যেভাবে শুরু হয়েছিল বিল ও মেলিন্ডার পথচলা

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক 
06 May, 2021, 09:10 pm
Last modified: 06 May, 2021, 09:12 pm
বিল গেটস সবসময়ই যে বিষয়টি নিয়ে আমোদিত বোধ করতেন, তা হলো তার স্ত্রী তার চাইতে শিক্ষিত।

১৯৮৬ সালের এক গ্রীষ্মে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইকোনমিকসে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা মেলিন্ডা অ্যান ফ্রেঞ্চ ইন্টার্ন হিসেবে কাজ শুরু করলেন আইবিএম-এ। নিয়োগকারীকে মেলিন্ডা জানিয়েছিলেন যে তিনি এর আগেও 'মাইক্রোসফট' নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছেন। কৌতূহলী নিয়োগকর্তা জানতে চাইলেন, যদি সেখান থেকে চাকরির প্রস্তাব আসে তাহলে মেলিন্ডা কী করবেন? উত্তরে মেলিন্ডা বলেছিলেন, 'আমি অবশ্যই সেই চাকরিটা নিবো। কারণ সেখানে উন্নতি করার প্রচুর সুযোগ রয়েছে।'

আর সে কথা যে সত্য তা আর বলার অবকাশ রাখে না। ছয় বছর পর মেলিন্ডা সেই কোম্পানিতেই বেশ ভালো অবস্থান তৈরি করে নিলেন। সফটওয়্যার মার্কেটিং শিক্ষানবিশ থেকে হয়ে উঠলেন এক্সপেডিয়া, এনকার্টার মত তথ্যপ্রযুক্তিগত পণ্যের জেনারেল ম্যানেজার। আর সেখান থেকে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা বিল গেটস এর হৃদয় পর্যন্ত চলে গেল মেলিন্ডার পদচারণা, যেই বিল গেটস খুব শীঘ্রই হতে চলেছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। আজ মেলিন্ডা বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি দাতা সংস্থার অর্ধেক মালিকানার দায়িত্বে এবং এখনো পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত দানের পরিমাণ ৮০ বিলিয়ন ডলার। পিঙ্গল চুলের, চালাক, শক্তসমর্থ এই নারী বিশ্ব দারিদ্র ও রোগ নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন শুরুর মতোই সমানভাবে।

১৯৬৪ সালে টেক্সাসের ডালাসে জন্ম নেয়া মেলিন্ডার বাবা রে ফ্রেঞ্চ ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং হাউজ-রেন্টাল এজেন্ট। মেলিন্ডা বরাবরই ছিলেন উদ্যমশীল, জ্ঞানী ও  লক্ষ্যস্থির প্রকৃতির নারী। সাইবার জগতের সঙ্গে মেলিন্ডার পরিচয় হয় ১৪ বছর বয়সে, যখন তার বাবা প্রথম একটি অ্যাপল ২ কম্পিউটার বাড়িতে আনেন। অ্যাপল ২-ই ছিল একেবারে প্রথম দিকে সহজলভ্য একটি কনজিউমার কম্পিউটার যা সাধারণ লোকের ব্যবহারের জন্য বাজারে আনা হয়। এরপর খুব দ্রুতই মেলিন্ডা কম্পিউটারে গেম খেলা এবং প্রোগ্রামিং এর প্রাথমিক বিষয়গুলো শিখে ফেলেন।

বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটস। ছবি: সংগৃহীত

বিল গেটস সবসময়ই যে বিষয়টি নিয়ে আমোদিত বোধ করতেন, তা হলো তার স্ত্রী তার চাইতে শিক্ষিত। বিল গেটস আমেরিকার সবচেয়ে বিখ্যাত 'কলেজ ড্রপ আউট'দের একজন। গেটস ও মেলিন্ডার পরিচয় হয় ১৯৮৭ সালে, মাইক্রোসফটে মেলিন্ডার যোগ দেয়ার চার মাস পরে। নিউইয়র্কে একটি এক্সপো-ফেয়ার ডিনারে তারা মুখোমুখি বসেন এবং সেখানেই পরিচয়। মেলিন্ডা একবার বলেন, 'আমি তাকে যতটা মজার মানুষ ভেবেছিলাম, সে তার চেয়েও বেশি ছিল।' এর কয়েক মাস পরে মাইক্রোসফটের কার পার্কিং এ দুই সপ্তাহের মধ্যে যেকোনো সময় গেটস মেলিন্ডাকে তার সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। মেলিন্ডার উত্তর ছিল-'সময়মতো আমাকে ডেকো'। কিন্তু গেটসকে তার কাছে নিজের অসংখ্য মিটিং এর চাপের কথা ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল। 

বিল গেটস প্রথম মেলিন্ডার যে গুণ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তা হলো তার সোজাসাপ্টা কথা এবং স্বাধীনতা। মেলিন্ডাই প্রথম গেটসকে দানশীলতার দিকে আগ্রহী করে তোলেন। ১৯৯৩ সালে তাদের বাগদানের পর মেলিন্ডার 'ওয়েডিং শাওয়ার'-এর সময় মেলিন্ডার মা ম্যারি স্তন ক্যান্সারে ভুগছিলেন। মেলিন্দাকে তার মা একটি উপদেশমূলক চিঠিতে লিখে গিয়েছিলেন, 'তুমি যাকে কিছু দিচ্ছো, সে আরো ভালো কিছু প্রত্যাশা করছে।' এর কয়েক মাস পরেই ম্যারি মারা যান, কিন্তু তার উপদেশ প্রভাবিত করে উইলিয়াম এইচ গেটস ফাউন্ডেশনকে। বিল গেটসের বাবার পরিচালিত এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি ক্লাসরুমে ল্যাপটপ দেয়ার ব্যাবস্থা করা। সেসময় এই জুটি ঠিক করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো শিক্ষা প্রক্রিয়া সংশোধনী।

তারপর ১৯৯৪ সালের নতুন বছরের প্রথম দিনে হাওয়াইতে অনুষ্ঠিত হয় বিল গেটস ও মেলিন্ডার বিয়ের অনুষ্ঠান। বিয়ের পরপরই মেলিন্ডা নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা থেকে জানতে পারেন যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে লাখ লাখ শিশু ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। তাই তিনি এরপর বিশ্ব দারিদ্রকে নিজেদের মূল কাজের বিষয় হিসেবে ঠিক করেন।

বর্তমানে মেলিন্ডা সপ্তাহে ৩০ ঘন্টা নিজের সংগঠনের কাজে ব্যয় করেন। সংস্থায় যেসব অনুদান আসে তার হিসাব রাখার দায়িত্ব মেলিন্ডা ও বিল গেটসের। প্রতিবছর প্রায় ৬০০০ অনুরোধ আসে তাদের সংস্থায়, কিন্তু তারা শুধুমাত্র যারা ৪০ মিলিয়ন ডলার বা এর বেশি চায়, তাদের চিঠিই পড়েন। ফোর্বস ম্যাগাজিনকে এ বিষয়ে মেলিন্ডা বলেন, 'আমরা চার্ট দেখে দেখে সবচেয়ে বেশি বৈষম্য যেখানে এবং যেখানে আমরা সত্যিই পরিবর্তন আনতে পারবো, সেখানেই সাহায্য দেই।' এই সংস্থাটির সঙ্গে গ্ল্যাক্সো'র মতো আরো কিছু দাতা সংস্থারও সংযোগ রয়েছে যারা গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স এর মত আরো ভালো প্রজেক্ট করার কথা ভাবছে। এই প্রজেক্টটি ১৭ টি দেশের সরকার থেকে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার চাঁদা পেয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ডিগ্রিধারী, যে একসময় জটিল সব জিগস পাজল ভালোবাসতো এবং একসময় দড়ির সাহায্যে ১৪ হাজার ফিট পাহাড়ে বেয়ে উঠেছে, যিনি এখন তিন সন্তানের জননী এবং যিনি কলকাতায় মাদার তেরেসা ফাউন্ডেশন পরিদর্শন করেছেন এইডস আক্রান্তদের সাহায্য করতে, বিশ্বের শীর্ষ সেই দাতা নারীর দিক থেকে নজর সরিয়ে রাখা সত্যিই কঠিন। মেলিন্ডার জ্ঞান ও স্বচ্ছ দৃষ্টি যে তার সংস্থার প্রয়োজন তা স্পষ্ট। টাইম ম্যাগাজিন যখন 'বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব'-শীর্ষক প্রচ্ছদে বিল গেটস ও বনোর ছবি দিয়েছিল, সেখানে মেলিন্ডার ছবিও ছিল। কারণ তিনিই এই সংগঠনের মূল অংশ বা মাথা। বনো বলেন, 'আমি এবং বিলের মতো অনেক মানুষই ক্রুদ্ধ, আমরা নিজেদেরকেও অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির পেছনে পরোক্ষভাবে দায়ী মনে করি। আমাদের নিজেদের আরো যৌক্তিক মানুষ হতে গেলে আরো ধীর ঘাতসম্পন্ন হওয়া উচিত, আর মেলিন্ডা হলো সেই ঘাত।'

সূত্র: ইন্ডিপেন্ডেন্ট 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.