পানি নেই ছড়া এলাকায়, মরে যাচ্ছে ঝিরি-ঝরণা
''আমাদের পাড়ায় বাস করে ৫৬টি পরিবার। পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঘেরাউপাড়া ঝিরি। আমরা এই ঝিরির পানিই পান করি। সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। ঝিরিতে গর্ত খুঁড়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। এক কলসি পানি সংগ্রহ করতে অনেক সময় প্রয়োজন। তাও নিরাপদ না। ঝিরির পানিতে গোসল করি ও কাপড়ও ধুই। আবার এই পানিই খেতে হয়।''
কথাগুলো বলেছেন বান্দরবান রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঘেরাউ পাড়ার বাসিন্দা হ্লামেনু মারমা।
বান্দরবানে শুষ্ক মৌসুম এলে এভাবে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। একসময় সারা বছর পানি থাকত পাহাড়ি ঝিরি-ঝর্ণায়। কিন্তু বর্তমানে শুকিয়ে যাচ্ছে প্রায় সবগুলো। ফলে পানির অভাবে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় দুর্গম এলাকার পাহাড়ের বাসিন্দাদের। অথচ বছরের পর বছর ধরে পানি সংগ্রহের একমাত্র ভরসা ছিল এসব ঝিরি-ঝর্ণা ও ছড়া।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুপুর গড়িয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘেরাউপাড়ার একটি ছোট ছড়ায় ভিড় বাড়তে থাকে। এ সময় ক্ষেত খামার থেকে কাজ করে ফেরে ছোট-বড় সবাই। কেউ গোসল করতে আসে কেউ আসে পানি সংগ্রহের কাজে। পানি ঘোলা হওয়ায় ঝিরির মাঝখানে গর্ত করছেন কেউ কেউ। কেননা, গর্তে জমানো পানি একটু পরিষ্কার হয়। তবে পানি জমতে সময় লাগে। এভাবে পানি সংগ্রহ করে পান করছে পাড়ার সবাই।
স্থানীয় নুমেথুই মারমা বলেন, আগে শুষ্ক মৌসুমেও ঘেরাউ ঝিরিতে পানি পাওয়া যেত। ঝিরির উৎস এলাকায় টানা কয়েক বছর পাথর উত্তোলন চলছিল। এর ফলে পানির উৎস বন্ধ হওয়ার পর পানির সংকট দেখা দেয়।
ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ চউপ্রু মারমা বলেন, ঝিরির পানি হলেও আগে তা বিশুদ্ধ ছিল। ময়লা-আবর্জনা থাকত না। এক সময় এগুলো খেয়ে জীবন পার করেছি।
ঘেরাউ পাড়া থেকে আরও দুই কিলোমিটার দূরে বড়শিলাপাড়া । সেখানেও ৬০ পরিবারের মত বসবাস। শঙ্খ নদীর পাশে হওয়ায় পানির জন্য তেমন ভুগতে হয় না। তবে এলাকাবাসীর মতে, পানির সংকট না থাকলেও বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। ঘরের রান্না থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে সবাই নদীর পানি ব্যবহার করছে।
উচিংথোয়াই মারমা জানান, পাড়ার শিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তিরা নদীর পানি ফুটিয়ে পান করে। কিন্তু বেশির ভাগ পাড়াবাসী বিশুদ্ধ না করে খেয়ে ফেলে। সবসবময় না হলেও মাঝে মাঝে পানিবাহিত রোগের ভুগতে হয়।
অউমেউ মারমা বলেন, সকালে নদীতে একটি মরা কুকুর ভাসছিল। পানি সংগ্রহ করতে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়েছিল। আবার নৌকা চলাচলের কারণে পানি ঘোলা হয়ে যায়।
তারা সবাই জানান, বর্ষাকালেও নদীর পানি সবসময় ঘোলা থাকে। যা ব্যবহার অনুপযোগী। ঝিরিতে পানি আনতে গিয়ে পা পিছলে কেউ কেউ আঘাত পান। পাড়ায় আর কোনো বিকল্প সুপেয় পানি কিংবা বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। দূষিত পানি পান করে বছরে অধিকাংশ সময় পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকতে হয়।
স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য ও ঘেরাউ পাড়ার বাসিন্দা মেচিং অং মারমা জানান, পাড়ায় কয়েকটি গভীর নলকূপ বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পাথুরে এলাকা হওয়ায় পাইপ নিচে পর্যন্ত যাচ্ছিল না।
তবে এলাকাভেদে জিএফএস বা গ্র্যাভিটি ফ্লোর সিস্টেম (পাহাড়ি ছড়া বা ঝরণায় বাঁধ দিয়ে পরিশোধন করে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা) মাধ্যমে পানি সরবরাহ করলে সংকট কিছুটা দূর হবে বলে মনে করেন তিনি।
ঝিরির পানি ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রসঙ্গে বান্দরবান সদর হাসপাতালে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) প্রত্যুষ পাল ত্রিপুরা জানান, দূষিত পানি পান করে ডায়রিয়া রোগটাই প্রধান ঝুঁকি। এছাড়া টাইফয়েড ও আমাশয়সহ আরও পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
বর্ষার প্রথম দিকে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। কারন পাহাড়ে জমে থাকা ময়লা আবর্জনা বৃষ্টির পানিতে ভেসে আসে ঝিরিতে। ওই সময় ঝিরির পানি খাওয়া বিপদজনক। তবে এসব পানি ফুটিয়ে খেলে নিরাপদ বলে জানান এই চিকিৎসক।
মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহাবুবুল ইসলাম বলেন, এমনিতে শুষ্ক মৌসুমে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর নিচে নেমে যায়। তার উপর পাহাড়ে গাছপালা নিধন, নির্বিচারে পাথর উত্তোলন ও সনাতন পদ্ধতির চাষাবাদে পানির উৎস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সব ঝিরি-ছড়া শুকিয়ে গেলে একসময় তীব্র পানি সংকট দেখা দেবে পাহাড়ে।
দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পানি সংকটের জন্য মনুষ্যসৃষ্ট কারণকে দায়ী করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের জেলা সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই।
তিনি বলেন, অবৈধ পাথর উত্তোলন ও অপরিকল্পিতভাবে গাছ কেটে বন উজাড় করায় পানির উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। ঝিরি-ছড়াগুলো শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় এ পর্যন্ত তিন শতাধিক ঝিরি-ঝর্ণা ও ছড়া মরে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই সংখ্যাটা দিন দিন আরও বাড়তে থাকবে।
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সোহরাব হোসেন বলেন, পার্বত্য এলাকায় ভূ-প্রকৃতি ভিন্ন। ৩০ শতাংশ পাথরিয়া ভূমি। যে কোনো স্থানে রিংওয়েল কিংবা গভীর নলকূপ বসানো যায় না।
ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানি সরবরাহের মাধ্যমে এই সংকট উত্তরণ হতে পারে বলে জানান তিনি।