যেভাবে দেশের সর্ববৃহৎ হাসপাতাল বিনামূল্যে রোগীদের খাবার দেয়

ফিচার

02 July, 2021, 08:30 pm
Last modified: 02 July, 2021, 08:44 pm
৩০ জন রাঁধুনি, ২ জন স্টুয়ার্ড ও ১ জন ডায়েটিশিয়ান (রোগীদের খাবার ঠিক করেন  যিনি) নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার রোগীর খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে।

জুনের এক মেঘাচ্ছন্ন সকাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রান্নাঘরের প্রাচীন, বৃত্তাকার করিডরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। রান্নাঘরটা তখন জনশূন্য, শুধু জলপাইরঙা ইউনিফর্ম পরা এক গার্ড সামনে চেয়ার পেতে বসে পাহারা দিচ্ছিল। হঠাৎ দেখা গেল পাকা কুমড়াভর্তি বিশাল এক ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসা হচ্ছে আমার ঠিক পেছন দিকেই। তড়িঘড়ি করে সরে গেলাম এক কোণায়। গার্ড আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, যেন বলতে চাইল—'দোজখে স্বাগতম!'

১২০০ বর্গফুটের এই রান্নাঘরে প্রবেশ করলেই আপনি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে এটি আসলে নরকের চাইতে কম কিছু নয়। এমনকি বর্ষার ঠান্ডা দিনেও রান্নাঘরের ভেতরের গরমে সেদ্ধ হওয়ার দশা। তদারককারীদের একজন, মোহাম্মদ বিলাল বললেন, 'ম্যাডাম, এখানে ২২টা চুলা জ্বলছে। আজকে আমরা ২০০০ রোগীর খাবার রান্না করছি। ৩০০ কেজি চালের ভাত রান্নার পর মাড় গালার সময় ভাতটা কতখানি গরম থাকে জানেন?' না, আমি জানি না।

বিলাল জানালেন, আজকের দিনটা তুলনায় সাধারণ। কারণ এই রান্নাঘরে ৫০০০ রোগীর খাবারও রান্না হয়েছে আগে-পরে।

রান্নাঘরের চারপাশে নজর বোলালাম। মোজাইকের মেঝেতে হলদেটে দাগ, চিমনি ও জানালায় মিশমিশে কালো ধোঁয়ার ঘন আস্তর, আঠালো-চটচটে মেঝে ও নড়বড়ে প্রাচীন দরজা। ভাবছিলাম, ৭০ বছর আগে, ১৯৪৭ সালে যখন এই হাসপাতাল বানানো হয়, তখন এই জায়গাটা কেমন দেখতে ছিল। সে সময় মাত্র ৮০০ শয্যা ছিল এ হাসপাতালে।

ইনফোগ্রাফ: টিবিএস

৩০ জন রাঁধুনি, ২ জন স্টুয়ার্ড ও ১ জন ডায়েটিশিয়ান (রোগীদের খাবার ঠিক করেন  যিনি) নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কীভাবে রোগীদের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে, সে কথা জানার কৌতূহলও হচ্ছিল।  

দিনাজপুর থেকে রাজশাহী— খাবার আসে দেশের সব প্রান্ত থেকে 

শুরুটা হয় একটি ডায়েট চার্ট দিয়ে। ডিএমসিএইচ-এর পুষ্টিবিদ ও ডায়েটিশিয়ান নাজনীন আহমেদ জানালেন, 'একেক রোগীর একেক ধরনের খাবার দরকার। তাই খাবার রান্না হয় রোগীর সংখ্যা ও তাদের শারীরিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে।' 

রোগীদের জন্য ডিএমসিএইচ এর রান্নাঘর সাধারণত ৪টি মেন্যু অনুসরণ করে। সাধারণ রোগী, আইসিইউ-এর রোগী, ডায়াবেটিস রোগী ও নতুন আসা রোগী যাদের এখনো ডায়েট তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি—এই চার শ্রেণির রোগীর জন্য চারটি মেন্যু। মহামারির মধ্যে যেহেতু হাসপাতালে করোনা ইউনিটও রয়েছে, তাই কোভিড রোগীদের জন্যও এখন তাদের নতুন একটি ডায়েট অনুসরণ করতে হয়।

খাবারের উপাদানগুলোকে এখানে ৮টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—শস্যজাতীয় খাবার (ভাত ও ডাল), কনফেকশনারি (দুধ, বিস্কুট ও মিষ্টি), মাছ, মাংস রুটি, ডিম সবজি এবং কলা।

খাদ্য সরবরাহ আসে চুক্তির উপর ভিত্তি করে। সারা দেশ থেকে ঠিকাদার ও সরবরাহকারীরা টেন্ডারে অংশগ্রহণ নিতে পারে। যদি নির্বাচিত হন, তাহলে তারা পরবর্তী এক বছরের জন্য একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির খাদ্য উপাদান সরবরাহ করতে পারবেন এখানে। 

গত চার বছর ধরে তোতা মিয়া ডিএমসিএইচ-এ চাল ও ডাল সরবরাহ করছেন। এ বছর তিনি দুধ, বিস্কুট আর মাছ সরবরাহের চুক্তি পেয়েছেন। তিনি জানালেন, 'মহামারির আগে আমি প্রতিদিন ১৬০০ কেজি চাল সরবরাহ করতাম। কিন্তু এখন তার অর্ধেক দেই।' 

ছবি: নূর-এ-আলম/টিবিএস

চাল আসে দিনাজপুর, রংপুর, বরিশাল ও দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে। সাধারণত শস্যদানা জাতীয় খাবার রাইস মিল থেকে সংগ্রহ করে এনে সংরক্ষণ করা হয়। পরে তা রান্নাঘরের প্রয়োজন অনুসারে সরবরাহ করা হয়।     

শস্যদানা তো সংরক্ষণ করা যায়, কিন্তু মাছ, মাংস, দুধ, রুটি, সবজি, কলা ও ডিমের মত পচনশীল খাবারগুলো কীভাবে রাখা হয়?

জবাবে মুরগি ও ডিম সরবরাহকারী মোহাম্মদ মহসীন বললেন, 'এগুলো দৈনিক ভিত্তিতে সরবরাহ করি।' মহসীন প্রতিদিন ফার্ম থেকে মুরগি ও ডিম সংগ্রহ করেন। এরপর রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী মুরগীগুলো টুকরো করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। 

মুহসীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন, এখন তার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। 'মহামারির আগে আমি প্রতিদিন ৭০০০ ডিম সরবরাহ করতাম। কিন্তু এখন প্রতিদিন কোভিড রোগীদের ৩ টি করে ডিম দেওয়া হলেও, গত সপ্তাহে হাসপাতালে দৈনিক ২০০০ ডিম সরবরাহ করতে হয়েছে।'  

যেভাবে এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয় 

ডিএমসিএইচ হাসপাতালের বাবুর্চিদের একজন, মোহাম্মদ দীন ইসলাম বললেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। '১৭ বছর ধরে আমি এই হাসপাতালের রান্নাঘরে কাজ করি, এর মধ্যে একটা ঈদও আমি বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটাতে পারিনি। ২০০৪ সাল থেকে আমি প্রতিদিন এখানে কাজ করি, সারা দেশ থেকে আসা রোগীদের জন্য রান্না করি।'

দীন ইসলাম, মিয়া হুমায়ূন ও মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের মতো এরকম ৩০ জন বাবুর্চি এই রান্নাঘরে কাজ করেন। দীন ইসলাম যেমনটা জানালেন যে, তারা সাপ্তাহিক কোনো ছুটি পান না; বার্ষিক ২০ দিন ছুটি তাদের পাওনা থাকলেও বেশিরভাগ সময়েই সেসব ছুটি নেওয়া হয়ে ওঠে না। 

৩০ জন বাবুর্চিকে সমানভাবে দুটি ব্যাচে দুই শিফটে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। সকালের শিফট সকালের খাবার ও দুপুরের খাবার তৈরি করে এবং সান্ধ্যকালীন শিফটের বাবুর্চিরা বিকালের নাস্তা ও রাতের খাবার তৈরি করেন। 

রান্নাঘরের এই মহাযজ্ঞ শুরু হয় ঠিক ভোর ৫ টায়। ফজরের নামাজ পড়ে মাথায় টুপি দিয়েই বাবুর্চি ও সাহায্যকারীরা রান্নাঘরের কাজে নেমে পড়েন। দিনের শুরুটা করেন তারা লাল ও সবুজ সুতি ফতুয়া পরে (ডিএমসি'র বাবুর্চিদের ঐতিহ্যবাহী ইউনিফর্ম)।  

সকালের খাবারের জন্য রুটির প্রথম ব্যাচ আসার আগেই বাবুর্চি ও হেল্পাররা মিলে দুপুরের খাবার রান্নার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ৩০০-৫০০ কেজি সবজি ও ৫০০ কেজি মাছ কাটার মাধ্যমে। 

সকাল ৭টা থেকে আধা ঘণ্টার মধ্যেই সকালের খাবার ট্রলিতে সাজিয়ে জেনারেল ওয়ার্ড, কেবিন ও আইসিইউ শাখায় রোগীদের কাছে পৌঁছে যায়। এরপর তারা পুরোদস্তুর দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি নেন। দুপুর ৩টার মধ্যে খাবার শেষে রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে, পরিষ্কারের মাধ্যমে শেষ হয় সকালের শিফট।

এরপরেই ২২টি চুলা আবারও জ্বলে ওঠে। নতুন আরেক ব্যাচ বাবুর্চি রাতের খাবার তৈরির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন সেখানে। এই রান্নাঘর বন্ধ হয় রাত ৯টার দিকে এবং পরেরদিন আবার এভাবেই চলে তাদের কাজ। 

'খাবার রোগীদের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য নয়'

সালমা নাসরিন (ছদ্মনাম) গত এক মাস ধরে তার নয় বছর বয়সী মেয়ে লামিয়াকে নিয়ে জেনারেল ওয়ার্ডে থাকছেন। লামিয়ার ডান পায়ে বড় একটি টিউমার ধরা পড়েছে। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, খুব সম্ভব তার পায়ে সার্জারি করতে হবে। সালমা ও লামিয়া এসেছেন মাদারীপুর থেকে, সেখানে লামিয়ার জন্য ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়নি। 

দুপুর ১টার দিকে সালমার সঙ্গে যখন আমার দেখা হলো, ওয়ার্ড বয় তখন দুপুরের খাবার পরিবেশন করছিল। লামিয়া জানাল, সে রুটি, দুধ, ডিম ও কলা দিয়ে সকালের নাস্তা করেছে। কিন্তু ভাত ও অন্যান্য খাবার খেতে ইচ্ছা করে না তার। 

ছবি: নূর-এ-আলম/টিবিএস

সালমা বললেন, 'আমি তবুও ওকে খাওয়াতে চেষ্টা করি। মাছ-মাংসটা আমার ভালো লাগে। কিন্তু সবজি আর ডালে স্বাদ নেই।

এক মাসের জন্য বিনামূল্যে সিট ও খাবার পাওয়া তার পরিবারের জন্য সৌভাগ্যের চাইতেও বেশি।  

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হকেরসঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, 'এই খাবার রোগীদের জন্য, খাবারকে সুস্বাদু করে এমন সব তেল- মশলাযুক্ত খাবার রোগীরা হজম করতে পারে না। আপনি যদি সুস্বাস্থ্যবান আত্মীয়দের কাছ থেকে জানতে চান, সেটা ভুল হবে।' 

ডায়েটিশিয়ান নাজনীন আহমেদ বলেন, 'গলায় অপারেশন হয়েছে এমন রোগীও আছে আমাদের এখানে। যাদের গুরুতর গ্যাস্ট্রিক সমস্যা ও অন্যান্য রোগ আছে তারাও আছেন। তাদেরকে মশলাদার খাবার দেওয়া যায় না। আর প্রতিটা রোগীর জন্য আলাদা আলাদা খাবার রান্না করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না।' 

পরবর্তীতে খাদ্যের মান নিয়ে মোহাম্মদ নাজমুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিদ্রুপের সুরে বললেন, 'আমাদের টয়লেট লেন দেখেছেন? মানুষ পারলে সেখানেও শুয়ে পড়ে। ম্যাডাম, আমাদের শয্যা আছে ২৬০০, কিন্তু মহামারি পরিস্থিতি ছাড়াই আমাদের ৫০০০ রোগী থাকত। তাদের সবাইকেই আমরা খাবার দিয়েছি। একজন সাধারণ রোগীর জন্য আমাদের দৈনিক বাজেট ১২৫ টাকা, কোভিড রোগীর জন্য ৩০০ টাকা। এই বাজেটে কীভাবে সেরা খাবার নিশ্চিত করবো বলুন?' 

এ বছর হাসপাতালটি বাজেট বরাদ্দ পেয়েছে ২০ কোটি টাকা এবং মোহাম্মদ নাজমুক হকের ভাষ্যে, তা যথেষ্ট নয়।

ছবি: নূর-এ-আলম/টিবিএস

তিনি বলেন, 'প্রতি বছর অডিট অফিসাররা অভিযোগ করেন, আমরা কেন ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত মানুষকে খাওয়াই। কিন্তু আমরা জানি আমাদের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের শেষ ভরসা এই হাসপাতাল। সবাই সিএমএইচ-এ ভর্তি হওয়ার সামর্থ্য রাখে না, এমনকি বিএসএমএমইউতেও না।' 

বক্ষব্যধী ওয়ার্ডের রোগী আসলাম মিয়ার (ছদ্মনাম) কাছে ডিএমসিএইচ হচ্ছে এমন এক জায়গা যেখানে তিনি বিনামূল্যে শয্যা, খাবার, ডাক্তার ও প্রতিদিন অন্তত একজন ইন্টার্ন তাকে এসে দেখে যাবেন—এমন সুবিধা পাওয়ার জায়গা। তার মতে, মাঝে মাঝে ওয়ার্ড বয় বা খালারা (নারী ক্লিনার) একটু রুঢ় আচরণ করেন ঠিকই; 'কিন্তু তারা যদি আমাকে না রাখত, আমি কোথায় যেতাম?'  

 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.