লাল লিপস্টিকের বিপ্লব
ফিচার
১৯১২। যুক্তরাষ্ট্র। ভোটাধিকারের দাবিতে কসমেটিক ব্র্যান্ড 'এলিজাবেথ অর্ডেন'-এর নিউইয়র্ক সেলুনটির পাশ দিয়ে মিছিল করে এগিয়ে গেলেন হাজারও নারী। ব্র্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা এলিজাবেথ অর্ডেন ব্যবসা শুরু করেছেন বছর দুয়েক হলো। নারী-অধিকারের আপাদমস্তক সমর্থক তিনি। সেই মিছিলে সামিল হয়ে নারীদের মধ্যে তিনি বিলিয়ে দিলেন উজ্জ্বল লাল লিপস্টিকের টিউব।
নারী অধিকার বিদ্বেষী পুরুষদের ক্ষেপিয়ে তুলতে সেই আন্দোলনের নেত্রী এলিজাবেথ ক্যান্ডি স্টানটন ও শার্ল্ট পার্কিন্স গিলম্যান লাল লিপস্টিক খুব দারুণভাবে গ্রহণ করলেন। রংটিকে তারা বিবেচনা করলেন বিদ্রোহ ও মুক্তির প্রতীক হিসেবে।
লাল লিপস্টিকের এভাবে প্রতিবাদের অংশ হয়ে ওঠার ইতিহাস সিনএননে লিখেছেন জ্যাকি পালুম্বু।
তার লেখা থেকে আরও জানা যায়, গত বছর প্রকাশিত 'রেড লিপস্টিক: অ্যান অডি টু অ্যা বিউটি আইকন' বইয়ের লেখক র্যাচেল ফেল্ডার বলেছেন, লাল লিপস্টিক শুধু লিপস্টিকই নয়, বরং হয়ে উঠেছিল নারী-অধিকারের লড়াইয়ের এক নিখুঁত প্রতীক।
শতাব্দী থেকে শতাব্দীজুড়ে লাল লিপস্টিক ধারণ করে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতীকের মহিমা। প্রাচীন মিশরীয় যুগে এটি ছিল অভিজাত শ্রেণীর সৌন্দর্যের বাহক। অন্যদিকে প্রাচীন গ্রিসে পতিতাবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত নারীরা এই লিপস্টিক ব্যবহার করতেন। আবার, হলিউডের শুরুর দিনগুলোতে সৌন্দর্য্যের প্রতীক হিসেবেই ব্যবহৃত হতো এটি।
ফেল্ডার জানান, অনেকের কাছেই লাল লিপস্টিক একটি জোরাল সাংস্কৃতিক অস্ত্র। সংস্কৃতির ইতিহাস ও সমাজের যুগ-চেতনা বোঝার একটি সত্যিকারের চিহ্ন হয়ে আছে এটি।
প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হলেও লাল লিপস্টিক জনপ্রিয়তা পায় বিংশ শতকের শুরুতে। সে সময় অসভ্যতা, ব্যভিচার, এমনকি প্রথাবিরোধিতার মতো নারীদের নৈতিক দ্বিধাগ্রস্ততাকে ফুটিয়ে তুলত এর ব্যবহার। অন্যদিকে, অন্ধকার যুগে লাল লিপস্টিককে দেখা হতো শয়তানের দোসর হওয়ার প্রতীক হিসেবে।
ফেল্ডার বলেন, অনেকেই নারীত্বের রহস্যময় ও আতঙ্কজনক রূপ-অনুষঙ্গ হিসেবে গণ্য করত এটিকে। তিনি জানান, আমেরিকান নারী-ভোটাধিকার আন্দোলনটি যখন একে গ্রহণ করে, তারপর দ্রুতই সারা দুনিয়ায় সমমনাদের কাছে খাতির পায় এটি।
ইউরোপের নানা দেশ, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়া নারী-অধিকার আন্দোলন, মিছিল-মিটিং ও অনশনে নারীদের ঠোঁটে ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়তে থাকে লাল লিপস্টিক। ব্রিটিশ নারী-ভোটাধিকার আন্দোলনের নেত্রী এমিলিন প্যাঙ্কহার্স্টও এই অনুষঙ্গকে নিজেদের আন্দোলনে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন। শুধু আন্দোলনকারীদেরই নয়, বরং সাধারণ নারীদের মাঝেও লাল লিপস্টিকের ব্যবহার বাড়তে থাকে। কেটে যেতে থাকে এ নিয়ে এতদিন অনেকের মনে থাকা দ্বিধা।
'অবাধ্যতা'র প্রতীক হিসেবে লাল লিপস্টিককে আবারও জোরাল অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেই যুদ্ধের প্রধান খলনায়ক অ্যাডলফ হিটলার লাল লিপস্টিক একদম সহ্য করতে পারতেন না। সে সময়ে জার্মানির বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর দেশগুলোতে এটি হয়ে ওঠে দেশাত্মবোধের পক্ষের এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধের একটি প্রতীক।
যুক্তরাজ্যে যখন করের কারণে লিপস্টিকের দাম বেড়ে গিয়েছিল, তখন নারীরা বীটের (সবজিবিশেষ) রসে তাদের ঠোঁট লাল করতেন।
অন্যদিকে, ১৯৪১ সালে এবং বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোতে ইউএস আর্মিতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য লাল লিপস্টিক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। যুদ্ধকালের এই ট্রেন্ডকে বিউটি ব্র্যান্ডগুলো ক্যাশ করে নিতে ভুল করেনি! এলিজাবেথ অর্ডেন বাজারে ছাড়েন 'ভিক্টরি রেড', এবং হেলেনা রুবেনস্টেইন ছাড়েন 'রেজিমেন্টাল রেড'। অন্যান্য ব্র্যান্ডও নতুন নতুন নামে বাজারে ছাড়ে লাল লিপস্টিক। তবে কর্মজীবী নারীদের জন্য ঠোঁট ও নখের রঙ নির্ধারণ করে দেওয়ার বিধান চালুর অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে করেছিলেন অর্ডেনই। তাদের ইউনিফর্মের রেড পিপিংয়ের সঙ্গে তার 'মন্টেজুমা রেড' ব্যান্ডটির লিপস্টিক বেশ মানিয়ে গিয়েছিল।
বিশ্বজুড়ে নারী অধিকার আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে এখন লালের চেয়ে গোলাপি রঙই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে লালের আবেদন একদমই ফুরিয়ে যায়নি। ২০১৫ সালে মেসিডোনিয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে দাঙ্গা পুলিশের শিল্ডে এক নারীর চুমু খাওয়ার ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছিল। লাল লিপস্টিক ঠোঁটে মেখে খাওয়া সেই চুমুর দাগ বিদ্রোহটির এক তীর্যক প্রতীক হিসেবে বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে।
২০১৮ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নারী-পুরুষ সবাই ঠোঁটে লাল লিপস্টিক মেখে অভিনব প্রতিবাদ জানান। অন্যদিকে গত ডিসেম্বরে চিলিতে প্রায় ১০ হাজার নারী কালো কাপড়ে চোখ ঢেকে, গলায় লাল মাফলার ও ঠোঁটে লাল লিপস্টিক মেখে প্রতিবাদ জানান যৌননিপীড়নের বিরুদ্ধে।
এভাবেই যুগে যুগে শুধু সৌন্দর্যবর্ধনই নয়, নানা আন্দোলনেরও প্রতীক হয়ে আছে লাল লিপস্টিক।
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.