপানের ৩০ শতাংশ সামুদ্রিক অঞ্চল সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর একারণে বেশ বড় ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন মেরিন বিজ্ঞানী সালা।
আগামী বছর জাতিসংঘের এসংক্রান্ত আলোচনায় জাপানের সমর্থন থাকায় অন্যান্য দেশগুলোর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব থাকবে। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য চীনের ওপর চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনাও থাকে। চীন তাদের ৩০ শতাংশ ভূমি সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিলেও সামুদ্রিক অঞ্চলের ব্যাপারে সবসময় নিরব থেকেছে। একারণে চীনের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলে আরও সামনে এগিয়ে যাবে এ উদ্যোগ।
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক