জেনে-বুঝেও কেন আমরা কোম্পানিগুলোর ফাঁদে পা দেই!

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
02 December, 2021, 09:40 pm
Last modified: 02 December, 2021, 09:52 pm
লোকে বিশ্বাস করতে চায় যে, যাকে তারা নিজেদের অর্থ,সময় বা হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করে- সে সত্য বলছে। সুচতুর জালিয়াত মানুষের এই বিশ্বাসেরই সুযোগ নেয়। 

চলতি বছর দেশে বহুল আলোচিত বিষয় ছিল ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের নামে জালিয়াতির ঘটনা। কিছু সংস্থার নীলনকশায় গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের ফলে এ খাতের সুনাম নষ্ট হয়। কিন্তু, প্রতারকরা চিরকালই ছিল। তেমনি আছেন সৎ ব্যবসায়ীরাও। তারপরও আমরা সাধারণ মানুষ কেন বারবার প্রতারক চক্রের অভিনব ফাঁদে পা দেই? আস্থা রাখি তাদের দেখানো দিবাস্বপ্নে? 

যুগের সাথে প্রতারক চক্রের কৌশলও বদলায়। সময়োপযোগী পরিকল্পনা করতেও জালিয়াত শিরোমনিদের জুড়ি মেলা ভার। মানুষ সৃষ্টির আদি মুহূর্ত থেকেই একে-অন্যকে প্রতারিত করে আসছে। 

যেমন- ১৮৭৬ সনে সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিন জালিয়াতের কথা জানানো হয়, যারা ব্যাংকের পাঠানো টেলিগ্রাফ বার্তার খোঁজখবর রাখতো। ফলে এটাও জানা ছিল কখন কত টাকা ব্যাংকের ভল্টে আসছে। নিজেদের অমায়িক ব্যবহারকে কাজে লাগিয়ে তারা ব্যাংক লুঠের পরিকল্পনা করেছিল। এই ঘটনা বাস্তবে ঘটেছিল কিনা তা জানা যায় না। তবে সে সম্ভাবনাই বেশি।   

ওই সময়ের আমেরিকা সম্পর্কে সাহিত্য সমালোচক কেভিন ইয়ং বলেছেন, '১৮ শতক যদি গ্রেট ব্রিটেনে ভাঁওতাবাজির সেরা সময় হয়, তাহলে আমেরিকার ক্ষেত্রে সেটা ১৯ শতক। এই সময়ের কুখ্যাতি এমনই যে, কেউ কেউ একে প্রতারকদের যুগ বলেও অভিহিত করেছেন।'  

যুগে যুগে পদ্ধতি বা কৌশল বদলালে প্রতারকরা কখনও আমাদের পিছু ছাড়েনি। প্রায়ই তারা গোপন ষড়যন্ত্রে সফলও হচ্ছে। তাই প্রশ্ন করা যেতেই পারে, কেন তাদের পাতা ফাঁদে পা দেওয়ার লোভ আমরা সামলাতে পারি না? কীভাবেই বা তারা আমাদের বিচার-বুদ্ধিকে এত সহজে ফাঁকি দিতে পারছে? 

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মনিকা টি. হুইটি বলছেন, 'এসব প্রশ্নের উত্তর একেবারেই সরল। আমরা বিশ্বাস করতে ভালোবাসি। মনোজগতের এই আদি ফাঁকটাকেই কাজে লাগায় প্রতারক। লোকে বিশ্বাস করতে চায় যে, যাকে তারা নিজেদের অর্থ, সময় বা হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করে সে সত্য বলছে। সুচতুর জালিয়াত মানুষের এই বিশ্বাসেরই সুযোগ নেয়।'   

হুইটির মতে, 'জালিয়াতির শিকার অনেক ভিকটিম মনে করেন তারা শুধু সামাজিক আচরণ পালন করেই ঠকেছেন। যেমন অনলাইনে অনেক প্রতারক অসুস্থ কোনো শিশুর চিকিৎসার কথা বলে টাকা চায়, কেউবা দেয় মোহনীয় প্রেমের প্রলোভন। কিন্তু, আমাদের সামাজিক আচরণের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সম্ভবত আমাদের এই বিশ্বাস যে, কেউ ইচ্ছে করে আমাদের মিথ্যে বলে না। 

কেভিন ইয়ং বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'ধোঁকাবাজেরা প্রায়ই শেষের এই কথাটিকে নিজ বক্তব্যের পক্ষে প্রধান যুক্তি হিসেবে দাঁড় করায়। যেমন- কারো সমবেদনা পেতে প্রতারক বলতে পারে- সে হিরোশিমায় আণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়াদের একজন বা শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার। একটু সন্দেহ প্রকাশ করলেই সে বলে বসে, 'এমন দুর্ভোগ নিয়ে আমি কেন শুধু শুধু মিথ্যা বলব?'

অধিকাংশক্ষেত্রেই তখন যিনি ক্ষণিকের জন্যেও সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন তার মনকে অপরাধবোধে ভারাক্রান্ত করে। আমরা ভাবি, আসলেই তো শুধু শুধু একজন মানুষ কেন মিথ্যা বলবে?
 
হুইটি অনলাইনে প্রতারণার শিকার বহু ব্যক্তির মধ্যেই এই ঘটনা লক্ষ্য করেছেন। ধোঁকাবাজির এই সাহসী দাবি আসলে আরও সাহসী প্রতারকের সাজানো ফাঁদের অংশ। যে ফাদের প্রতিটি স্তরকে সে ভেবেচিন্তে সাজায়। 
 
ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করার পরিকল্পনা থেকে আপনি যেসব পেশা বা পদবিকে সম্মান করেন তাদের কথাও উল্লেখ করতে পারে। 

এদেশেও ভুয়া কর্তৃপক্ষ সেজে ঠগদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটছে। 

অনলাইনে প্রতারক চক্র পুলিশ, চিকিৎসক, আইনজীবীসহ অনেক সম্মানিত পেশার লোক সাজতে পারে বা তাদের নাম নিয়ে আপনাকে তার জালে ফাঁসাবে। কিন্তু, তাদের মূল লক্ষ্য থাকে আমাদের আদিমতম প্রবৃত্তি বা জেতার ইচ্ছেকে কাজে লাগানোর। বড় পুরস্কার বা আর্থিক প্রাপ্তির প্রলোভনে সে আপনাকে আকর্ষণ করা শুরু করে। অনেক সময় একটা কিছু খটকা লাগছে জেনেও আপনি জয়ের নেশায় ফাঁদে পা দিয়েই ফেলেন।  

হুইটি ব্যাখ্যা করেন, 'একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ সচতুর জালিয়াতিকে একটি কঠিন বাজি বলে মনে করেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বড় পুরষ্কারটি তার কপালেই জুটবে এমন একটা মনোভাব তাদের মধ্যে কাজ করে। অথচ এক্ষেত্রে জেতার কোনো সম্ভাবনাই যে নেই, সেটি তারা একবারও ভাবেন না। এমন অবস্থায় প্রতারকের জন্য শুধু জেতার আশা দেখিয়ে যাওয়াই জালিয়াতি সচল রাখার জন্য যথেষ্ট হয়।' 

মনোবিজ্ঞানী মারিয়া কোনিকোভা জালিয়াতদের নিয়ে লেখা তার একটি বইয়ে লিখেছেন, 'উপযুক্ত পরিস্থিতিতে যে কেউ প্রতারণার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এসব পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সুযোগ নেওয়ার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রতারক চক্রের থাকে। এজন্যেই বর্তমান যুগে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জালিয়াতি ঘটছে। প্রতিদিনই আমরা অসংখ্য স্প্যাম মেইল পেয়েই চলেছি। মানুষ যতদিন ধূর্ত মানুষের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে বাধ্য, যতদিন আমাদের বিশ্বাস করার গুণটি থাকবে; সব ধরনের প্রতারকরাও ততোদিন আমাদের ছায়া হয়েই থাকবে। ফলে আমরাও নিজস্ব দুর্বলতার কারণেই প্রতারিত হতে থাকব, এনিয়ে প্রতারকদের নিজেদের খুব বেশি কষ্ট করতেও হবে না। কারণ আগ বাড়িয়ে ঠকতে আমরা অদ্বিতীয় এক প্রজাতি।'  

  • সূত্র: ডেইলি জেস্টর 
     

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.