যেভাবে উন্মোচিত হলো প্রাচীন মিশরের সম্মোহনকারী মমি প্রতিকৃতির রহস্য 

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
14 June, 2021, 02:30 pm
Last modified: 14 June, 2021, 05:20 pm
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১০০০ মমি প্রতিকৃতির মধ্য থেকে গেটি মিউজিয়ামের সেই ১৬ টি চিত্র ভবোদাকে সঠিক সব তথ্য দিতে পারবে না। তাই তিনি আরও বেশি মমি চিত্র থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ও মাল্টি-ইনস্টিটিউশন গবেষণা শুরু করলেন এবং অজানা সব প্রশ্নের জট ছাড়াতে চেষ্টা করলেন।

প্রাচীন মিশরীয় মমি প্রতিকৃতিগুলো বহু বছর ধরেই মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও, এই রহস্যময় প্রতিকৃতি সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। 

১৮০০ সালের দিকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মিশরীয় শহর ফায়ুমে এই প্রতিকৃতিগুলো আবিষ্কারের পর থেকেই তাদেরকে ঘিরে রচিত হয়েছে নানা প্রশ্নের জাল। 

কে এঁকেছে এগুলো? কি ধরনের রঞ্জক ও স্তর শিল্পীরা এখানে ব্যবহার করেছে এবং সেগুলোই বা কোথায় বানানো হয়েছিল? চিত্রকর্মগুলো কি তার 'বিষয়' এর জীবিত থাকাকালীনই বানানো হয়েছিল, নাকি মারা যাওয়ার পর?

২০০৩ সালে শিল্পরক্ষক মারি ভবোদা এসব রহস্য উন্মোচনের উদ্দেশ্যে তার মিশন শুরু করেন। ২০১৯ সালে এসে তিনি লস অ্যাঞ্জেলসের গেটি জাদুঘরে যোগদান করেন। জাদুঘরের অসংখ্য চোখ ধাঁধানো সংগ্রহ সত্ত্বেও নির্দিষ্ট সেই ১৬ টি চিত্রকর্ম তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 

বড় বড় চোখের, নিখুঁত চেহারার এসব চিত্রকর্ম 'মমি প্রতিকৃতি' হিসেবে পরিচিত যা ১০০ থেকে ২৫০ সি.ই. সময়কালে তৈরি। প্রতিটি চিত্রই একটি করে মমির সাথে নিবদ্ধ এবং মৃতদেহের দিকে মুখাবৃত করা। 

ছবি: রয়্যাল মিউজিয়াম অব স্কটল্যান্ড/ উইকিমিডিয়া কমনস

ভবোদা জানতেন যে এসকল প্রতিকৃতির রহস্য উন্মোচন করতে পারলে এমন কিছু শিল্পকর্মের তথ্য পাওয়া যাবে যেগুলোকে পশ্চিমা চিত্রকর্মের অগ্রদূত মনে করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মমি প্রতিকৃতিই ইতিহাসের সর্বপ্রথম প্রতিকৃতি যেখানে জীবন-মানুষকে নিপুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং একই সাথে গ্রেকো-রোমান ও ক্লাসিক্যাল জগতের মধ্যে সমাধিস্তম্ভ ও শিল্পীসুলভ ঐতিহ্যের একটি সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।   

এছাড়াও, মিশরের প্রাথমিক দিকের সংস্কৃতি, সাম্রাজ্যের বাণিজ্য, অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে যেসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে গেছে, প্রতিকৃতি থেকে পাওয়া তথ্য সেগুলোরও উত্তর দিতে পারে বলে ভবোদা আশা করেছিলেন। 

কিন্তু সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১০০০ মমি প্রতিকৃতির মধ্য থেকে গেটি মিউজিয়ামের সেই ১৬ টি চিত্র ভবোদাকে সঠিক সব তথ্য দিতে পারবে না। তাই তিনি আরও বেশি মমি চিত্র থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ও মাল্টি-ইনস্টিটিউশন গবেষণা শুরু করলেন এবং অজানা সব প্রশ্নের জট ছাড়াতে চেষ্টা করলেন।

ভবোদা এসব চিত্রের নাম দিলেন 'অ্যাপিয়ার' বা 'অ্যানশেন্ট প্যানেল পেইন্টিংস: নিরীক্ষা, বিশ্লেষণ ও গবেষণা। ২০১৩ সালে এটি শুরু হওয়ার পর থেকে ৪১ টি ইনস্টিটিউশন প্রায় ২৮৫ টি চিত্রকর্মের তথ্য নিয়ে জড়ো হয়। আর সে সাথে রহস্যের জালও ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে।

ছবি: জে. পল গেটি মিউজিয়াম

ভবোদা 'অ্যাপিয়ার' প্রতিষ্ঠার আগে মমি প্রতিকৃতিগুলোকে অগণিত উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। মিশরীয় সমাধিস্থলগুলোতে খনন কাজ চলার সময় এবং ১৮০০ সালের দিকে শিল্প নিদর্শন নিয়ে বাণিজ্যের যখন ধুম পড়ে যায়, তখন মমি চিত্রগুলো ঝুঁকির মুখে পড়ে। মমিতে যেভাবে এগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, তা থেকে ছবিগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়।

মমি চিত্র নিয়ে সম্পূর্ণ অক্ষত দৃশ্যপট পাওয়াটা তাই কঠিন। এগুলো একই সাথে রোমান ও মিশরীয় চিত্রকলার শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে পড়ে। কারণ এগুলো তৈরি হয়েছিল মিশরের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ও একই সাথে রোমান অধিকরণের সময়ে। তাই এগুলো মিশরের মমিকরণ ও রোমান প্রতিকৃতি অঙ্গন শিল্প ও 'দাহন রঙ বা এনকাস্টিক' চিত্রকৌশলের মত পদ্ধতিগুলোর উত্থানের সময়কে নির্দেশ করে।  

অ্যাপিয়ার একদল বিশিষ্ট পন্ডিত ব্যক্তিত্ব, কিউরেটর ও বিজ্ঞানীদের এক ছাদের নিচে নিয়ে আসে মমি চিত্রগুলো গবেষণা করতে। এদের কোনো কোনো চিত্র তখনো আসল মমির গায়েই লাগানো ছিল।

এসব চিত্র নিয়ে প্রাপ্ত তথ্যগুলোর সমন্বয় ও তুলনা করতে চিত্রগুলোর আকৃতি, উপকরণ, লিপি, টুল মার্ক, প্যানেলের আকার, চিত্রসজ্জার বিস্তারিত তথ্য ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে  এগুলো সম্পর্কে গবেষকরা বিস্তারিত তথ্য একটি একক ডেটাবেজে আপলোড করেন। 

এই প্রজেক্টটি এ কারণে বিখ্যাত যে, এটি শিল্পকর্ম সংরক্ষণবিদ্যায় এক নতুন ধারার পথ প্রদর্শন করে। এসব ভঙ্গুর চিত্রকর্ম থেকে নমুনা না নিয়েই বরং আলট্রাভায়োলেট ইল্যুমিনেশন, ইনফ্রারড রিফ্লেক্টোগ্রাফি, রেডিওগ্রাফি ও অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই চিত্রের উপকরণ স্ক্যান করা যায়। 

অ্যাপিয়ারের ডেটাবেজ নিয়ে জাদুঘর কাজ করতে থাকে এবং অন্যদিকে ভবোদা ও তার সহযোগীরা এই বিষয়ের ইতি টানতে শুরু করেন। ১ম ও ৩য় শতাব্দী সি.ই. তে শৈল্পিক কর্মশালা গঠনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এগুলো থেকে, যখন মমি প্রতিকৃতিগুলো তৈরি করা হয়। কখনো কখনো একই প্যানেলে টেম্পেরা (রঙিন রঞ্জক) ও এনকাস্টিক (দাহন রঙ) পেইন্টের  ব্যবহার থেকে বুঝা যায় যে এক শিল্পী থেকে আরেক শিল্পীর কাছে আঁকার পদ্ধতির স্থানান্তর ঘটেছে। 

ছবি: দ্য মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, নিউ ইয়র্ক

কোনো কোনো পন্ডিত এও অনুমান করেন যে, শিল্পীর নিজ পদ্ধতি বা তার আঞ্চলিকতা অনুসারে আঁকার পদ্ধতি আলাদা হয়েছে। যেমন, কোনো প্যানেল মোটা, কোনোটা পাতলা, কোনোতা তির্যক। 

প্রতিকৃতির রচনাশৈলীসংক্রান্ত মিলও লক্ষ্য করা গেছে। ভবোদা গেটি জাদুঘরের পাশের শহরেই অবস্থিত নর্টন সিমন জাদুঘরের 'পোর্ট্রেট অফ আ ম্যান' নামক মমি প্রতিকৃতির সঙ্গে গেটি জাদুঘরের 'মমি পোর্ট্রেট অফ আ বেয়ার্ডেড ম্যান' নামক মমি প্রতিকৃতির মিল পেয়েছেন। আঁকার ক্ষেত্রে দুটির মধ্যে ব্রাশস্ট্রোকের মিল, দুটির সাবজেক্টেরই কোঁকড়া চুল ইত্যাদির মিল পেয়েছেন।

ভবোদা বলেন, 'আমরা বুঝার চেষ্টা করছি যে ছবি দুটি একই শিল্পীর আঁকা কিনা। একই শিল্পীর না হলেও হয়তোবা একই কর্মশালায় করা।' 

অ্যাপিয়ার এর একজন উড অ্যানাটমিস্ট, ক্যারোলিনে কার্টওয়েট জানান, ৭৫ শতাংশ মমি প্রতিকৃতি প্যানেলই বাতাবিলেবু গাছের কাঠের উপর আঁকা এবং এই গাছ মিশরে তখন পাওয়া যেত না।

ছবি: জে পল গেটি মিউজিয়াম

ধারণা করা হয় যে মমি চিত্রের শিল্পীরা নর্দার্ন ইউরোপ থেকে আঁকার সরঞ্জাম আমদানি করতেন। চিত্রে ব্যবহৃত এক ধরনের লাল রঙ পাওয়া গেছে যা সাউদার্ন স্পেনে তৈরি হতো। এ থেকে তৎকালীন মিশরীয় সাম্রাজ্যের সুদূরপ্রসারী বাণিজ্যের কথা বুঝা যায়। তাছাড়া, নীল রঙ ব্যবহারের আধিক্য থেকে বুঝা যায় যে নীল রঙ মিশরেই প্রস্তুত হতো।    

প্রতিকৃতিতে ব্যবহৃত পদার্থের পার্থক্য থেকে এও বুঝা যায় যে মিশরে মানুষের পদমর্যাদা অনুযায়ী চিত্রগুলো আঁকা হয়েছে। যেমন, স্বর্ণ পাতা ও দাহন রঙ ছিল দামী, তাই এগুলো ধনী ব্যক্তিদের ছবি আঁকতে ব্যবহৃত হতো এবং এর জন্য দক্ষ শিল্পীও লাগতো। অন্যদিকে সাধারণ রঞ্জক দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম ধনীদের ছবি আঁকা হয়েছে। 

ভবদা জানান, 'একটা মমি প্রতিকৃতি থাকা মানে আপনি সমাজে উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। কিন্তু আঁকার উপকরণের পার্থক্য বলে দেয় যে অর্থনৈতিকভাবে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ সেই সমাজে ছিল।'

ভবোদা ও তার দল আরো একটি বিষয় জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল । প্রশ্নটি ছিল, প্রতিকৃতিগুলো কি তাদের সাবজেক্ট বা বিষয়বস্তু জীবিত থাকাকালীন আঁকা হয়, নাকি মারা যাওয়ার পরে?

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ছবিগুলোতে তরুণ ব্যক্তিদের আবির্ভাব। তাদের বড়-ডাগর, প্রাণবন্ত চোখ মৃতর চাইতে জীবিত ব্যক্তিকেই বেশি নির্দেশ করে। তবে ভবোদা জানালেন, সেসময় মানুষের জীবনকাল দীর্ঘ ছিলনা, অনেকেই অকালে মারা যেতেন। 

তবে ভবোদা ও তার দল আরো নতুন নতুন প্রশ্নের উত্তরও অনুসন্ধান করছে। তিনি আশা করেন, যখন তারা সর্বোচ্চ ডেটা পাবেন তখন হয়ত সেস প্রশ্নের উত্তরও বেরিয়ে আসবে। কারণ প্রজেক্টের ষষ্ঠ বছরে এসেও তাদের আরো অনেককিছুই জানার ছিল এবং এই অনুসন্ধান হয়তো আরো অনেকদিনই চলবে। কারণ ভবোদা মনে করেন, তারা যত বেশি অনুসন্ধান করবেন; তত বেশি জানতে পারবেন। 

  • সূত্র: সিএনএন

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.