মানুষকে হারিয়ে যেতে সহায়তা করে যে কোম্পানি

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
07 September, 2020, 03:15 pm
Last modified: 07 September, 2020, 09:05 pm

যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি কিংবা যুক্তরাজ্য, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর কিছু মানুষ তাদের সকল পরিচয় পেছনে ফেলে উধাও হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা তাদের ঘরবাড়ি, চাকরি, পরিবার ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন আরেকটি জীবন শুরু করেন।

জাপানে এধরণের মানুষকে 'জুহাতসু' ডাকা হয়। জুহাতসু'র অর্থ অদৃশ্য, শব্দটি দ্বারা কয়েক বছর বা যুগের জন্য নিজের অবস্থান গোপন রেখে উধাও হয়ে যাওয়া মানুষকেও বোঝায়।

৪২ বছর বয়সী সুগিমোতো বলেন, "আমি মানব সম্পর্কের ব্যাপারে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি একটি ছোট সুটকেস নিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে যাই। আমি অনেকটা পালিয়েই এসেছিলাম।" 

তিনি জানান, তার পরিবার ও প্রসিদ্ধ পারিবারিক ব্যবসায়ের কারণে শহরের প্রায় সবাই তাকে চিনতো। পারিবারিক ব্যবসা তিনি চালিয়ে নেবেন পরবর্তীতে এমনটাই আশা করা হতো। এই চাপই তার জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি শহর ছেড়ে চলে যান।

ঋণের বোঝা, ভালোবাসাহীন বিয়ে সহ আরও বিভিন্ন কারণ কাজ করে জুহাতসুদের উধাও হয়ে যাওয়ার পেছনে। এই প্রক্রিয়ায় সাহায্যের জন্য তারা বিভিন্ন কোম্পানির দ্বারস্থ হয়ে থাকে। 'নাইট মুভিং' নামের সেবার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজটি করে থাকে। যারা নিজের বর্তমান জীবন থেকে উধাও হয়ে যেতে চায়, প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের এই কাজে সাহায্য করে, তাদের নতুন জায়গায় থাকার ব্যবস্থাও করে দেয়।

গত শতকের ৯০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত এমনই একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা শো হাতোরি বলেন, "সাধারণ মানুষের এই সিদ্ধান্তের পেছনে ভালো কারণই থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, নতুন চাকরি কিংবা বিয়ে করা। তবে দুঃখজনক কারণেও অনেকে এই সিদ্ধান্ত নেন। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া, চাকরি হারানো কিংবা দীর্ঘদিনের অনুসরণকারীর থেকে পালিয়ে বাঁচা।" 

তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, অর্থনৈতিক দুরাবস্থার হাত থেকে বাঁচার জন্যই মানুষ তাদের জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তিনি শিগগিরই অনুধাবন করেন, এর পেছনে অনেক সামাজিক কারণ-ও কাজ করে। 

"আমরা শুধু মানুষকে নতুন ও দ্বিতীয় জীবন শুরু করতে সাহায্য করি। "

সমাজবিজ্ঞানী হিরোকি নাকামোরি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জুহাতসুদের ব্যাপারে গবেষণা করছেন। তিনি জানান, ৬০ এর দশকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া মানুষকে বোঝাতে জুহাতসু শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। সেসময় এবং বর্তমানেও জাপানে ডিভোর্সের হার অনেক কম। তাই অনেক মানুষ-ই কঠিন ও দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের ঝামেলায় না গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন।

নাকামোরি বলেন, "জাপানে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়া তুলনামূলক সহজ। ব্যক্তির গোপনীয়তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত এখানে। নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া ব্যক্তি কোনো সমস্যা ছাড়াই এটিএম থেকে টাকা তুলতে পারেন। পরিবারের সদস্যদেরও সিকিউরিটি ক্যামেরার ভিডিও দেয়া হয়না। অপরাধ বা দুর্ঘটনার কারণ জড়িত না থাকলে পুলিশও হস্তক্ষেপ করে না। পরিবারের সদস্যদের বিপুল অর্থের বিনিময়ে গোয়েন্দা নিয়োগ দেয়া কিংবা অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।"

জোহাতসুদের পারিবারের জন্য ব্যাপারটি অনেকসময় বেশ কষ্টদায়ক। তারা আশা নিয়ে অপেক্ষমাণ থাকেন, খোঁজ চালিয়ে যান। এমনই একজন ২২ বছর বয়সী জোহাতসুর মা জানান, 'আমি বিস্মিত হই। সে তার চাকুরীজীবন নিয়ে হতাশাগ্রস্ত ছিল।' তিনি তার ছেলের বাড়ির সামনে দিনের পর দিন গাড়িতে বসে অপেক্ষা করেন। তবে সে কখনো ফিরে আসেনি। পুলিশও এব্যাপারে খুব একটা সাহায্য করেনি, তারা জানায় এটি আত্মহত্যার ঘটনা না হলে তারা কিছু করতে অপারগ।

 তিনি বলেন, ' আমি জানি এক্ষেত্রে তথ্যের অপব্যবহার হতে পারে। এটি প্রয়োজনীয় আইন হয়তো। তবে এক্ষেত্রে অপরাধী ও মা-বাবার ক্ষেত্রে একই ধরনের নিয়ম কার্যকর আছে। এই আইনের কারণে, টাকা না থাকলে আমার একমাত্র উপায়  বিভিন্ন মৃতদেহ দেখে আমার ছেলে কিনা তা পরীক্ষা করা।'

জোহাতসুদের নিজেদের জন্যই এই সিদ্ধান্ত অনেক সময় হতাশা ও অনুতাপের কারণ হয়। সুগিতোমো জানান, ' আমার প্রায়ই মনে হয় আমি ভুল কাজ করেছি। আমি বেশ ক'বছর আমার ছেলেমেয়েদের দেখিনা। ' তিনি জানান, তার ছেলেমেয়েদের ছেড়ে আসাই তার একমাত্র অনুতাপের কারণ।  

সুগিতোমো যেই প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়েছিলেন, তার প্রতিষ্ঠাতা সাইতা নামের এক নারী। তিনি নিজেও ১৭ বছর আগে এই জীবন বেছে নেন, শারীরিক অত্যাচারের একটি সম্পর্ক থেকে বেরুনোর জন্য তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন।

 'আমার এখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষ আসে। কেউ হয়তো নিজগৃহে অত্যাচারিত বা অন্যান্য ব্যক্তিগত কারণ। আমি কাউকে বলিনা তার কারণ গুরুতর নয়, প্রত্যেকের-ই ব্যক্তিগত লড়াই আছে।'

সুগিতোমোর মতো মানুষকে তার প্রতিষ্ঠান নিজের সমস্যাগুলো বুঝতে সাহায্য করে। সুগিতোমো উধাও হয়ে গেলেও তার পুরনো জীবনের সব স্মৃতি মুছে ফেলেননি।

 "শুধু আমার বড় ছেলেই প্রকৃত সত্যটা জানে। তার বয়স ১৩ বছর। তার কথাগুলোই আমি ভুলতে পারিনা। সে বলেছে, ' বাবা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বাবার জীবন। আমি এটা বদলাতে পারিনা।' তার কথাগুলো আমার চেয়েও বেশি পরিপক্ব শোনায়, তাই নয় কি?"

  • সূত্র: বিবিসি

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.