মহামারিকালে গরিবের চিকিৎসাসেবায় উদাহরণ হয়ে উঠেছে ফার্টিলিটি হাসপাতাল

ফিচার

06 September, 2021, 01:45 pm
Last modified: 06 September, 2021, 01:53 pm
প্রতিদিন মা ও শিশু মিলিয়ে প্রায় ১০০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে এখানে আসেন।

সবুজ আলম তার স্ত্রী চম্পা বেগমকে গত ২৪ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি করান। ২৫ তারিখ নরমালেই সন্তান জন্ম নেয় তাদের। সন্তান জন্মের পরে ৩ দিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে স্ত্রীকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় কথা হয় সবুজের সঙ্গে।

টিবিএসকে তিনি বলেন, 'এখানে এত অল্প খরচে যে এত ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়, তা আগে জানা ছিল না। এখানে মাত্র ৫ টাকায় টিকেট কেটে স্ত্রীকে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম; পরে ১০ টাকার টিকেট কেটে ভর্তি করিয়েছিলাম। আমার স্ত্রীর চিকিৎসায় এখানে এছাড়া আর কোনো টাকাই লাগেনি। শুধু বাইরে থেকে কিছু ঔষধ কিনতে হাজার খানেক টাকা লেগেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'হাসপাতালটির ডাক্তার ও নার্সরা সবসময়ই আমার স্ত্রীর খোঁজ নিয়েছেন। খাবার, ওষুধ- কোনোকিছুতেই সমস্যা হয়নি। আমি ভেতরে যেতে পারিনি, তবে আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকা শাশুড়ি সবসময়ই আমাকে জানিয়েছেন, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে এখানে রোগীর চাপ একটু বেশি থাকায় কিছু কিছু সেবা পেতে বিলম্ব হয়েছে।'

শুধু সবুজই নন, ১০০ শয্যার মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতালে সেবা ও চিকিৎসা নিতে আসা সবার অভিমতই এমন। বয়সে নবীন হলেও এ হাসপাতালের সেবায় রোগীরা বেশ সন্তুষ্ট। তবে লোকবল সংকট এবং রোগীর চাপ বেশি থাকায় কখনো কখনো সেবা পেতে কিছুটা বিলম্ব পেতে হয় রোগীদের।

করোনাকালে অন্যসব হাসপাতাল যেখানে অল্পসংখ্যক সাধারণ রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে, সেখানে এ বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৭৪ সালে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারটি নির্মিত হয়। ২০১০ সালে ১০০ শয্যার মা ও শিশু হাসপাতাল চালু করা হয়।

এ হাসপাতালে পরিবার পরিকল্পনা সেবা, শিশুদের টিকাদান, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, সন্তান প্রসবসহ মা ও শিশুদের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।

প্রতিদিন মা ও শিশু মিলিয়ে প্রায় ১০০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে এখানে আসেন, আর প্রতিমাসেই রোগী ভর্তি থাকেন প্রায় ৭০০'র মতো।

শুধু রোগীদের সেবা কার্যক্রমই নয়, এখানে দারিদ্র্য ও অস্বচ্ছল রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ, খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের এখানে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পরে বাসায় ফেরত যাওয়ার সময় পরবর্তী সময়ের জন্য ঔষধ ও খাবারের জন্য টাকা দেওয়া হয়। এ কার্যক্রম পরিচালনা করে সমাজসেবা কার্যালয়, নিয়ন্ত্রণ করে সমাজসেবা অধিদপ্তর।

হাসপাতালটির সমাজসেবা কার্যালয়ে দায়িত্বরত ফার্মাসিস্ট পারভিন আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'হতদরিদ্র্য যারা এখানে সেবা নিতে আসেন, তাদের সমাজসেবা ফান্ড থেকে বিনামূল্যে খাবার, কাপড় ও ওষুধ দিচ্ছি। এছাড়া আর্থিক সহায়তাও প্রদান করা হয়। ২০১২ সাল থেকে এখানে এ কার্যক্রম চালু রয়েছে।'

এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে একটি হেলথ কার্ডের মাধ্যমে আজীবন সেবা পান। এখানে তার সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনলাইনে লিপিবদ্ধ থাকে। রোগীর নিজস্ব আইডিতে তাই যেকোনো সময় চাইলে অতীতের রিপোর্ট দেখা কিংবা তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।

হেলথ কার্ডের এ সেবার উদ্বোধন করা হয় গত বছরের ১৭ মার্চ। এর কার্যক্রম শুরু হয় জুন মাস থেকে।

হেলথ কার্ডের সেবা সম্পর্কে অফিস সহকারী মুনিরা সাদিয়া টিবিএসকে বলেন, 'দিনে আমরা অন্তত ৯০ জনকে এ কার্ড দিচ্ছি। প্রতি মাসে প্রায় ১৫০০ কার্ড দেওয়া হয় রোগীদের। যেসব রোগী আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল, তাদের বিনামূল্যে কার্ড করে দেওয়া হয়।'

হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষাও করা হয় নামমাত্র মূল্যে। মাতৃত্বকালীন সময়ে মা ও শিশুদের যেসব পরীক্ষা করার দরকার হয়, সেসব এ হাসপাতালেই করার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১০০ রোগীর প্যাথলজি করানো হয়।

এ হাসপাতালে কোভিড-১৯ পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবু, কোনো রোগী করোনার লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও ঝুঁকি নিয়ে  তাদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তাররা। কারণ, গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসায় দেরি করা যায় না, জানান কর্তব্যরত কয়েকজন মেডিকেল অফিসার।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ১ সেপ্টেম্বর সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় এখানে ২৬ জন গর্ভবতী নারীর সন্তান প্রসব করানো হয়েছে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ১২টি 'ডেলিভারি' হয়, যেগুলো সম্পূর্ব বিনামূল্যে করানো হয়। সঙ্গে যেসব ওষুধ দরকার, সেগুলোও হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়। কোনো রোগীর সিজার দরকার হলে সেটাও বিনামূল্যে করানো হয়। শুধুমাত্র সিজারের পরে যাদের কেবিনে নিতে হয়, তাদের ৫ দিনে মাত্র ৩,৫৭৫ টাকা ব্যয় করতে হয় খাবার খরচসহ।

আগস্ট মাসে এ হাসপাতালে মোট ৬০৪টি ডেলিভারি হয়েছে, যার মধ্যে ৩০০টি সিজার ও ৩০৪টি নরমাল।

হাসপাতালটিতে রোগীর সেবা দিতে গিয়ে অল্পসংখ্যক ডাক্তার ও নার্সকে বেগ পোহাতে হয় বলে জানান তারা। হাসপাতালে পরিচালকসহ সব মিলিয়ে এখানে চিকিৎসক মোট ৫০ জন।

হাসপাতালের পরিধি বাড়ানো এবং জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মিত কথা বলা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের একটিমাত্র লিফটে রোগী ও কর্মকর্তাদের চাপ পড়ে যাওয়ায় আরও একটি লিফট স্থাপনের জন্যও আবেদন করা হয়েছে।

'এখন হাসপাতালটির বড় সমস্যা জনবলের ঘাটতি' উল্লেখ করে মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (এমএফএসটিসি) পরিচালক ড. মো. মুনিরুজ্জামান সিদ্দিক টিবিএসকে বলেন, 'এখানে এত অল্প জনবল নিয়েও আমরা যে সেবা দিয়ে যাচ্ছি, সেটা সবার কাছেই আশ্চর্যের। এ অল্পসংখ্যক লোকবল দিয়ে হাসপাতাল চালানো খুব কঠিন হয়ে যায়। এরপরেও আমরা কোনো রোগীকে ফেরত দিচ্ছি না। আমরা এখানে ব্যথামুক্ত ডেলিভারি সিস্টেম চালু রেখেছি।'

তিনি আরও বলেন, 'এখানে ৩০ টাকায় সিবিসি, ১১০ টাকায় সোনোলজি করানো হয়, যা অন্য কোথাও পাবেন না। এরপরেও আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। লোকবল সংকটের কারণে আমরা রোগীদের যথাসময়ে চিকিৎসা দিতে পারছি না। লাইন ধরে অনেকটা সময়ই তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সেবা পেতে। তবে আমরা জরুরি রোগীদের জন্য বিশেষ সেবা রেখেছি।'

এ ট্রেনিং সেন্টারে সরকারি ও এনজিওর মাধ্যমে ট্রেনিং দেওয়া হয়। সরকারির মধ্যে ডিজিএফপি ও ডিজিএইচ-এর ট্রেনিংগুলো সম্পন্ন হয়। এখানে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক, কাউন্সিলরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতি মাসে গড়ে ৫-৬টি ট্রেনিং চলমান থাকে। অধিকাংশ ট্রেনিং ৬ মাসের হয়ে থাকে। যারা ট্রেনিং করতে আসেন, তারা এ হাসপাতালে ডিউটি করেন।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.