মহামারির মাঝে যেভাবে ঈদুল আযহা উদযাপন করবে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
29 July, 2020, 05:50 pm
Last modified: 30 July, 2020, 08:07 pm
১৮০ কোটি মুসলিম যে বিশ্বমারির মাঝে ঈদ উদযাপনে করবে, ইতোমধ্যেই তাতে আক্রান্ত হয়েছে এক কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ। 

করোনাভাইরাসের মহামারির প্রকোপে পৃথিবীজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি। এর মধ্যেই চলে এসেছে মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহৎ উৎসব- ঈদুল আযহার মাহেন্দ্রক্ষণ। ত্যাগের উৎসব নামে পরিচিত এ দিনটি বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় নানা দেশের সংক্রমণ বিস্তার নিরোধের রীতি মেনেই উদযাপন করতে চলেছেন। 

গত মে'তে অনুষ্ঠিত ঈদুল ফিতরের মতো এবারও উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা পালনের আহ্বান জানানো হচ্ছে। যার ফলে, আগামী ৩০ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত ঈদুল আযহা পালনের চিরায়ত ধরনেও পরিবর্তন আসবে । 

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনবহুল নগরী রাজধানী ঢাকাসহ, প্রধান প্রধান শহরের অভ্যন্তরে এবার কুরবানির হাট স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নগরের বাইরে হাট স্থাপন, অনলাইনে পশু ক্রয় এবং সিটি কর্পোরেশন নির্ধারিত স্থানে এবার কুরবানি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে করোনা প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কমিটি। রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য মহানগর থেকে সঙ্ক্রমণ বিস্তার রোধে ঈদের সময় যাতায়াত বন্ধ রাখারও সুপারিশ করা হয়।

যুক্তরাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহৎ সংগঠন- মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন (এমসিবি) তাদের ওয়েবসাইটে কিছু দিক-নির্দেশনা প্রকাশ করে। ঈদের দিন মুসলিমদের একত্রে উন্মুক্ত স্থানে বড় জামাত অনুষ্ঠানের পক্ষে নয় সংগঠনটি। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে উন্মুক্তস্থানে বা ঘরে ছোট জামাতে ঈদের নামাজ আদায়ের পরামর্শ দিয়েছে এমসিবি। 

এমসিবির নির্দেশনায় বলা হয়, খুতবা এবং ধর্মীয় উপদেশমূলক বক্তৃতার মাঝে যথেষ্ট সময় রাখা উচিৎ, তবে এগুলো যথাসম্ভব সংক্ষেপ করতে হবে। ঈদের অভিবাদন জানাবার সময় মুসাফাহ বা হাত মেলানো ও জড়িয়ে ধরার ঐতিহ্য এড়িয়ে চলাটাই উচিৎ।  

ঈদ উদযাপনের সবচেয়ে বড় অঙ্গ হলো; পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে ভোজন উৎসব। এক্ষেত্রে, এমসিবি'র পরামর্শ হলো; লোকসংখ্যা কম রাখা এবং তা ঘরের বদ্ধ পরিবেশ এড়িয়ে বাইরে আয়োজন করা। 

কানাডার কিছু মসজিদও একই ধরনের নির্দেশনা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে। টরেন্টোর জামে মসজিদ মুসল্লিদের জন্য আটটি স্বতন্ত্র জামাত আয়োজন করবে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত জামাতগুলোর মধ্যে যে কোনো একটিতে অংশ নেওয়া নিশ্চিত করা যাবে মোবাইল অ্যাপসের সাহায্যে। 

রাশিয়া অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের গ্রেট খান মসজিদে নামাজ আদায়রত তাতার মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা। ছবি: আল জাজিরা

এদিকে যারা নির্দিষ্ট জামাতের সময় বুকিং দিবে ব্যর্থ হবে, তারা বাড়িতেই ঈদের জামাত আদায় করতে পারবেন, বলে ফতোয়া দিয়েছে টরেন্টোর বসনিয়ান ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। 

সংগঠনটি ঈদের দিন সকালে ফজরের নামাজের পর থেকে ঈদ জামাতের পূর্ব পর্যন্ত সুন্নাহ অনুসরণে তাকবীর জিকিরের পরামর্শ দেয়। পাশাপাশি ঈদের দিন নিজের সবচেয়ে ভালো ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পড়ার রীতিটি পরিহার না করার আহ্বান জানিয়েছে বিআইএ। 

টানা দুইমাস মসজিদে নামাজ আদায় বন্ধ রাখার পর সৌদি আরব মসজিদের অভ্যন্তরে জামাত আদায়ের অনুমতি দিয়েছে। তবে উন্মুক্ত ময়দানে জামাত অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়নি। 

সৌদির ইসলাম ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়- জামাতে অংশ নেওয়ার সময় গতানুগতিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে কমপক্ষে দুই মিটার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মুসল্লিদের বাড়ি থেকে নিজ নিজ জায়নানাজ নিয়ে আসার নির্দেশনা দিয়েছে।  

গাজা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার:

দখলদার ইহুদিবাদি শক্তি ইসরাইলের দ্বারা অবরুদ্ধ- গাজা উপত্যকায় ঈদ হবে বিধি-নিষেধ না মেনেই। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম সম্প্রদায় স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও গাজায় তা খুব একটা পালন করা হবে না। 

ফিলিস্তিনিরা জানান, তারা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে এবার ঈদটি উদযাপন করবেন। উপত্যকায় সংক্রমণের ঘটনা খুব কম থাকায় তারা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন দেখছেন না। 

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, গত সোমবার নাগাদ মাত্র পাঁচজনের দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ে। তাদের সকলকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৭০ জন গাজাবাসী। 

''হাসপাতালের বাইরে এপর্যন্ত নতুন কোনো রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাই এটা আমাদের উৎসব উদযাপনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। সবকিছু আগের মতোই থাকবে'' বলছিলেন গাজা সিটির ৩১ বছরের একজন আরবি ভাষার শিক্ষক কারামা ফাদেল। 

তিনি জানান, তার ভাইবোনেরা থাকে তুরস্ক, বেলজিয়াম এবং মরক্কোতে। করোনাভাইরাস এবং ইসরাইয়েলি অবরোধের কারণে এবারও তাদের সঙ্গে ঈদ উৎসবে যোগ দিতে পারবেন না। 

গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে একটি খামারে কুরবানির পশু বিক্রির জন্য নিয়ে আসছে একজন ফিলিস্তিনি বালক। ছবি: আল জাজিরা

দরিদ্রদের মাঝে কুরবানির মাংস বিতরণ: 

ঈদুল আযহার প্রধান অনুষঙ্গ হলো; গরু, ছাগল, ভেড়া বা উটের মতো পশু কুরবানি। এরপর পশুর মাংস বিলিয়ে দেওয়া হয় পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী এবং দরিদ্রদের মাঝে। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কুরবানি দেওয়া ও তার মাংস বিতরণ করা অবশ্য কর্তব্য। 

কুরবানি ঈদ উপলক্ষে অনেক মুসলিম স্থানীয় মসজিদ বা ইসলামি দাতব্য সংস্থায় আর্থিক সহায়তা করেন। দানের অর্থে এসব সংগঠন পশু কিনে তা কুরবানি দেয় এবং মাংস দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করে। প্রতিবছর কুরবানিতে এভাবে লাখ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষ বিনামূল্যে আমিষের চাহিদা পূরণের সুযোগ পান। তবে কুরবানির প্রধান শর্ত আমাদের দেশে অনেকেই ভুলে যান। তা হল; কুরবানির পশু যেমন পরিচ্ছন্ন ও রোগমুক্ত হতে হবে, ঠিক তেমনি পশু পরিবহন বা বিপণন ব্যবস্থা কোনোভাবেই অমানবিক হওয়া যাবে না।    

মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের পরামর্শ কুরবানির মাংসের প্যাকেট হাতে হাতে না দিয়ে, যাকে দেওয়া হবে তার বাড়ির একটু নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসা যেতে পারে। 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণ ঘটেছে বিশ্বের অন্যতম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ায়। এ অবস্থায় গত মাসে দেওয়া এক নোটিশে শুধুমাত্র সংক্রমণের প্রভাবমুক্ত এলাকায় জামাতে ঈদের নামাজ আদায় এবং পশু কুরবানির অনুমতি দেওয়া হয়। 

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার উপকণ্ঠে স্থাপিত একটি হাটে কুরবানির পশুকে খাবার দিচ্ছেন একজন কর্মী। ছবি: আল জাজিরা

বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেও সতর্কতার কমতি নেই। ভারতের হায়দেরাবাদের এক মুফতি ফতোয়া দিয়েছেন যে, কুরবানির মাংসের বদলে সামর্থ্যবান মুসলিমরা সম পরিমাণ অর্থ দান করতে পারবেন। তবে মহামারির কারণে যারা কুরবানি দিতে পারছেন না, শুধু তাদের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।

পশুরহাটে গিয়ে অনেকেই করোনায় সংক্রমিত হবে, এমন আশঙ্কা দেখা দেওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি ওই ফতোয়া দেন।    

পাকিস্তান সরকার শহরাঞ্চলে ছোট ছোট পশুর হাট স্থাপন এবং উন্মুক্তস্থানে কুরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। 

গত রোববার দেশটির শীর্ষ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা জাফর মির্জা বলেন, '' আমি জনসাধারণের প্রতি পশুরহাটে যাওয়া থেকে বিরত থাকার আকুল আবেদন জানাই। আপনারা এর পরিবর্তে অনলাইনে কুরবানির পশু কিনতে পারেন।''  

পাকিস্তানের পরিকল্পনামন্ত্রী আসাদ উমর এক টুইট বার্তায় জানান, বিগত কয়েকদিনে সাড়া দেশের প্রায় পাঁচ শতাধিক অনুমোদনহীন পশুর হাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও চলতি সপ্তাহে একটি নির্দেশনা প্রকাশ করে। এর আওতায় প্রতি এলাকায় একটি বাড়িতে সকল পশু কুরবানি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। 
 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.