মানুষের শরীরে ছাগলের অণ্ডকোষ: নাটের গুরু এই ডাক্তার

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
20 November, 2021, 11:10 pm
Last modified: 20 November, 2021, 11:11 pm
মানুষের শরীরে ছাগলের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন করেছিলেন এই ডাক্তার। কারণ?

১৯৩০ সাল। সেপ্টেম্বরের এক উষ্ণ সকাল। টগবগ করে ফুটছে আমেরিকার ক্যানসাস। উন্মত্তের মতো ছুটছে ক্যানসাস স্টেট মেডিক্যাল বোর্ডের একটি দল। তাদের পিছু পিছু ছুটছেন সাংবাদিকরাও। গন্তব্য ক্যানসাস থেকে মিলফোর্ড। উদ্দেশ্য, অবিশ্বাস্য এক ঘটনার সাক্ষী হবেন।

মিলফোর্ডে যে এক অসাধ্য সাধন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এক 'চিকিৎসক'। কী সেই অসাধ্য কাজ? এক রোগীর শরীরে ছাগলের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।

ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে জ্যান্ত ছাগলের নিম্নাংশ অসাড় করে ওই চিকিৎসককে প্রাণীটির দুটি অণ্ডকোষ কেটে বের করে আনতে দেখল ক্যানসাস স্টেট মেডিক্যাল বোর্ডের দলটি। এরপর ছাগলের অণ্ডকোষগুলো পাশের টেবিলে শুয়ে থাকা রোগীর শরীরে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে করলেন ওই চিকিৎসক।

এই অস্ত্রোপচার নিয়ে বিতর্ক অন্তহীন। যত বিতর্কই হোক, এই একটি অস্ত্রোপচারই গোটা বিশ্বে খ্যাতিমান করে তুলেছিল তাকে। রাতারাতি 'গোট গ্ল্যান্ড ডক্টর' নামে 'খ্যাতি' পেয়ে যান তিনি। 

তার নাম জন ব্রিঙ্কলি। আদতে তিনি ছিলেন এক হাতুড়ে চিকিৎসক।

ব্রিঙ্কলির জন্ম ১৮৮৫ সালে, উত্তর ক্যারোলিনায়। তার বাবাও ছিলেন হাতুড়ে ডাক্তার। ১৬ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনা চুকিয়ে ছোটখাটো কাজে ঢোকেন ব্রিঙ্কলি। কিন্তু বরাবরই চেয়েছিলেন বাবার মতো ডাক্তার হবেন। বাবার ওষুধের বই পড়ে চিকিৎসা নিয়ে বেশ 'জ্ঞানার্জন' করেন। এরপর একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ঠেলায় করে অলিগলিতে ওষুধ বেচার কাজ নেন।

১৯০৮ সালে স্ত্রীকে নিয়ে শিকাগো চলে যান ব্রিঙ্কলি। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন বেনেট মেডিক্যাল কলেজে। ওখানেই ব্রিঙ্কলি মানবদেহ সম্পর্কে নানা রকম জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু বেতন দিতে না পারায় তিন বছর পর তাকে কলেজ ছাড়তে হয়। ফলে ডাক্তারি সনদ নিতে পারলেন না তিনি। অগত্যা একটা নকল সনদ জোগাড় করে নিলেন।

তার পর ব্রিঙ্কলি চলে যান গ্রিনভিলে। সেখানে এক সহযোগীর সঙ্গে মিলে বিশেষ এক তেল বিক্রি করতে শুরু করেন। মানুষকে বোকা বানিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে সঙ্গমের ক্ষমতা অর্জনের কথা বলে এই ওষুধ বিক্রি করতেন তারা। কিন্তু কয়েক মাস এভাবে চলার পরই তাদের প্রতারণা ধরা পড়ে যায়। ফলে ব্যবসা গুটিয়ে ওই এলাকা ছেড়ে পালান দুজনে। পরবর্তীকালে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তারা।

এরপর ব্রিঙ্কলি পা রাখেন ক্যানসাসে। ওষুধ বিক্রির জন্য নকল সনদ কাজে লাগান এখানেও। নিজেকে মহিলা ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দেন। ক্যানসাসের সেনা রিজার্ভ মেডিক্যাল বিভাগের চিকিৎসকের চাকরি জুটিয়ে ফেলেন। বেতনের টাকাতেই স্বপ্নপূরণ করেন ব্রিঙ্কলি। ক্যানসাসের ইলেক্টিক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

এর পর বিভিন্ন প্রাণীর শরীর নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন ব্রিঙ্কলি। তখনই নাকি তিনি জেনেছিলেন সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর প্রাণী হলো ছাগল। 

১৯১৭ সালে ক্যানসাসে নিজের ১৬ কামরার একটি ক্লিনিক খুলে ফেলেন তিনি। স্থানীয়দের সবরকম রোগের চিকিৎসাই করতেন এই ক্লিনিকে। কিন্তু পরবর্তীতে সার্জন হিসেবে তিনি যশ ও অর্থলাভ করেন ব্রিঙ্কলি।

১৯১৮ সালে বিল স্টিটসওয়ার্থ নামে এক ব্যক্তি আসে তার ক্লিনিকে। নিজের যৌন দুর্বলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন বিল। ব্রিঙ্কলি নেহাত মজার ছলেই বিলকে বলেছিলেন, ছাগলের একজোড়া অণ্ডকোষেই তার মুক্তি লুকিয়ে রয়েছে। 

ব্রিঙ্কলির বিশ্বাস ছিল ছাগলই সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর প্রাণী

এ কথা শোনার পর ব্রিঙ্কলির পেছনে উঠেপড়ে লাগেন বিল। ছাগলের অণ্ডকোষ নিজের শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠেন। মূলত তার জোরাজুরিতেই অস্ত্রোপচার করতে রাজি হন ব্রিঙ্কলি।

তবে এর উল্টো মতও আছে। বিলের পরিবারের দাবি, ব্রিঙ্কলিই নিজের টাকার বিনিময়ে বিলকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে রাজি করিয়েছিলেন। 

যা-ই হোক, অস্ত্রোপচার সফল হয়। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন বিল। এরপর ঝড়ের গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ব্রিঙ্কলির নাম।

রোগীদের লাইন পড়ে যেতে থাকে ব্রিঙ্কলির ক্লিনিকের বাইরে। অঢেল টাকা কামাতে থাকেন তিনি। তাকে ছাগল সরবরাহ করার ঠিকাদারি নেন এক ব্যক্তি। 

এক মহিলার দেহে ছাগলের ডিম্বাশয়ও প্রতিস্থাপন করেন ব্রিঙ্কলি। উপার্জিত অর্থ শহরের উন্নয়নেরও কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। একটা ডাকঘর, একটা ব্যাংক স্থাপন করেন, রাস্তায় বৈদ্যুতিক আলো লাগান। একটা চিড়িয়াখানা খোলার চেষ্টাও করেন।

১৯২৩ সালে নিজের রেডিও স্টেশন চালু করেন ব্রিঙ্কলি। সেটার মাধ্যমে নিজের প্রচারণা চালাতে থাকেন। এর মাধ্যমে প্রতিদিনের অস্ত্রোপচারের কথা এবং নিজের অভিজ্ঞতা সবার কাছে পৌঁছে দিতেন। 

এভাবে অবশ্য খুব বেশি দিন কাটাতে পারেননি ব্রিঙ্কলি। প্রাথমিকভাবে অস্ত্রোপচার সফল মনে হলেও তার রোগীরা ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। কারও সঙ্গী হলো ভয়ঙ্কর সংক্রমণ, কেউ কেউ তো মারাই গেলেন। 

১৯৩০ সালে বাতিল হয়ে গেল ব্রিঙ্কলির চিকিৎসকের লাইসেন্স। এর ছয় মাস পর বাতিল হয়ে যায় রেডিওর লাইসেন্সও।

এরপর রাজনীতিতে হাত মকশো শুরু করেন ব্রিঙ্কলি। একাধিকবার ক্যানসাসের গভর্নর হওয়ার জন্য নির্বাচন করেছেন। যদিও প্রতিবারই হেরেছেন।

অপারেশন থিয়েটারে জন ব্রিঙ্কলি

তারপর টেক্সাসে গিয়েও গোপনে ছাগলের গ্রন্থি মানবদেহে প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু করেন ব্রিঙ্কলি। প্রচুর উপার্জন করেন সেখান থেকেও। নিজের এবং স্ত্রীর জন্য ১৬ একর জমির ওপর একটি বিলাসবহুল প্রাসাদ বানিয়ে থাকতে শুরু করেন। 

টেক্সাসেও লোক ঠকানোর এই কাজ বেশি দিন চালাতে পারেননি ব্রিঙ্কলি। লোকজানাজানি হতেই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ৩০ লাখ ডলার জরিমানা আদায় করা হয় তার কাছ থেকে। ১৯৪১ সাল নাগাদ নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন এই হাতুড়ে ডাক্তার।

জনপ্রিয়তার শিখরে উঠে আবার মাটিতে নেমে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি ব্রিঙ্কলি। এই ধাক্কায় তিনবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ক্রমেই স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। ১৯৪২ সালের ২৬ মে স্যান অন্টোনিয়োতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।


  • সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আনন্দবাজার পত্রিকা
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.