মহামারি যেভাবে ইতিহাসের বাঁক-পরিবর্তন করেছে

ফিচার

স্টিফেন মিহিম, ব্লুমবার্গ ওপিনিয়ন
06 April, 2021, 07:30 pm
Last modified: 08 April, 2021, 01:46 am
প্লেগ হানা দেওয়ার কালে ইউরোপে খ্রিস্টধর্ম ছিল সংখ্যালঘুদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস

গেল বছর যখন কোভিড-১৯ অতিমারি দেখা দেয়, তখন প্রায় সকলেই একে ১৯১৮ সনের ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারির সঙ্গে ঐতিহাসিক দিক থেকে তুলনা করেছিলেন। সেই তুলনা করাটা ছিল সাময়িক, কারণ এক শতাব্দী আগের ওই সময়ে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহামারির প্রভাবে আমূল পরিবর্তন আসার প্রমাণ তুলে ধরা সহজ ছিল না। তাই বর্তমান মহামারির শুরুর দিকে আমরা অনুধাবন করতে পারিনি আসলে ইতিহাসের কোন পালাবদলের সূচনা হলো। তবে বিশ্ব ইতিহাস বলছে, প্রাণঘাতী রূপ নেওয়া অনেক জীবাণুই দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীতে বিরাজ করেছে এবং সমসাময়িক সমাজ পরিবর্তনে রেখেছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব।    

প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য পর পর দুটি সংক্রামক ব্যাধিতে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছিল। এর একটি ছিল ১৬৫  থেকে ১৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তান্ডব চালানো এন্টোনিন প্লেগ। দ্বিতীয়টি হলো, ২৪৯ খ্রিস্টাব্দে হানা দেওয়া সাইপ্রিয়ান প্লেগ, ২৬০ সন পর্যন্ত মৃত্যুর মিছিল বজায় রাখে এই রোগটি। এই দুটি রোগ বা এর যেকোনো একটি বর্তমান সময়ের ভ্যারিওলা ভাইরাস বা স্মলপক্সের জীবাণুর পূর্বপুরুষ ছিল বলে ধারণা করা হয়।   

প্লেগগুলো হানা দেওয়ার কালে খ্রিস্টধর্ম ছিল সংখ্যালঘুদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। সমাজবিজ্ঞানী ও ধর্ম বিষয়ক পণ্ডিত রডনি স্টার্কের মতে, রোগগুলির প্রাদুর্ভাবের কারণেই মুষ্টিমেয় সংখ্যার খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মীয় দর্শনকে সমাজের মূল ধারায় ছড়িয়ে দিয়ে প্রধান ধর্মে রূপ দেওয়ার সুযোগ পায়, সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হতে থাকে 'পেগানিজম' বা দেবদেবীতে বিশ্বাসের প্রাচীন ধর্মগুলো।  

স্টার্ক আরও বলেন, পেগানরা যখন মহামারির কারণে এক অঞ্চল ছেড়ে আরেক অঞ্চলে পালিয়েও বাঁচতে পারছিল না, ঠিক তখনই খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীরা না পালিয়ে বরং ধর্মীয় দাতব্য কাজের মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জন করেন। তারা অসুস্থদের সেবার ক্ষেত্রে কে খ্রিস্টান আর কে পেগান-তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। অসুস্থদের সুস্থ করার চিকিৎসা পদ্ধতি তাদের জানা না থাকলেও, সেবার মাধ্যমে তারা মানুষের মধ্যে সাময়িক স্বস্তি ও নির্ভরতার এক ধর্ম বিশ্বাসের পথ উন্মোচন করেন- যে ধর্ম পীরিতকে খাদ্য, পানীয় ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার শিক্ষা দেয়। এই সেবার ফলে অনেকেই বেঁচেও যান। অর্থাৎ, জীবিত পেগানদের মানস জগতে খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হয়। তাছাড়া, খ্রিস্টানরাও সেবার এমন মূল্যবোধের কারণে অনেক বেশি পরিমাণে বেঁচে যান। 

স্টার্কের গবেষণা ইঙ্গিত দেয়- ওই সময়ে খ্রিস্টানরা বিশেষ করে তরুণ এবং সন্তান-সম্ভবা মায়েরা তাদের সমকক্ষ পেগানদের তুলনায় অনেকদিন বেশি বাঁচতেন। মহামারি থেকে বেঁচে যাওয়াদের একটি বিশাল অংশকেও ধর্ম পরিবর্তনে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন খ্রিস্টানরা। সেই হিসেবে দেখা যায়, বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ধর্ম রোম সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাওয়া স্বত্বেও সেটি মানুষের মৃত্যু ঠেকানো নিয়ে বিচলিত ছিল না। বরং পীরিতকে অবজ্ঞা করা বা ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়াটাই ছিল রীতি। সেকালে অল্প কিছু মানুষের বিশ্বাস থেকে খ্রিস্টীয়বাদ যেভাবে অবিশ্বাস্য গতিতে সমাজের প্রধান ধর্মে রূপ নেয়, তার পেছনে এটাই ছিল প্রধান কারণ।  

মহামারি সমাজের নৃতাত্ত্বিক বিন্যাসকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। যেমন; ১৩০০ শতকে ইউরোপে হানা দেওয়া 'ব্ল্যাক ডেথ' খ্যাত বিউব্যুনিক প্লেগের মহামারির কথাই বলা যাক। এটি শুধু ইউরোপের নয় বরং প্রাচীন বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারি। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে অতি শক্তিশালী সব প্রাদুর্ভাবের জন্ম দেয়। ইউরোপে একারণে ইহুদিদের উপর অত্যাচারের মাত্রাও চরম আকার ধারণ করে। তাদের অনেকেই পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন পোল্যান্ডসহ পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহে। এভাবেই বাস্তুচ্যুত ইহুদি জাতির আরেকবার সব হারানোর প্রেক্ষাপট তৈরি হয় (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে, নাৎসি দখলদারদের হাতে)।

প্লেগটি ইতিবাচক ঐতিহ্যও পেছনে রেখে যায়। এসব প্রভাবের মাত্রা নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও, একথা সকলেই মানেন মহামারি পরবর্তীকালে ইউরোপে দেখা দেয় কৃষিজীবী শ্রমিকের তীব্র সঙ্কট। ফলে বেঁচে যাওয়াদের অধিক মজুরি পাওয়া ও দর কষাকষির সুযোগ তৈরি হয়। তার ফলে আবার দেখা দেয় নজিরবিহীন কিছু পরিণতি, যেমন ব্ল্যাক ডেথ মহামারির শুরুর দিকে ইউরোপে প্রথম ন্যূনতম মজুরি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর, সামাজিক শ্রেণি বিন্যাসের উপর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও দেখা যায়। 

বিউব্যুনিক প্লেগের প্রথম ঢেউ আঘাত হানার এক দশক পর ইউরোপ জুড়ে নাগরিক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। মধ্যযুগ বিশেষজ্ঞ স্যামুয়েল কোহেন- এর সাম্পতিক এক গবেষণায় উঠে আসে তেমন বৃত্তান্ত। নিজ গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, এসব অস্থিতিশীলতা খাদ্য সঙ্কট বা কর্মপরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্ট মানুষের বিক্ষোভ ছিল না, বরং মহামারি থেকে রক্ষা পাওয়া জনতা আরও বেশি রাজনৈতিক দাবি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা তুলেছিল প্রাচীন সামন্তবাদী ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবি। কোহেনের মতে, কৃষক, কর্মকার ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে আত্মবিশ্বাসের নতুন আগুন জ্বেলেছিল এই প্লেগ। তারাও চাইলে পৃথিবীকে বদলাতে পারে এই বিশ্বাস তারা করা শিখেছিল।"

ওই প্লেগের চাইতে কম পুরোনো কিছু ব্যাধির প্রাদুর্ভাব এতো বেশি বিপর্যয়ের জন্ম না দিলেও, তা মানব সভ্যতার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের দিক থেকে কোনোভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কলেরার কথাই ধরুন, ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট এই রোগ পাকস্থলীর অন্ত্রনালীতে হানা দেয়, প্রায়শই তাতে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মারা পড়তো আক্রান্ত রোগী। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে রোগটির জন্ম হলেও তা ছড়িয়ে পড়েছিল পশ্চিমা জগতে। সেখানেও বিপুল প্রাণহানির কারণ হয় এটি। বিশেষ করে, লন্ডনের মতো শিল্পপ্রধান নগরগুলোর পয়নিস্কাশনের বর্জ্য খাবার পানির সঙ্গে মেশায় কলেরার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। 

তখনকার দিনে জীব বিজ্ঞানের প্রসার আজকের মতো সমৃদ্ধ ছিল না, তাই জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কিছুতেই এর উৎস বুঝে উঠতে পারছিলেন না। দূষিত বাতাসের মাধ্যমে এটি ছড়ায় বলে তারা অনুমান করেন। তখন লন্ডনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো আধুনিক নিস্কাশন পদ্ধতি না থাকায় প্রচণ্ড দুর্গন্ধের জন্ম দিত জমে থাকা নোংরা পানি। সেই গন্ধকেই রোগের উৎস মনে করে নগর কর্তারা মানববর্জ্য শহর থেকে নিরাপদে দূরত্বে সরিয়ে ফেলতে বিস্তৃত স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা তৈরি করলেন। 

নতুন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ব্রিটিশ চিকিৎসক জন স্নো কলেরা যে দূষিত পানিবাহিত রোগ তা আবিষ্কার করেন। তার এই আবিষ্কার নয়া স্যানেটারি ব্যবস্থার পক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তি দাঁড় করায়। স্নো'র তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক মহলে সমাদৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি নগরে কলেরা প্রতিরোধে আধুনিক পয়নিষ্কাশন চালুর গুরুত্ব উঠে আসে। অচিরেই বিশ্বব্যাপী বড় শহরগুলো নোংরা পানি চুইয়ে ভূগর্ভস্থ খাবার পানির সঙ্গে মিশ্রিত হওয়া ঠেকাতে স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা তৈরি করা শুরু করে।   

কলেরা আমাদের আধুনিক প্লাম্বিং দিলেও যক্ষ্মা দেয় রৌদ্রস্নানের জন্য বাসাবাড়িতে 'সানরুম' তৈরির চল। পশ্চিম গোলার্ধে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে এমন সানরুম বেশি দেখা যায়। যক্ষ্মা প্রতিরোধে চিকিৎসকরা মার্কিনীদের সুর্যালোকের অতিবেগুনী রশ্মির জীবাণুনাশক গুণ কাজে লাগানোর পরামর্শ দিতেন। তখন থেকেই রোদে পোড়া তামাটে ত্বক সুস্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে ওঠা শুরু করে। সুর্যালোক স্নানও হয়ে ওঠে অবসর কাটানোর প্রচলিত উপায়।

কিন্তু, অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা এবং স্যানিটেশনের এই প্রবণতাই সম্ভবত পোলিও'র মতো আরেকটি সংক্রামক ব্যাধির ছড়িয়ে পড়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। শুনতে রীতিমত বিস্ময়কর হলেও, তার পেছনের ইতিহাস একটু দেখা দরকার। বিংশ শতকের শুরুতে যখন রোগটি শিশুদের পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছিল- তখন চিকিৎসকরা লক্ষ্য করলেন- সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শ্বেতাঙ্গ ও ধনী পরিবারের শিশুরা এতে আক্রান্ত হলে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়।       

এনিয়েই একটি তত্ত্ব আছে, যেখানে বলা হয়েছে দরিদ্র পরিবারের কম বয়সী শিশুরা চারপাশের নোংরা পরিবেশে খুব ছোট থাকতেই পোলিও জীবাণুর সংস্পর্শে আসে। কিন্তু, তখন মাতৃ অ্যান্টিবডি সুরক্ষা থাকায় ভাইরাস তাদের গুরুতরভাবে আক্রান্ত করতে পারে না, ফলে সংক্রমণ ঘটলেও তা হয় দুর্বল প্রকৃতির। এই মাতৃ অ্যান্টিবডি গর্ভে ভ্রূণ পর্যায়েই শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করে, এবং জন্মের পর একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত তার প্রভাব থকে। সেই তুলনায় পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বাসকারী ধনী পরিবারের শিশুরা আরও বেশি বেড়ে ওঠার পর পোলিও আক্রান্ত হয়- যখন মাতৃ সুরক্ষা কবচটি আর থাকে না। 

বিগত কয়েক বছর ধরে এই তত্ত্বটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও, অণুজীবের সঙ্গে আমাদের সংস্পর্শের জটিল ও অনিশ্চিত সম্পর্কের অধ্যায়টি তাতে উঠে আসে। আমরা বুঝতে পারি, ক্ষুদ্র জীব জগতের সম্পর্কে অজানাই বেশি এবং আগে থেকে তাদের চরিত্র সম্পর্কে অনুমান করাটাও কঠিন। 

কোভিডের ক্ষেত্রে বলা যায় এখনও এর সম্পূর্ণ পরিণতি বিচারের সময় আসেনি। আমরা যদি সৌভাগ্যবান হই- তাহলে হয়তো ২৫ শতকের ইতিহাসবিদেরা এর কারণে হ্যান্ডশেকের মতো প্রচলিত অভ্যাস হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে লেখবেন। তার বদলে কীভাবে একে-অন্যের সঙ্গে কনুই ঠুকে অভিবাদনের নতুন ধারা (কাল্পনিক) জনপ্রিয়তা পেলো সেটাও হয়তো তারা রসিয়েই লেখবেন। অথবা "জুম" নামের একটি রহস্যময় ধর্ম! কীভাবে মহামারি তৈরি করলো- সেটাও স্থান পেতে পারে।   

আর আমরা যদি সৌভাগ্যবান না হই- তাহলে কী হবে? সেক্ষেত্রে রোমান সভ্যতার পরিণতিকে স্মরণে রাখুন। 

  • সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.