জন্মহার বাড়াতে চায় চীন, তবে নারীদের ভাবনা ভিন্ন

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
12 March, 2021, 03:05 pm
Last modified: 12 March, 2021, 03:27 pm
'চীনে জনসংখ্যা কাঠামোর মূল কিছু সমস্যা নারী ও শিশুদের প্রতি সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণকেন্দ্রিক। সরকারের উচিত সর্বপ্রথম এই সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা।'

চীনে যখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজন, তখন চীনা নারীদের জীবনে সন্তান ধারণের চেয়ে অন্যান্য বিষয়ই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

ক্যারিয়ার গঠনের দিকেই বেশি মনোযোগী হচ্ছেন চীনা নারীরা। এ কারণে বিয়ে ও সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে সময় নিচ্ছেন; ভাবনা-চিন্তা করছেন অনেক বেশি। এমনকি অনেকেই পরিবার গঠনের ব্যাপারে তেমন আগ্রহই দেখাচ্ছেন না।

অন্যদিকে, বেইজিং কঠোর হাতে সামাজিক আন্দোলন দমন করলেও বাড়তে থাকা নারীবাদী আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করছেন না এখন পর্যন্ত। গৃহস্থালী কর্ম থেকে ঘরের বাইরে কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র সমঅধিকার স্থাপনে নারীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন নারীরাই।

কমতে থাকা জন্মহার এবং বাড়তে থাকা বয়স্ক জনশক্তি নিয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

জনসংখ্যা নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকায় বেইজিংয়ের নেতাদের এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনই হতে হচ্ছে নানা ক্ষেত্রে। কয়েকটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চীনের সামনে অপেক্ষা করছে খারাপ দিন।

একলা চলার পথই বেছে নিয়েছেন অনেক চীনা নারী। ছবিটি সংগৃহীত ও প্রতীকী

বেইজিং অধিবাসী ও উন্নয়ন অধ্যয়নের শিক্ষার্থী ২৬ বছর বয়সী হেলেনা লু জানান, একজন চীনার বড় হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে, কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পর বিবাহ ও সন্তান জন্মদান সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে।

'সন্তান ধারণের পর আমার ক্যারিয়ারে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে আমি চিন্তিত। এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন কেবলমাত্র নারীদেরই হতে হয়। বিশেষত চীনের মতো দেশে, যেখানে সন্তানের দেখভালের প্রায় পুরোটাই নারীদের ওপর চাপানো হয়,' বলেন লু।

তিনি আরও জানান, 'চীনে জনসংখ্যা কাঠামোর মূল কিছু সমস্যা নারী ও শিশুদের প্রতি সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণকেন্দ্রিক। সরকারের উচিত সর্বপ্রথম এই সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা।'

চীনা শিশু। ছবিটি সংগৃহীত ও প্রতীকী

জন্মহার হ্রাস

৫ মার্চ অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং বলেন, চীন চতুর্দশ পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনায় অবসরের বয়স সীমা বৃদ্ধি করবে। একইসঙ্গে দেশটি 'উপযুক্ত গর্ভধারণ হার' অর্জনেও কাজ করে যাবে।

ফেব্রুয়ারিতে চীনের কয়েকটি প্রদেশ ও শহরে ২০২০ সালের জন্মহার প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নবজাতক শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় চীনের এক শহরে শিশুর জন্মের হার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।

১৯৪৯ সালের পর ২০১৯ সালে চীনে জন্মহার ছিল সর্বনিম্ন। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, হাজারে জন্মহার ১০.৪৮।

২০২০ সালের পূর্ণাঙ্গ জন্মহার এপ্রিলে প্রকাশিত হলেও, পরিসংখ্যানবিদদের মতে, মহামারির কারণে এ বছর জন্মহার আরও কমবে। একইসঙ্গে, বিবাহের সংখ্যা কমলেও বাড়ছে বিবাহ-বিচ্ছেদের হার।

২০১৯ সালে চীনে ১৮.৯৪ মিলিয়ন মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিগত ১২ বছরের মধ্যে তা সর্বনিম্ন।

চীনা বয়স্ক প্রজন্ম। ছবিটি সংগৃহীত ও প্রতীকী

বয়স্ক জনগোষ্ঠী

নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর তুলনায় চীনে বাড়তে থাকা বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। ২০১৯ সালে যেখানে ৬৫ ঊর্ধ্ব নাগরিকের সংখ্যা ছিল ১৭৬ মিলিয়ন, পাঁচ বছরের মধ্যে সেই সংখ্যা ৩০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

একইসঙ্গে, প্রাতিষ্ঠানিক তথ্যানুসারে, ১৬ থেকে ৫৯ বছর বয়সী কর্মদক্ষতা সম্পন্ন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা টানা আট বছর ধরেই কমছে।

বাড়তে থাকা বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পেনশনের হার এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার খরচও বাড়ছে, সেইসঙ্গে কমছে অর্থনৈতিক সক্ষমতা।

চাকরির পাশাপাশি সন্তান সামলাতে হয় চীনা মাকে। ছবিটি সংগৃহীত ও প্রতীকী

কর্মজীবী মা

চীনের পূর্ব প্রদেশে তাইয়ানে চায়ের দোকান চালান সান লি। সান জানান, তিনি গৃহস্থালি খরচের সাশ্রয়ের জন্যই বেইজিং ছেড়েছেন। কিন্তু তার স্বামী সেখানে থেকে যান।

'তাইয়ানে খরচ অনেক কম। এখানে আমাদের ফ্ল্যাট ও গাড়ির ব্যয় বহনের সামর্থ্য রয়েছে,' বলেন সান।

৩৫ বছর বয়সী সান এবং তার স্বামী দ্বিতীয় সন্তানের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। তাদের দুই বছর বয়সী কন্যার জন্য সান তার মা ও শ্বশুর বাড়ির সাহায্য পান।

'দুটি সন্তানের খেয়াল রাখা অনেক পরিশ্রমসাধ্য। সারাদিন কাজ করে ঘরে ফিরে আমাকে সন্তানের খেয়াল রাখতে হয়,' বলেন সান। তিনি এও জানান, দ্বিতীয় সন্তান গ্রহণ না করার বিষয়ে তার মনে কোনো সংকোচ নেই। এমনকি তার অধিকাংশ বন্ধুই দ্বিতীয় সন্তান চান না।

সাংহাই একাডেমি অব সোশাল সায়েন্সের জেন্ডার সমতা বিষয়ক গবেষক চেন ইয়াইয়া জানান, নারীরা কর্মক্ষেত্রে যোগ দিলেও চীনের পুরুষেরা সন্তান লালন-পালনে নারীদের সাহায্য করেন না।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও জনসংখ্যা হ্রাসে একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে তারা সবেতনে পিতৃকালীন ছুটিসহ বিভিন্ন প্রণোদনা গ্রহণ করছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, জাপান সবচেয়ে দীর্ঘকালীন বেতনভোগী পিতৃকালীন ছুটি প্রদান করে থাকে- যা এক বছরেরও বেশি। অন্যদিকে, স্থানীয় শ্রম আইন অনুসারে, চীনের পুরুষরা মাত্র সাত থেকে ২৫ দিনের পিতৃকালীন কর্মবিরতি নিতে পারেন।

চীনে নারীর তুলনার পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। ছবিটি সংগৃহীত ও প্রতীকী

পুরুষের আধিক্য

চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় জনসংখ্যা হ্রাস পচ্ছে। অন্যদিকে, এসব দেশে পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে, চীনের জেন্ডার বৈষম্য অপেক্ষাকৃত বেশি। 

তিন দশক জুড়ে দেশটিতে সরকার নির্ধারিত এক সন্তান নীতি বজায় ছিল। দেশটির প্রান্তিক অঞ্চলে অধিকাংশ মানুষ পুত্র সন্তান কামনা করত। এর ফলে ২০১৯ সালে চীনে নারীদের তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা ৩০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।

সবচেয়ে ভারসাম্যহীন জেন্ডার অনুপাতের বয়স শ্রেণি ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ, সামনের দিনগুলোতে বিবাহ ও জন্মহার আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ছবি: গেটি ইমেজ

ক্ষমতাধর পুরুষ

বেইজিং অধিবাসী হেলেনা লু জানান, চীনের জনমিতি সম্পর্কে তার বক্তব্য না থাকলেও, তিনি মনে করছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে শীর্ষ নেতৃত্বদানে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়বে।

চীনের শীর্ষ রাজনৈতিক সংগঠনে কখনোই কোনো নারী সদস্য ছিলেন না। শি জিনপিং ছাড়াও দলের বাকি ছয় সদস্য পুরুষ।

'একজন নারী নেত্রী থাকার অর্থ, অন্য নারীরাও এ থেকে উপকৃত হবেন। অন্তত বৈষম্যের হার কমবে,' বলেন লু।

চীনে নারী ও নারীবাদ সম্পর্কিত দুটি বইয়ের লেখক লেতা হং ফিঞ্চারও সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলেন।

'চীনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বেশ গভীরেই পিতৃতন্ত্রের অবস্থান। শির সময়কালে তিনি যেমনটা চাইতেন, ঠিক সেভাবেই জাতির পক্ষে কল্যাণকর পরিবার গঠনের প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে- একজন নারী ও একজন পুরুষের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক, যেখানে নারী অধীনস্তের ভূমিকা পালন করে,' বলেন ফিঞ্চার।

২০১৮ সালের এক ভাষণে জেন্ডার সমতার বিষয়ে প্রচারণা ও নারী অধিকার সুরক্ষার কথা বলেন শি। তবে তিনি সমাজ ও পরিবারের নারীর 'অনন্য ভূমিকা'র ওপরও জোর দেন। নারীদের স্বাস্থ্যবান একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং বয়স্কদের সেবা প্রদানের দায়িত্ব নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বেইজিং বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হান সম্প্রদায়ের নারীদের দ্রুত বিবাহ ও সন্তান ধারণে উৎসাহ প্রদানে নানা প্রকল্পের উদ্যোগ নিচ্ছে। বিশেষত, উচ্চশিক্ষিত নারীদের সন্তান ধারণে আগ্রহী করে তোলার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ফিঞ্চার জানান, এর মধ্যে একটি হলো, অবিবাহিত বয়স্ক নারীদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা। এছাড়াও এক সন্তান নীতি অপসারণ করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ফিঞ্চার।

'সরকার বুঝতে পেরেছে, তাদের ভিন্ন পন্থা খুঁজে বের করতে হবে,' বলেন তিনি।

  • সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.