ঢাকার এক বিস্মৃত চিকিৎসক

ফিচার

26 November, 2021, 01:15 pm
Last modified: 26 November, 2021, 05:44 pm
ভিন্নদেশের, ভিন্নভাষী, ভিন্নবর্ণের মানুষ হয়েও সিম্পসন ঢাকাবাসীর অতি আপনজন– তাদের প্রিয় ডাক্তার সাহেব!

১৮৭০ সালে এক অজানা ফটোগ্রাফারের তোলা ছবিতে নারিন্দা খ্রিস্টান গোরস্তান।

১৮৬৪ সালের ১৫ই নভেম্বর দিনটি ছিল মঙ্গলবার। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থানের দীর্ঘ ঘাসের ঝোপে অবশ্য তখনই অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা হলে এই এলাকায় সহজে কেউ পা বাড়ায় না। কিন্তু সেদিন পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য। আছে ইংরেজ, আর্মেনীয়, বাঙালিসহ সব ধরনের মানুষ। ঘোড়ার গাড়ি আর জনমানুষের ভিড় ঠেলে কয়েকজন নারীও এসেছেন; তারা কাপড়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন। যার শেষকৃত্যে সবাই সমবেত হয়েছেন তিনি কিন্তু তাদের কারও আত্মীয় বা এই শহরের কোনো রাজনৈতিক নেতা নন। তিনি হলেন ইউরোপীয় চিকিৎসক আলেকজান্ডার সিম্পসন। একজন ভিন্নদেশের, ভিন্নভাষী, ভিন্নবর্ণের মানুষ হয়েও সিম্পসন ঢাকাবাসীর অতি আপনজন– তাদের ভীষণ প্রিয় ডাক্তার সাহেব!

নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে ১৮৫৮ সালে যাত্রা শুরু করে মিটফোর্ড হাসপাতাল। নলগোলায় যে স্থানে এই হাসপাতাল গড়ে ওঠে সেখানে দুই কবিরাজের জমি ছিল। আধুনিক সুবিধাবঞ্চিত ঢাকাবাসীর একমাত্র আশ্রয় তখন কবিরাজি চিকিৎসা। ফলে আধুনিক চিকিৎসার হাসপাতালের জন্য জমির দখল পেতে ঢাকার তৎকালীন কালেক্টর ও বিভাগীয় কমিশনারকে বেশ বেগ পেতে হয়।

ঢাকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেই সমাজে শল্য চিকিৎসা নিয়ে ব্যাপক আতঙ্ক তো ছিলই, তার সাথে যোগ হয় জীবিকা হারানোর ভয়ে ভীত কবিরাজদের অপপ্রচার। ফলে জন্মলগ্ন থেকেই মিটফোর্ড হাসপাতালের পথচলা হয়ে ওঠে দূরহ। আর এই বিরূপ পরিবেশে হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্টের দায়িত্ব কাঁধে নেন আলেকজান্ডার সিম্পসন।

এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট সিম্পসন ইতঃপূর্বে বেশ কিছুকাল ঢাকার সিভিল সার্জন হিসেবে কাজ করেছেন। ঢাকাবাসীর নাড়ি-নক্ষত্র তার মতো ভালো আর কে জানবে? সব অপপ্রচার উপেক্ষা করে অল্প কয়েকজন কর্মী নিয়ে সিম্পসন শুরু করলেন হাসপাতাল গড়ে তোলার কাজ। মাত্র পাঁচ বছরেই এই নবনির্মিত হাসপাতালকে তিনি পূর্ববঙ্গের রোগীদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করলেন।

সিম্পসনের সমাধিফলকের অনুলিপি।

প্রথম বছর মাত্র ৫০টি চৌকি নিয়ে হাসপাতালের কাজ শুরু হলো। কিন্তু হতদরিদ্র রোগীদের অধিকাংশেরই নিজস্ব বিছানাপত্র ছিল না। সিম্পসন এসব চৌকির জন্য বিছানার ব্যবস্থা করলেন। মহামারি কলেরা ছিল সেকালের বড় আতঙ্কের নাম। প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল মাসে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষ মারা যেত।

মহামারির বাইরে রোগীরা সাধারণত যেসব অসুখ নিয়ে আসত তার মধ্যে প্রধান ছিল- ডায়েরিয়া, ম্যালেরিয়া, প্লীহাস্ফীতি, বাত, রক্তশূন্যতা, যৌন রোগ ইত্যাদি। এর পাশাপাশি ছিল সাপে কাটা, হাত-পা ভাঙা, কেটে বা পুড়ে যাওয়ার মতো নানা দুর্ঘটনায় আহত রোগীও। সিম্পসনের উদ্যোগে অভ্যন্তরীণ বা ভর্তিকৃত রোগীর পাশাপাশি বহির্বিভাগেও চালু হলো রোগীর সেবা।

রক্ষণশীল সমাজে নারীরা ছিল সবচেয়ে অবহেলিত, অধিকাংশ সময়ে চিকিৎসা বঞ্চিত। এ অবস্থায় প্রসূতি নারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাসপাতালের অর্থায়নে চিকিৎসা সেবা চালু করলেন সিম্পসন। আর অর্থের যোগানের জন্য সরকারি-বেসরকারি দাতাদের কাছে যে দৌড়াদৌড়ি প্রয়োজন, সেসব কাজও তখন তিনি একা হাতেই সামলাচ্ছেন। এমনকি হাসপাতালে ভর্তির পর রোগী যেন দ্রুত সেরে বাড়ি যায় সেজন্য পুষ্টিকর খাবারের মেন্যুও সিম্পসনই তৈরি করেন।

সীমিত সংখ্যক শয্যা অথচ রোগীর সংখ্যা বিপুল; একজন শয্যা ছেড়ে বাড়ি গেলে আরও একজনকে সেবা দেওয়া যাবে। সিম্পসনের একক চেষ্টায় মিটফোর্ড হাসপাতাল গরীব রোগীদের জন্য নিরাময়ের পাশাপাশি এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল। যশোর নদীয়ার বহু মানুষ তখন শল্য চিকিৎসার জন্য নিকটস্থ কলকাতা হাসপাতালের পরিবর্তে বেছে নিল মিটফোর্ড হাসপাতালকে, ডাক্তার সিম্পসনকে।

সব ভালোই চলছিল। হঠাৎ একরাতে সিম্পসনের ডায়রিয়া শুরু হলো। পথ্যের ব্যবস্থা নিজেই করছিলেন। কিন্তু তাতে ফল হয়নি। তিন দিন রোগে ভুগে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন ঢাকাবাসীর অতি আপনজন সিম্পসন।

সিম্পসনের সমাধিফলক। ছবি: আলোনলিট্রাভেলার ডট কম

সিম্পসনের মৃত্যু ঢাকাবাসীকে শোকে স্তব্ধ করে দেয়। তার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রমাণ মেলে সে সময়ে ঢাকা প্রকাশে ছাপানো জনৈক প্যারিমোহন বসুর লেখা এক চিঠিতে- "ইহার সদালাপ ও মধুর ভাষণ কেহই বিস্মৃত হইতে সক্ষম নহেন। ফলত এমন প্রশান্ত মূর্তি মৃদুমধুর ভাষী উদার প্রকৃতি ইউরোপীয় ঢাকায় বোধ হয় আর আসেন নাই। ইহার নাম স্মরণ হইলে শরীর রোমাঞ্চিত হয়"।

সিম্পসনের অকাল মৃত্যু ছিল সকলের জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলার লেফট্যানেন্ট গভর্নর এক শোকবার্তায় লিখেন –"The Lieutenant-Governor takes this opportunity of expressing his regret at the loss the public service has sustained by the death of Dr. Simpson, the late Civil Surgeon of Dacca, whose ability and special interest in this portion of his duties rendered him a most valuable officer."

ঢাকাবাসী সিম্পসনের স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখবার উদ্যোগ নেন। ঢাকার জেলা জজ এর সাথে এই উদ্যোগে যোগ দেন নবাব খাজা আব্দুল গনি, খাজা আহসানউল্লাহ, জমিদার মধুসূদন সাহা প্রমুখ। প্রথমে একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপনের সিদ্ধান্ত এলেও পরে তার পরিবর্তন হয়। ঠিক হয় সিম্পসনের স্মরণে একটি আলাদা ওয়ার্ড ভবনই তৈরি করা হবে।

সিম্পসনের মৃত্যুর এক বছরের ভেতরই তার নামে মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রাঙ্গণে তৈরি হয় চার কক্ষের নতুন এক ওয়ার্ড ভবন- 'সিম্পসন ওয়ার্ড'। ১৮৯৬ সালে ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের দানে এই দালান পরিবর্ধিত করা হয়। বর্তমানে এই দালানের আর কোনো অস্তিত্ব নেই।


লেখক পরিচিতি: তারেক আজিজের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার আজিমপুরে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে যোগ দেন শিক্ষকতায়। পিএইচডি করেছেন অস্ট্রেলিয়াতে। বর্তমানে তিনি আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি তার নেশা বই পড়া, বিশেষত ইতিহাস আর শিল্পকলার বই। তার সাথে যোগ হয়েছে ঘুরে বেড়াবার নেশা। লেখালেখি করেন টুকটাক। সেসব লেখায় তিনি নিরন্তর খুঁজে ফেরেন নিজ শহর ঢাকার বর্ণাঢ্য অতীতকে।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.