মধ্য এশিয়ার বিস্মৃত এক সভ্যতার বিলুপ্তির জন্য চেঙ্গিস খান নয়, দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
06 March, 2021, 05:40 pm
Last modified: 06 March, 2021, 06:02 pm
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিঙ্কয়েনের গবেষকদের পরিচালিত এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ১৩ শতকের রক্তাক্ত আগ্রাসন নয়, বরং শুষ্ক আবহাওয়াই মধ্য এশিয়ার নদী তীরবর্তী মধ্যযুগীয় সভ্যতা বিলুপ্তির জন্য দায়ী।

১২০৬ সালে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের পর থেকেই তার অশ্ব-তীর-ধনুক চালিত সামরিক বাহিনী একে একে বর্তমান এশিয়ার মহাদেশের বেশিরভাগ অংশ, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপ দখল করে নেয়। এই সাম্রাজ্যের প্রায় অর্ধশতক সময়ের শাসনামলে ক্রমেই বাড়তে থাকে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সীমানা, বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ভূমিই মঙ্গোল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। 

মঙ্গোল সাম্রাজ্যই নিকট ইতিহাসে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অবিচ্ছিন্ন স্থলসাম্রাজ্য। ধারণা করা করা, বিভিন্ন দেশ ও রাজ্য দখলে গিয়ে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী ৪ কোটি মানুষকে হত্যা করে। একারণেই ইতিহাসে নৃশংসতা, ভয়াবহতা ও রক্তপাতের প্রতিশব্দ হিসেবেই পরিচিত চেঙ্গিস খান। তবে সম্প্রতি চেঙ্গিস খানের রাজ্য বিজয়ের ব্যাপারে চমকপ্রদ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, চেঙ্গিস খানের রাজ্য দখলে জলবায়ু পরিবর্তনেরও কিছুটা ভূমিকা ছিল!  

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিঙ্কয়েনের গবেষকদের পরিচালিত এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ১৩ শতকের রক্তাক্ত আগ্রাসন নয়, বরং শুষ্ক আবহাওয়াই মধ্য এশিয়ার নদী তীরবর্তী মধ্যযুগীয় সভ্যতা বিলুপ্তির জন্য দায়ী। এই অঞ্চলে গবষণা চালিয়ে গবেষকরা দেখতে পান জলবায়ুর কারণে মধ্য এশিয়ার আরাল সাগর অববাহিকার সভ্যতা বিলুপ্তির পেছনে দায়ী। ক্রমেই নদীগুলোর গভীরতা কমে যাওয়ায় সেচভিত্তিক কৃষিকাজ বাধাগ্রস্ত হতে থাকে । 

ইউনিভার্সিটি অব লিঙ্কয়েনের লিঙ্কয়েন সেন্টার ফর ওয়াটার অ্যান্ড প্ল্যানেটারি হেলথের পরিচালক মার্ক ম্যাকলিন এক বিবৃতিতে বলেন, "আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে মধ্য এশিয়ার নদী অববাহিকার বিস্মৃত জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তির কারণ চেঙ্গিস খান নয়, প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী।" 

৭ম ও ৮ম শতকে মধ্য এশিয়ায় আরবদের হামলা ও অধিগ্রহণের পর এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী দ্রুতই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়, কারণ তৎকালীন সময়ের জলবায়ুর আদ্র পরিবেশ এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ধারণের জন্য সুবিধাজনক ছিল। তবে মঙ্গোলদের হামলার পরপরই ভয়াবহ খরা, জলবায়ুর অবস্থা সব কিছুর প্রভাবে তীব্র খাদ্য সংকট শুরু হয়। জলবায়ুর অবস্থা এই অঞ্চলের মানুষের যতো ক্ষতি করেছে, চেঙ্গিস বাহিনীও ততো ক্ষতি পারেনি বলে জানান গবেষকরা।  

বর্তমান কাজাখস্তানের সির দরিয়া ও আরিস নদীর সন্ধিস্থলে ওতরার মরুদ্যানের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে গবেষণাটি চালানো হয়। ঠিক কখন থেকে সেচকাজে ব্যবহৃত খাল ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় তা জানতে এসব এলাকায় অনুসন্ধান চালান গবেষক দল। তৎকালীন সময়ে সেচ কাজে ব্যবহৃত নদীগুলোর গতি-প্রকৃতির ব্যাপারেও অনুসন্ধান করেন তারা। ১০ম- ১৪ শতকের নদীর পানির গভীরতা কমে যাওয়ার ঘটনার সাথে সেসময়ের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনার সংযোগ খুঁজে পান তারা। সে সময়ের সাথে মঙ্গোলদের হামলার সময় নয় বরং সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়কালেরই মিল খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। 

বিস্মৃত সভ্যতা 

বর্তমান সময়ের উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, দক্ষিণ কিরগিজস্তান ও দক্ষিণপশ্চিম কাজাখস্তানে বসবাসকারী প্রাচীন সভ্যতার নাম ট্রান্সঅক্সিয়ানা সভ্যতা। ৫ম শতকে সাসানিদ সাম্রাজ্যের শাসনামলে এ অঞ্চলটি বৃহৎ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ছিল। চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ব বাণিজ্য, সামরিক চলাচল ও সংস্কৃতির প্রসারের জন্য ব্যবহৃত নর্দার্ন সিল্ক রোডের কারণে এ অঞ্চলের অর্থনীতিও দ্রুত প্রসার লাভ করে। ৭ম শতকে গিয়ে আরবদের শাসনামলে এ অঞ্চলে ইসলামীকরণ শুরু হয়। আরবরাই এ অঞ্চলের নাম দিয়েছিল মাওয়ারাননহর।  

১২১৯ সালে চেঙ্গিস খান এ অঞ্চলে আক্রমণ চালানোর পর তার দ্বিতীয় ছেলে চাগতাইকে এ অঞ্চলের শাসনভার দেন তিনি। তখনই এ অঞ্চল চাগতাই খানাত হিসেবে পরিচিতি পায়। পার্সিয়ান ইতিহাসবিদ রাশিদাদ্দিনের মতে, চাগতাই একজন ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্যতাসম্পন্ন শাসক ছিলেন। (যদিও সেসময় ন্যায়পরায়ণের সংজ্ঞাই আলাদা ছিল।) 

তৈমুর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তুর্ক-মঙ্গোল বিজেতা তৈমুর বেগ ১৩৬৯ সালে ট্রান্সঅক্সিয়ানা শাসক হন। চেঙ্গিস খানের সরাসরি বংশধর না হওয়ায় তৈমুর খান খেতাব ব্যবহার করতে পারেননি। নিজেকে ঈশ্বর প্রেরিত মানব হিসেবে প্রচার করে তার শাসনামলকে ন্যায্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। এক যুদ্ধে ঘোড়ার ওপর থেকে পড়ে গিয়ে খোঁড়া উপাধিও পান তিনি। তবে তার শাসনামলে এই অঞ্চলে শিল্পকলা ও স্থাপত্যকলার ব্যাপক প্রসার হয়।

অঞ্চলটিতে সেচ ব্যবস্থা ভেঙে প্রায় ক্রমান্বয়ে সিল্ক রোডের ব্যবহার ও গুরূত্বও কমতে থাকে। ১৮ শতকের শেষে ওতরারে মাত্র ৪০টি পরিবার অবশিষ্ট ছিল। ১৪ শতকেও এ অঞ্চলে পরিবারের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার- ৭ হাজার। বর্তমানে ওতরার শহর এক মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে। 

  • সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.