দক্ষিণ কোরিয়ায় ফুড -ডেলিভারি রোবট বানালেন তরুণ বাংলাদেশি উদ্যোক্তা

ফিচার

শেখ রাফি আহমেদ
11 August, 2021, 11:45 pm
Last modified: 12 August, 2021, 05:14 pm

লাবিব যখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র‍্যাজুয়েট শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। কিন্তু ওই বয়সেই দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শুরু করে স্পেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র; বিশ্বের নানা প্রান্তে আমাজন, হুন্দাইয়ের মতো বিখ্যাত কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগকারীদের সাথে আলাপ হয়ে যায় লাবিব ও তার বন্ধুদের। 

"যখন আমরা স্কুলে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতাম, তখন আমাদের সম্ভাব্য এক স্পন্সরের কাছ থেকে অন্য স্পন্সরের কাছে ছোটাছুটি করতে হতো। তাদেরকে বোঝাতে হতো যে কেন আমাদের ইভেন্টে তাদের স্পন্সর করা উচিত, তাতে কি লাভ হবে তাদের ইত্যাদি। 'নিউবিলিটি'র ব্যাপারটাও প্রায় সেরকমই; তবে এটা বেশ বড় পরিসরে", বললেন লাবিব। 

লাবিব তাজওয়ার রহমান 'নিউবিলিটি' এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। নিউবিলিটি হলো দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলভিত্তিক একটি কোম্পানি, যারা ভিশন-বেইজড লোকালাইজেশন এবং পথ-পরিকল্পনা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ফুড-ডেলিভারি রোবট তৈরি করবে। অর্থাৎ মানুষ নয়, তাদের তৈরি রোবটই সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় তার অর্ডারকৃত খাদ্য পৌঁছে দিবে। এরই মধ্যে হুন্দাই মোটরস এর মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করেছে নিউবিলিটি। 

বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে বললেন লাবিব, "নিউবিলিটি মূলত চূড়ান্ত ডেলিভারি নিশ্চিত করার জন্য রোবট তৈরি করে। আমাদের রোবটগুলো রেস্টুরেন্ট থেকে আপনার খাবার সংগ্রহ করবে এবং কোনো রকম মানুষের সাহায্য ছাড়াই সেই খাবার আপনার হাতে পৌঁছে দিবে।"

লাবিবের সাফল্যের মুকুটে পালকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়! তিনি 'ইনক্লুশনএক্স' নামে বাংলাদেশে একটি মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ডিজ্যাবিলিটি ইনক্লুশন সার্ভিস চালু করেছেন। এছাড়াও, লাবিব স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ফিজিক্স সোসাইটির সহ-সভাপতি। 'স্ট্যানফোর্ড ডিজ্যাবিলিটি ল্যাঙ্গুয়েজ গাইড' নামক একটি বইও লিখেছেন তিনি। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, লাবিবের লেখা এই বই এখন স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনে প্রদর্শিত রয়েছে এবং আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বইটি তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 
২০১৫ সালে যখন লাবিব দশম শ্রেণীতে পড়তেন, তখন তার পরিচয় হয় অ্যান্ড্রু লি ও চিউংহো চো (নিউবিলিটি'র বাকি দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা) এর সাথে। তারা তিনজনই নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টারে অনুষ্ঠিত কনরাড অ্যাওয়ার্ডে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনজনেই ছিলেন ফাইনালিস্ট, আর এখান থেকেই তাদের বন্ধুত্বের যাত্রা শুরু হয়। 

লাবিব বললেন, "প্রতিযোগিতার পরেও বহুদিন পর্যন্ত আমরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলাম। সবসময় ভাবতাম তিনজন মিলে কিছু একটা উদ্ভাবন করা যায় কিনা! শেষ পর্যন্ত আমরা 'নিউবিলিটি' গড়ে তুললাম।" 

তিনি আরও বলেন, "প্রাথমিকভাবে আমরা গেমিং এ আনুষঙ্গিক বানানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। এই আইডিয়া নিয়ে আমরা দুয়েক বছর কাজও করেছি। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষ দ্বারা পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার বিকল্প খুঁজছিল। সেই থেকে আমরা ডেলিভারি রোবট বানানোর সিদ্ধান্তে আসি।" 
রোবটের মাধ্যমে খাবার ডেলিভারি দেওয়া- শুনতে খুবই দূরদর্শিতাপূর্ণ পদক্ষেপ মনে হচ্ছিলো। তাই লাবিবের কাছে জানতে চাইলাম, কিভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলো। 

সত্যিকার অর্থে, দক্ষিণ কোরীয় নাগরিকরা প্রচুর পরিমাণে ই-কমার্স সাইট ব্যবহার করে। তাদের এই উচ্চ চাহিদার কারণে এবং দেশের ই-কমার্স বাজারের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের কায়িক শ্রম ব্যবহার করার বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো তাদের জন্য। তারা এর বিকল্প পদ্ধতি খুঁজছিল, বিশেষ করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির উপরে ভরসা করতে চাচ্ছিলো তারা।

লাবিবের ভাষ্যে, "এই মুহূর্তে এই ধারণাটা শুধুমাত্র সিউলের মত নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত শহরেই বাস্তবায়ন সম্ভব। এমনকি আমেরিকার অনেক শহরও সিউলের মত এতটা পরিকল্পিত না। তবে আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাই হাতে রেখেছি।" 

সাপ্লাই চেইনের যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো ধরনের পণ্য এই রোবটগুলো ডেলিভারি দিতে পারে। বর্তমানে আমরা এই রোবটগুলোকে শুধু হুন্দাই এর মত কোম্পানিগুলোর অভ্যন্তরীণ কাজে ব্যবহারের উপযোগী করে বানাচ্ছি। আস্তে আস্তে আমরা সিউল শহরে এবং এর বাইরেও খাবার ডেলিভারি দেওয়ার মত রোবট বানানো শুরু করবো", বললেন লাবিব। 
এই মুহূর্তে লাবিব ও তার বন্ধুরা মিলে নতুন একটি সফটওয়্যার তৈরি করছেন, যাতে করে রোবটগুলো মানুষের দোরগোড়ায় খাবার পৌঁছে দিতে পারে। 
এই সফটওয়্যার সারা শহরের মধ্যে চিহ্নিত পথ তৈরি করবে। এসব পথ অনেকটা গুগল ম্যাপের মত। এগুলো ব্যবহার করেই রোবটেরা গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দিবে। 

এছাড়াও, রোবটগুলোতে এমন প্রোগ্রাম ব্যবহার করা হবে যে, এরা রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলতে পারবে। এর বাইরেও, একজন মানুষ খাবার ডেলিভারি দিতে গেলে সম্ভাব্য যেসব সমস্যায় পড়তে পারে, রোবটগুলোকে সেসব প্রতিকূলতা এড়িয়ে যাওয়ার মত সক্ষম করে বানানো হবে। 

লাবিব বলেন, "এটা খুব কঠিন একটা কাজ, আমরা জানি। কিন্তু আমাদের পার্টনাররা একেকটা মাইলফলক পার হওয়ার সময় বেঁধে দিয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটা ধাপ এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরও টাকা বরাদ্দ পাবো।"

"একটা স্টার্টআপ টিকিয়ে রাখা যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনি উত্তেজনাকরও বটে! প্রতিটা ধাপ, প্রতিটা চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এলে যে আনন্দ হয়; তা আমাদের আরও অনুপ্রাণিত করে তোলে", জানালেন তিনি। 
ইনক্লুশনএক্স এর গল্পটাও জানাতে ভুললেন না লাবিব। 
তিনি বলেন, "ইনক্লুশনএক্স আমার একটা ব্যক্তিগত জায়গা বলা যায়। আমার ছোট ভাইয়ের সেরেব্রাল পালসি আছে। আমি তার সঙ্গে তার স্কুলে যেতাম। সেখানে শারীরিকভাবে অসুস্থ বা অক্ষম, এমন কিছু মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে আমার। কিন্তু বড় হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার বন্ধুবান্ধবেরা শারীরিকভাবে অক্ষমদের নিয়ে বেশ অসংবেদনশীল। তারা আমার ভাইকে নিয়েও মজা করতো।" 

ভাইয়ের মৃত্যুর পর লাবিব তার কিছু বন্ধুদের নিয়ে শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য পরিচালিত কিছু স্কুলে নিয়ে গেলেন। তাদের দুঃখে সমব্যথী করতে চেয়েছিলেন তিনি। 

লাবিব বলেন, "আমি একটা গুগল ফর্ম তৈরি করে ফেসবুকে ছাড়লাম। দুই মাসে আড়াইশোর মত মানুষ সেখানে স্বাক্ষর করলো। তাদেরকে নিয়ে আমি সেসব স্কুলে গেলাম। আর বাচ্চারাও আমাদের উপস্থিতি পছন্দ করতো। তারা আমাদের জিজ্ঞেস করতো, আবার কবে আসবো, কখন আসবো!" 

স্কুলগুলো পরিদর্শন করতে করতে লাবিব বুঝতে পারলেন যে তার মত আরও অনেক তরুণ শারীরিকভাবে অক্ষমদের সঙ্গে কথা বলতে, তাদেরকে জানতে ইচ্ছুক। কিন্তু লাবিব আরেকটু আনুষ্ঠানিকভাবে একটা উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন তাদের জন্য। সে চিন্তা থেকেই 'ইনক্লুশনএক্স' এর শুরু। 
প্রাথমিকভাবে তারা অক্ষম শিশুদের জন্য একটা কম্পিউটার ট্রেনিং প্রোগ্রাম চালু করলেন। পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ কর্তৃক আয়োজিত ইভেন্টের অংশীদার হতে শুরু করেন। ঢাকার বিভিন তথাকথিত নামিদামি স্কুলের বাচ্চারা সেসব প্রোগ্রামে অংশ নিতো। 
এরপর বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে শুরু করে ইনক্লুশনএক্স।

বিশেষ শিশুদের বিভিন্ন প্রতিভা উঠে এসেছে তাদের বানানো ভিডিওতে; যার দুই মিলিয়ন ভিউ হয়েছে। 
ঈদ, পহেলা বৈশাখের মত বিশেষ উৎসবে তারা বিভিন্ন ইভেন্টেরও আয়োজন করেন। 

লাবিবের কাছে শেষ প্রশ্ন ছিল, কিভাবে তিনি এত এত উদ্যোগ ও কাজের চাপ সামলান? বিশেষত স্ট্যানফোর্ডের মত একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার পাশপাশি তা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায় কিনা! 
"আসলে মূল ব্যাপার হলো সময়টা নিখুঁতভাবে ব্যয় করা। আমার এখানে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার চাপ অত্যন্ত বেশি। তাই আমাকে সে অনুযায়ী কোন কাজে কতক্ষণ সময় বরাদ্দ রাখবো তা ঠিক করতে হয়। মাঝেমাঝে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার এ কাজে আমাকে সাহায্য করে। কখনো কখনো আমিও খুব হাঁপিয়ে উঠি। কিন্তু পৃথিবীতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে এটুকু আত্মত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে আমাকে!", এই বলে থামলেন লাবিব।  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.