মানুষ থেকেই কোভিড আক্রান্ত হতে পারে পোষা প্রাণি, কীভাবে বুঝবেন ও করণীয় 

ফিচার

10 September, 2021, 05:35 pm
Last modified: 10 September, 2021, 06:18 pm
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) গাইডলাইনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে যেসব পোষা প্রাণির কোভিড আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, কোভিড আক্রান্ত কোনো মানুষের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।

বৈশ্বিক করোনা অতিমারির মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি পোষা প্রাণির স্বাস্থ্য এবং মানুষ ও প্রাণিদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন অনেকে। চীনে ২০১৯ সালে ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর প্রাথমিক দিকে থেকে ব্যাপকহারে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সময়টাতে বিড়াল-কুকুরের মতো পোষা প্রাণি থেকে মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ হচ্ছে- এমন ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়ার পর চীনে পোষা প্রাণিকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা বেড়ে যায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। 

আমাদের দেশে এখনো এনিয়ে জনমনে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোষা প্রাণি সংক্রান্ত আলোচনায় উঠে আসছে নানা ধরনের প্রশ্ন। সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে এবং এনিয়ে সচেতনতা তৈরির বড় উদ্যোগ না থাকায় অনেকে তাদের পোষ্য বন্ধুর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন, বুঝতে পারছেন না কী করা প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এ লেখায়। 

পোষা প্রাণির করোনাভাইরাস এবং কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস 

উহানের হুবেই প্রদেশের পশুপাখি কেনা-বেচার বাজার থেকে ভাইরাসটির আদি সংক্রমণ শুরু হয়, ফলে এক পোষক দেহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির পোষক দেহে ভাইরাসে সংক্রমণের প্রক্রিয়ার বিষয়ে ভুল ধারণার কারণেই রাস্তায় পোষা প্রাণি ছেড়ে দেওয়ার সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। 

এ বিষয়ে ভুল ধারণা তৈরির আরেকটি কারণ হলো- বিড়ালের মধ্যে ফেলাইন করোনাভাইরাস (এফ-কোভ) ও কুকুরের মধ্যে ক্যানাইন করোনাভাইরাস (সি-কোভ) নামের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়। 

তবে এ দুটি করোনাভাইরাস ও কোভিড সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস এক নয়। করোনাভাইরাস দিয়ে ভাইরাসের একটি শ্রেণিকে বোঝানো হয়। এ শ্রেণির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাস রয়েছে। কোভিড সংক্রমণ ঘটানো করোনাভাইরাসটির নাম হলো সার্স-কোভ-২। 

প্রাণিদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণ 

এখন পর্যন্ত বাঘ, সিংহ, চিপমাঙ্ক, হরিণ ও কুকুর বিড়ালসহ বেশ কিছু প্রাণির মধ্যে কোভিড সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে। হংকং, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি, চিলি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, কানাডা, লাটভিয়া ও সুইজারল্যান্ডে মানুষ থেকে পোষা বিড়ালের মধ্যে কোভিড সংক্রমণের ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এ বিষয়ে জানিয়েছে, কোভিড আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসাই প্রাণিদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণের ঘটনা ঘটায়। সিডিসি'র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এসব প্রাণিদের থেকে মানুষের মধ্যে কোভিড ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে। 

ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর'র সেন্টার ফর ভাইরাস রিসার্চের (সিভিআর) গবেষকদের পরিচালিত ব্রিটিশ ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের (বিভিএ) ভেটেরিনারি রেকর্ডে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিড়াল থেকে মানুষে কোভিড সংক্রমণের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কুকুর, বিড়াল বা অন্য কোনো পোষা প্রাণি মানুষের মধ্যে কোভিড সংক্রমণে কোনো ভূমিকা রেখেছে এমন প্রমাণ মেলেনি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণাটিতে।  

মানুষ থেকেই ছড়ায় 

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) গাইডলাইনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে যেসব পোষা প্রাণির কোভিড আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, কোভিড আক্রান্ত কোনো মানুষের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।   

ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর এনিম্যাল হেলথ-ও (ওআইই) জানিয়েছে, পোষা প্রাণি থেকে মানুষের মধ্যে কোভিড সংক্রমণের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

পোষা প্রাণির মধ্যে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ

সিডিসি'র তথ্য অনুযায়ী, কোভিড আক্রান্ত পোষা প্রাণির মধ্যে কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, বমি ও ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে আক্রান্ত হলেও প্রাণিদের মধ্যে উপসর্গ দেখা যেতেও পারে, নাও পারে। এছাড়া প্রাণিদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণের উপসর্গ মানুষের তুলনায় মৃদু প্রকৃতির হয়। পোষা প্রাণির মধ্যে কোভিডজনিত মারাত্মক অসুস্থতা বিরল বলেও জানিয়েছে সিডিসি। 

পোষ্য বন্ধু আক্রান্ত হলে করণীয় 

পোষা প্রাণিদের মধ্যে কোভিডের যে সব লক্ষণ দেখা যায় তার সঙ্গে প্রাণিদের ভাইরাসঘটিত অন্যান্য রোগের উপসর্গেরও মিল রয়েছে। বিশেষ করে বিড়াল কুকুরের ফ্লু'র সঙ্গে উপসর্গগুলোর অনেক মিল রয়েছে। তাই, এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে কোভিড হয়েছে, ঝুঁকি কম এ ধরনের ধারণা নিয়ে বসে না থেকে যতো দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কেননা, টিকা দেওয়া হয়নি এমন পোষা প্রাণির জন্য কোভিডের চেয়ে ফ্লু-ই বেশি মারাত্মক। সময় মতো চিকিৎসা না দেওয়া হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হতে পারে। 

আদরের পোষ্য বন্ধু কোভিড আক্রান্ত হয়েছে নিশ্চিত হলে, তাকে বাড়ির অন্য পোষ্যদের চেয়ে আলাদা রাখতে হবে, যতোদিন না তার উপসর্গ কমে আসে। তার খাবারের বাটি, লিটার বক্স অন্য পোষ্যদের চেয়ে আলাদা রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়াতে হবে। মানুষের রোগ সারে এমন অনেক ওষুধই প্রাণিদের জন্য জীবননাশক হতে পারে। জ্বরের মতো উপসর্গের জন্য মানুষ প্যারাসিটামল খেয়ে থাকে, তবে প্রাণিদের কখনোই তা খাওয়ানো যাবে না। এ ধরনের ঘটনায় বিষক্রিয়ায় ওই প্রাণির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ, অসুস্থতার জন্য চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়ানো যাবে না। 

পোষ্যদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধ 

পোষা প্রাণিকে কোভিড সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে সিডিসি। কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিকে সব পোষা প্রাণির সঙ্গে সব রকম প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। সুস্থ মানুষ থেকে যেমন কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে থাকতে হয়, ঠিক সেরকম। তবে একেবারেই সম্ভব না হলে, বাড়িতে পোষ্য বন্ধুর যত্ন নেওয়ার আর কেউ না থাকলে, সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে জীবাণুনাশক দিয়ে হাত ধুয়ে ও মাস্ক পরে যতো কম সময়ের মধ্যে সম্ভব জরুরি কাজ সারতে হবে। যেমন, খাবার দেওয়া বা লিটার বক্স পরিষ্কার করা। তবে প্রাণিদের জন্য মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই, তাদের মাস্ক পরাতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে সিডিসি'র নির্দেশনায়। 

পোষা প্রাণিদের ত্বক, পশম ও চুলের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে কোভিড ছড়ায় এমন কোনো প্রমাণ নেই বলেও জানিয়েছে সিডিসি। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, জীবাণুর সংক্রমণ ঠেকাতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল জীবাণুনিরোধক, অ্যালকোহল বা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড এবং মানুষের ব্যবহৃত হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রাণিদের ওপর ব্যবহার করা যাবে না। এসব পণ্য প্রাণিদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক হতে পারে। বিশেষজ্ঞ পরামর্শ অনুযায়ী পণ্য ব্যবহার করতে হবে। 

এছাড়াও, বিড়াল কুকুর ছাড়াও হ্যামস্টার ও ফেরেটের মতো পোষা প্রাণির মধ্যেও মানুষ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.