মিসরীয় ভাস্কর্যগুলোর নাক ভাঙা কেন?

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
18 June, 2020, 09:50 pm
Last modified: 18 June, 2020, 10:29 pm
ভাস্কর্যের 'জ্যান্ত' হয়ে ওঠার বিশ্বাস থেকে মানব প্রতিমা ভেঙে ফেলার এই চর্চা মিসরীয় ইতিহাসের একদম শুরু থেকেই চলছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রুকলিন মিউজিয়াম সমৃদ্ধ হয়ে আছে প্রাচীন ভাস্কর্যে। সেটির ইজিপসিয়ান আর্ট গ্যালারিতে আশা দর্শণার্থীদের কাছ থেকে কিউরেটর এডওয়ার্ড ব্লেইবার্গকে একটি প্রশ্ন বারবার শুনতে হয়েছে: 'ভাস্কর্যগুলোর নাক ভাঙা কেন?'

ইজিপসিয়ান, ক্ল্যাসিকেল ও প্রাচীন 'নিয়ার ইস্টার্ন' আর্টের ব্যাপক সংগ্রহের তদারকি করেন ব্লেইবার্গ। প্রথম প্রথম এ ধরনের প্রশ্ন শুনে তিনি চমকে যেতেন। ধরে নিয়েছিলেন, ভাস্কর্যগুলো নষ্ট। কোনো ভাস্কর্য একদমই নষ্ট হয়নি- কী করে সেটা বুঝবেন, সেই পাঠ নিতে ইজিপটোলজির ওপর প্রশিক্ষণ নেন তিনি।

১৩৫৩-১৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বের একটি ভাস্কর্যে কোনো এক রানির মুখের অংশবিশেষ

কী পেলেন উত্তর, চলুন জানা যাক সিএনএনের সূত্র ধরে।

হাজারও বছরের পুরনো কোনো শিল্পকর্ম দেখতে ভাঙা কিংবা বিচ্ছিন্ন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবু দর্শকদের প্রশ্নটি মাথায় রেখে গবেষণা চালিয়ে গেলেন ব্লেইবার্গ। জানতে পারলেন, কী কারণে বেশিরভাগ মিসরীয় ভাস্কর্যেরই এই 'খুঁত' রয়েছে।

মনে রাখা দরকার, হিউম্যান ফর্ম বা মানব রূপের ইমেজগুলোতে শক্তির প্রকাশ ঘটানো ছিল প্রাচীন মিসরীয়দের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তারা বিশ্বাস করতেন, দেব-দেবীর ভাস্কর্য বা চিত্রের ভেতর দেবশক্তি বিরাজ করে। এমনকি কোনো মানুষের ভাস্কর্যও যদি বানানো হয়, সেই ভাস্কর্যের ভেতর বিশেষ শক্তি বিরাজ করবে বলে ধারণা ছিল তাদের। এ কারণে ভাস্কর্যের 'অপশক্তি'কে খর্ব করে দিতে এই খুঁতের আবির্ভাব।

আচারনিষ্ঠতার জায়গা থেকেই বেশির ভাগ ভাস্কর্যের জায়গা হতো সমাধিস্তম্ভ আর প্রার্থনালয়গুলোতে। ব্লেইবার্গ বলেন, 'অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কাছে নিজেদের নিবেদন করার জন্য' প্রচুর খরচ করতেন প্রাচীন মিসরীয়রা। সমাধিস্তম্ভে তারা এ ভাবনা থেকেই খাবারও দিয়ে দিতেন, যেন মৃত লোকটির পরকালে কাজে লাগে! প্রার্থনালয়গুলোতে দেব-দেবীর পাশাপাশি রাজা কিংবা অন্যান্য অভিজাত লোকের নিজ খরচে বানানো ভাস্কর্যও জায়গা পেত।

আচার-অনুষ্ঠান চলাকালে 'এই দুনিয়া ও অতিপ্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে একটি মিলনবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হতো ভাস্কর্যগুলো,' বলেন ব্লেইবার্গ। আর সেই শক্তিকে খানিকটা খর্ব করার উদ্দেশ্যেই ভাস্কর্য ভাঙার রেওয়াজ চালু হয়।

মিসরীয় রানি হাতশেপসুতের ভাস্কর্য

ব্লেইবার্গ বলেন, 'ভাস্কর্যের শরীরের যে অংশটি ভাঙা হয়েছে, সেটি আর সক্রিয় হতে পারবে না,' এমনটাই বিশ্বাস ছিল। নাক না থাকলে ভাস্করে বিরাজ করা আত্মাটি নিঃশ্বাস নিতে পারবে না; এর ফলে ওই শক্তিটি 'মারা' যাবে। হাতুড়ি দিয়ে কোনো দেবতার ভাস্কর্যের কান ভেঙে ফেলা মানে ছিল, ওই দেবতা আর প্রার্থনা শুনতে পাবে না।

'ভাস্কর্যের কাজ আসলে কী- সে সম্পর্কে মিসরীয়দের একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল ফারাও যুগে,' বলেন ব্লেইবার্গ। এমনকি সমাধিস্তম্ভে হানা দেওয়া ছিঁচকে চোরও বিশেষ কিছু অনুষঙ্গ চুরি করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল; ভাবত, যদি ভাস্কর্যের বিশেষ অংশ সে ভেঙে না ফেলে, তাহলে তার ভেতরে থাকা মৃত লোকটি একদিন ঠিকই প্রতিশোধ নেবে।

ভাস্কর্যের 'জ্যান্ত' হয়ে ওঠার বিশ্বাস থেকে মানব প্রতিমা ভেঙে ফেলার এই চর্চা মিসরীয় ইতিহাসের একদম শুরু থেকেই চলছিল। উদাহরণ হিসেবে যদি ইচ্ছেকৃতভাবে খানিকটা ভেঙে ফেলা বা বিকৃত করে দেওয়া ফারাও যুগের মমিগুলোর কথা ধরি, সেটি আসলে 'মমিতে থাকা লোকটির শক্তিকে খর্ব করে দেওয়ার একেবারের সাংস্কৃতিক বিশ্বাস থেকে' উৎপত্তি, বলে জানিয়েছেন ব্লেইবার্গ।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ভাস্কর্য

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিশ্বাসেরও বদল ঘটেছে। বদল ঘটেছে ভাস্কর্যগুলো সম্পর্কে বিশ্বাস বা বোঝাপড়ায়ও। মিসরে খ্রিস্টান যুগে, অর্থাৎ, প্রথম থেকে তৃতীয় শতাব্দীতে ভাস্কর্যের ভেতর বাস করা দেশজ দেব-দেবীকে পৌত্তলিক প্রেত হিসেবে গণ্য করে ভয় পাওয়া হতো। পৌত্তলিকতার বিনাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে এগুলোর ওপর বারবার হামলা চালানো হয়েছে।

সপ্তম দশকে মুসলমানরা মিসর দখল করে নিলে, পণ্ডিতরা আন্দাজ করলেন, এইসব প্রাচীন আচারনিষ্ঠ অনুষঙ্গের প্রতি ভয় কেটেছে মানুষের। এ সময়ে ওইসব পাথুরে ভাস্কর্যকে নিয়মিতভাবেই ছেঁটে আয়তক্ষেত্র আকারে দালান নির্মাণ কাজের ব্লক হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

'প্রাচীন প্রার্থনালয়গুলো ছিল শিল্পের খনি', ব্লেইবার্গ বলেন, 'আপনি যদি মধ্যযুগীয় কায়রোর ছবির দিকে তাকান, দেয়ালে প্রচুর প্রাচীন মিসরীয় অনুষঙ্গের দেখা পাবেন।'

মিসরীয় সভ্যতার সেই প্রাচীন যুগের যে শিল্পকর্মগুলো এখনো টিকে রয়েছে, সেগুলোকে ফাইন আর্টের একেকটি মাস্টারপিস হিসেবে গণ্য করার মতো। এ প্রসঙ্গে ব্লেইবার্গ মনে করিয়ে দেন, "প্রাচীন মিসরীয়দের অভিধানে 'শিল্প' বলে কোনো শব্দ ছিল না। তারা এগুলোকে 'উপকরণ' হিসেবেই গণ্য করতেন।"

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.