ডিএনএ টিকা কী, এটি কীভাবে কাজ করে?

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
28 September, 2021, 07:55 pm
Last modified: 28 September, 2021, 07:56 pm
এই প্রযুক্তির টিকা এমন ডিএনএ খুঁজে বের করবে যা স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে এবং সেই স্পাইক প্রোটিনকে কোষেরর মধ্যে বয়ে নিয়ে যাবে। এরপর ডিএনএটি অনুলিপির মাধ্যমে এমআরএনতে পরিণত হবে। সেই এমআরএনএ কোষকে ভাইরাল প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়, যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে।

সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে করোনাভাইরাস-প্রতিরোধী ডিএনএ টিকার অনুমোদন দিয়েছে ভারত। জাইকভ-ডি নামের এ টিকাই বিশ্বের সর্বপ্রথম ডিএনএ টিকা যা মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হবে। 

জাইকভ-ডির প্রস্তুতকারক জাইডাস ক্যাডিলা। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, তারা বছরে ১২ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। আশা করা হচ্ছে আগামী মাসেই প্রথমবারের মতো মানুষের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা যাবে। 

শুধু করোনা নয়, ক্যানসার ও এইচআইভির মতো অন্যান্য রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও কার্যকরী অস্ত্র হতে পারে ডিএনএ টিকা। এখন চলুন, জেনে নেওয়া যাক ডিএনএ টিকা কীভাবে কাজ করে এবং বাজারের অন্যান্য টিকার সঙ্গে এই টিকার পার্থক্য কী।

প্রথাগত টিকা সম্পূর্ণ ভাইরাসটিকেই নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়ে দেয়। প্রচলিত টিকার মাধ্যমে দুর্বল করে দেওয়া কিংবা নিষ্ক্রিয় ভাইরাস মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়। এই ভাইরাস শরীরের রোগ প্রতিরোধ বযবস্থাকে জীবন্ত ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রশিক্ষণ দেয়। 

প্রথাগত টিকা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এমন কিছুর সংস্পর্শে এনে দেয়, যা দেখতে যে রোগজীবাণু বা প্যাথোজেনকে আমরা প্রতিরোধ করতে চাই, ঠিক সেরকম। সেই বিশেষ রোগজীবাণু বা প্যাথোজেনকে লক্ষ্য করে শরীর এক ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং তার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি করে। পরে মানুষ যখন আসল রোগজীবাণুর সংস্পর্শে আসে, তখন শরীরে স্মৃতি জেগে ওঠে এবং সেই রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়ার জন্যে আগে থেকেই সতর্ক থাকে।

কিন্তু কোনো ভাইরাস যদি সংখ্যায় অনেক বেশি হয়, বিশেষ করে ক্রমাগত রূপ বদলাতে থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ফলে কমে যায় টিকার কার্যকারিতা। 

বিশ শতকে বিজ্ঞানীরা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আরও সহজ উপায় খুঁজতে থাকেন। এই অনুসন্ধানের পথ ধরেই আবিষ্কৃত হয় নতুন প্রজন্মের টিকা—জেনেটিক টিকা। এ ধরনের অধিকাংশ টিকাই—যেমন ফাইজার ও মডার্না—করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহৃত হয়। এই প্রযুক্তির টিকা বার্তাবাহক রাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড (এমআরএনএ) ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তিতে আরএনএ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কাছে নির্দেশনা পৌঁছে দেয় কীভাবে নিউক্লিয়াসের একটা কোষের ডিএনএ থেকে একটা প্রোটিন তৈরি করতে হবে।

যেভাবে কাজ করে ডিএনএ টিকা
জাইকভ-ডির মতো ডিএনএ টিকা কাজ শুরু করে এক ধাপ পেছন থেকে। জাইকভ-ডি মূলত ২ বা ৩ টিকার প্লাজমিড ডিএনএ প্রতিষেধক।

প্লাজমিড হলো ডিএনএর একটা ছোট গোলাকার অংশ। এই ডিএনএ প্রতিষেধক শরীরে প্রবেশ করে কোষগুলোকে কোভিডের স্পাইক প্রোটিন তৈরি করা শেখাবে। ভাইরাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ চিনতে শিখিয়ে শরীরের প্রতিরোধশক্তি জাগিয়ে তুলবে এই টিকা। 

এমআরএনএ টিকার চেয়ে ডিএনএ টিকার সুবিধা কোনো কোনো দিক দিয়ে একটু বেশি। প্রথম সুবিধা হলো, ডিএনএ টিকা পরিবহন ও সংরক্ষণ অনেক বেশি সহজ। এ কারণে এই প্রযুক্তির টিকা দুর্বল অবকাঠামোর গরিব দেশগুলোতে বিতরণ করা সহজ হবে। জাইকভ-ডিকে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়েছে।

এই প্রযুক্তির টিকা এমন ডিএনএ খুঁজে বের করবে যা স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে (ভাইরাসের যে অংশ পোষকের কোষের সঙ্গে ভাইরাসকে সেঁটে যেতে সাহায্য করে) এবং সেই স্পাইক প্রোটিনকে কোষেরর মধ্যে বয়ে নিয়ে যাবে। এরপর ডিএনএটি অনুলিপির মাধ্যমে এমআরএনতে পরিণত হবে। সেই এমআরএনএ কোষকে ভাইরাল প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়, যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে।

ভারতের জাইকভ-ডি টিকা দেওয়া হবে ত্বকের ডার্মিস স্তরে। এতে পিন ফোটানোর মতো সামান্য ব্যথা হবে শুধু।

ডিএনএ ও এমআরএনএ উভয় টিকাই অনেক বেশি সুরক্ষা দেয় এবং প্রচলিত টিকার চেয়ে এদের উৎপাদন খরচও অনেক কম। এছাড়াও এ দুই প্রযুক্তির টিকাকে ভাইরাসের মিউটেশনের সঙ্গেও সহজেই অভিযোজিত করিয়ে নেওয়া যায়। 

এমআরএনএ প্রতিষেধকের মতোই প্লাজমিড ডিএনএ প্রতিষেধকও শরীরকে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন চিনতে এবং তার বিরুদ্ধে লড়তে শেখায়। কোভিশিল্ড ও স্পুটনিক-ভি একইভাবে কাজ করে ভাইরাল ভেক্টরের মাধ্যমে। নোভোভ্যাক্স প্রোটিনটাকেই শরীরে নিয়ে যায় এবং কোভ্যাক্সিন একটা মৃত ভাইরাসকে অ্যান্টিজেন হিসেবে ব্যবহার করে।

তবে এমআরএনএ টিকার চেয়ে ডিএনএ টিকার সুবিধা কোনো কোনো দিক দিয়ে একটু বেশি। প্রথম সুবিধা হলো, ডিএনএ টিকা পরিবহন ও সংরক্ষণ অনেক বেশি সহজ। এ কারণে এই প্রযুক্তির টিকা দুর্বল অবকাঠামোর গরিব দেশগুলোতে বিতরণ করা সহজ হবে। জাইকভ-ডিকে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করলে এটি বেশি স্থিতিশীল থাকে। 

অন্যদিকে ফাইজারের টিকা সংরক্ষণ করতে হয় মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়।

আশা করা হচ্ছে, ক্যানসারের মতো অন্যান্য রোগ সারাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে জেনেটিক টিকা। এইচআইভির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সম্প্রতি একটি এমআরএনএ টিকা তৈরি হয়েছে, সেটি শিগগিরই ট্রায়ালে যাবে। করোনা মহামারির সুবাদে এ ধরনের টিকা তৈরির কাজে গতি এসেছে। আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে গুরুতর সব রোগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হবে জেনেটিক টিকা। 

ভারতে চালানো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে দেখা গেছে, জাইকভ-ডি টিকা উপসর্গমূলক কেস প্রতিরোধ করতে ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ কার্যকর। অন্য আরও কিছু কোভিড টিকার তুলনায় এ হার কম হলেও, এতেও ভালোই সুরক্ষা পাওয়া যায়। এই টিকার পরীক্ষা করা হয়েছিল ২৮ হাজার জনের ওপর। এই পরীক্ষায় নেওয়া হয়েছিল ১ হাজার জন ১২-১৭ বছর বয়সিদেরও। তাই জাইকভ-ডি বাজারে এলে ছোটরাও নিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কিছু দেশ যখন করোনা টিকা না পেয়ে হিমশিম খাচ্ছে, সেই মুহূর্তেই অনুমোদন পেল জাইকভ-ডি। এছাড়াও করোনাসহ আরও কিছু রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আশার আলো হয়ে এসেছে ডিএনএ টিকা। শিগগিরই এই প্রযুক্তির আরও কিছু টিকা বাজারে আসতে পারে। মার্কিন বায়োটেক কোম্পানি ইনোভিয়ো-র উদ্ভাবিত ডিএনএ টিকা ট্রায়ালের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়াও জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানগেস ও তাকারা বায়োর ডিএনএ টিকাও শেষ পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে।

আশা করা হচ্ছে, ক্যানসারের মতো অন্যান্য রোগ সারাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে জেনেটিক টিকা। এইচআইভির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সম্প্রতি একটি এমআরএনএ টিকা তৈরি হয়েছে, সেটি শিগগিরই ট্রায়ালে যাবে। করোনা মহামারির সুবাদে এ ধরনের টিকা তৈরির কাজে গতি এসেছে। আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে গুরুতর সব রোগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হবে জেনেটিক টিকা। 


  • সূত্র: দি ইকোনমিস্ট 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.