যে গ্রামে অধিবাসীদের নাম হয় গানের কলি দিয়ে
ফিচার
উত্তরপূর্ব ভারতের চিরসবুজ অরণ্য আর মেঘ ছুঁয়ে চলা পাহাড়ের রাজ্য মেঘালয়। সেখানে দূর পাহাড়ের বুক থেকে যদি কোনো সুর ভেসে আসতে শোনেন, তাহলে তা নিছক পাহাড়ি গানের মুর্ছনা ভাবতে পারেন অনেকেই। হয়তো সে সুর আপনার হৃদয়কেও স্পর্শ করবে। কিন্তু, এই সুর কারো নামও হতে পারে। সুরে সুরেই নাম রাখার প্রাচীন এ ঐতিহ্য রয়েছে রাজ্যটির কংথং গ্রামের বাসিন্দাদের।
এ গ্রামে সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি এমন বলা যায় না মোটেও। প্রাদেশিক রাজধানী শিলং থেকে গাড়িপথে দূরত্ব তিন ঘণ্টা। তবে যাওয়ার পথ যেমন দুর্গম, তেমনি নয়নাভিরাম চারপাশের সৌন্দর্য। চারপাশে উঁচু পাহাড় চূড়ায় ঘেরা। পাহাড়ের বুক চিড়ে তৈরি সড়কের একপাশে গভীর গিরিখাতের দৃশ্য হিম ধরাবে অতি-সাহসীর বুকেও। পূর্ব খাসিয়া পাহাড়শ্রেণিতে যাওয়ার পথটির কোথাও কোথাও পেয়ে যাবেন স্বচ্ছ জলের স্রোতস্রিনী ঝর্ণার দেখা। এই রোমাঞ্চকর যাত্রা শেষে বড় চমকটি কিন্তু থাকবে কংথং গ্রামে পৌঁছানোর পরই।
এই গ্রামেই আছে জিংরাওই ইওয়াবেই নামে সে অনন্য ঐতিহ্য। কত শত বছর ধরে তা চলে আসছে সঠিকভাবে জানে না কেউই।
সে ঐতিহ্য অনুসারেই কংথং গ্রামে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুকে দুটি (সবমিলে ৩টি) নাম দেওয়া হয়। দ্বিতীয় নামটি আসলে এক স্বতন্ত্র সুরের কলি। সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যা তার মা দেন। প্রথম নামটি ব্যবহার হয় শুধু আনুষ্ঠানিক কাজে। আর দ্বিতীয় নামটি বা সুরেই তাকে আজীবন ডাকে গ্রামের সবাই। সে নামেই তিনি সাড়া দেন।
কারো মৃত্যুর পরও অমর রয় সে নামের স্মৃতি। অতীতে কারো জন্য দেওয়া সুরের ধ্বনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাউকে দেওয়া হয় না। এভাবে একেকটি সুরের ডাক মৃতের স্মৃতিকে আগলে রাখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
কংথং গ্রামের বাসিন্দা ও খাসিয়া নারী শিদিয়াপ খোংসিত (আনুষ্ঠানিক নাম) বলেন, 'শিশুর জন্মের পরই মা তার হৃদয়ের সবটুকু আনন্দ ও ভালোবাসা দিয়ে এ সুর তৈরি করেন। যার প্রতিটি ধ্বনি ঘুমপাড়ানি গানের মতই মিষ্টি ও মমতায় ভরা।'
খাসিয়া ছাড়াও এ গ্রামে আরও তিনটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। কিন্তু, সুরের ছন্দে নাম সবারই।
এ নারীর চার সন্তান। প্রত্যেকের নামবাচক সুর ১৪ থেকে ১৮ সেকেন্ড পর্যন্ত দীর্ঘ ও সম্পূর্ণ আলাদা।
'দীর্ঘ এ নামেই আমরা ফসলের মাঠে, বনে-বাদারে একে-অন্যকে ডাকি। এভাবে পাহাড় ও উপত্যকায় দূর থেকে কাউকে ডাকা হয়।'
"সুদূর অতীতে আমাদের পূর্বজরা পাহাড়ি জঙ্গলে শিকারের সময় এভাবে সুরে সুরে একে-অন্যের খোঁজ রাখতেন। দল থেকে কেউ হারিয়ে যাওয়ার ভয় সব-সময়ই থাকতো। আমাদের বিশ্বাস বনে অশুভ আত্মাদের বসবাস। তাদের তাড়াতেই সুরের এ ডাকের উৎপত্তি। কেননা বনে আপনাকে গান গেয়ে কেউ ডাকলে, দুষ্ট আত্মারা কোনো ক্ষতি করতে পারে না।"
তিনি আরো জানান, সুরেলা নামের সংক্ষিপ্ত ধরনও রয়েছে, যা আসলে মূল সুরের নির্যাস। যাকে ডাকা হচ্ছে সে খুব কাছাকাছি থাকলে এটি ব্যবহার করা হয়। অনেকটা ডাকনামের মতই। তবে দূর থেকে যখন পুরো নামে সুর করে ডাকা হয়, তখন তা শুনতে লাগে সুরেলা শীষের মতোই। এজন্যই কংথং'কে এ অঞ্চলের মানুষেরা 'শীষ দেওয়া গ্রাম' নাম দিয়েছেন।
"ঠিক কবে থেকে এর প্রচলন তা আমরা কেউই জানি না। তবে গ্রামের শুরু থেকেই এ ঐতিহ্য চলে আসছে এব্যাপারে প্রায় সবাই একমত। আমাদের পূর্বজদের প্রাচীন সোহরা রাজ্য স্থাপনের আগেই এ গ্রামের প্রতিষ্ঠা।"
কংথং থেকে খানিক দূরেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের এলাকা চেরাপুঞ্জি। এখানে ১৬ শতকে সোহরা রাজ্য স্থাপন করা হয়। সে হিসাবে কংকং গ্রামের বয়স ৫০০ বছরের বেশি। এই সুদীর্ঘ কাল ধরেই চলে আসছে সুরেলা নামে ডাকাডাকি।
এই ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন ড. পিয়াসী দত্ত। এখন অধ্যাপনা করছেন দিল্লির অমিতি স্কুল অব কমিউনিকেশনে। শিলংয়ে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তিনি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে পিএইচডি করার সময় কংথং গ্রামের সন্ধান পান।
ড.পিয়াসী বলেন, খাসিয়াদের অন্যান্য গ্রামের মতই এখানেও সমাজ, সংস্কৃতি, প্রচলিত বিশ্বাস আর মূল্যবোধ সবকিছুই মাতৃতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত। মায়ের মুখের দেওয়া সুরেলা নাম এভাবেই মুখে মুখে কংথং এর সমাজে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে এসেছে। যা সমাজে মাতৃ-প্রাধান্যেরই বহিঃপ্রকাশ।'
তিনি আরো জানান, জিংরাওই ইওয়াবেই এর অর্থ। জিংরাওই মানে সুর, আর ইওয়াবেই হলেন পূর্বজ বা গোত্রের প্রথম আদিমাতা। সুরেলা নামে ডেকে ডেকে আদিমাতার প্রথাকেই সম্মান জানানো হয়।
"তাই এ নাম চর্চার প্রতীকী সম্পর্ক তাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মাধ্যমে শুধু নবজাত শিশুকে নাম দেওয়া হচ্ছে তাই নয়, বরং সঙ্গীতের ধবনিতে আদিমাতার আশীর্বাদও চাইছেন তার মা"- যোগ করেন পিয়াসী।
- সুত্র: বিবিসি ট্রাভেল
Comments
While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.