কোভিড নিয়ে যত ভুল ধারণা

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক
14 August, 2021, 05:00 pm
Last modified: 14 August, 2021, 05:16 pm
এক গবেষণায় দেখা গেছে, উপসর্গবিহীন কোভিড আক্রান্তরাই প্রায় অর্ধেক নতুন সংক্রমণের জন্য দায়ী।

কোভিড নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিভিন্ন ভুল ধারণা দেখা যায়। সচরাচর দেখতে পাওয়া এমনই কিছু ভ্রান্ত ধারণা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক:

১। আমার মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি, তার মানে আমার কোভিড হলেও তা অন্যের দেহে ছড়াবে না

ভুল ধারণা! যাদের দেহে কোভিডের কোনো উপসর্গ দেখা যায় না, তারা উপসর্গযুক্ত মানুষদের চাইতে কম সংক্রামক, এটা ঠিক। কিন্তু তখন পর্যন্ত তাদের দেহে উচ্চমাত্রায় ভাইরাস থাকতে পারে এবং তা আশেপাশের অন্য মানুষের দেহে ছড়াতে পারে। আর যাদের দেহে কোভিডের উপসর্গ গড়ে ওঠে, তারা নিজেরা অসুস্থ বোধ করার এক বা দুদিন আগে থেকে তাদের দেহ উচ্চমাত্রায় সংক্রমণশীল হয়ে ওঠে।

আপনার দেহে যদি কোভিডের উপসর্গ না দেখা দেয়, তাহলে আপনার মনে ধারণা জন্মে যে আপনি একেবারে সুস্থ আছেন। এ ধরনের মানুষেরা তখন স্বাভাবিকভাবেই বাইরে ঘোরাঘুরি করে এবং অন্যদের মধ্যে ভাইরাস ছড়ায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, উপসর্গবিহীন কোভিড আক্রান্তরাই প্রায় অর্ধেক নতুন সংক্রমণের জন্য দায়ী।

তাই আপনার সুস্থ অনুভব হচ্ছে মানেই ধরে নিবেন না যে আপনি অন্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নন!

২। আমি ভ্যাকসিন নিয়েছি, তাই আমার আর কোভিড আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই

এটিও আরেকটি ভুল ধারণা, যা এই মুহূর্তে অনেকেই পোষণ করছেন। ভ্যাকসিনের পূর্ণ ডোজ নেওয়ার পরেও আবার কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন, এমন অনেক নমুনা দেখা গেছে সম্প্রতি। যদিও এদের অনেকের অবস্থায় ততটা জটিল ছিল না এবং হাসপাতালে যেতে হয়নি; কিন্তু নতুন করে কয়েক সপ্তাহ রোগে ভুগেছেন অনেকেই। এছাড়াও, ভিয়েতনাম ও ভারতের স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষেরাও একে অপরের দেহে ভাইরাস ছড়াতে সক্ষম।   

হ্যাঁ, ভ্যাকসিন আপনাকে গুরুতর অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করবে ঠিকই, কিন্তু সংক্রমিত হওয়া থেকে ততটা রক্ষা করতে পারবে না। ইংল্যান্ডের 'ইম্পেরিয়াল রিএক্ট স্টাডি' দেখিয়েছে, পুনরায় করোনা আক্রান্ত হওয়া রুখে দিতে ভ্যাকসিন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের মতো কার্যকরী।  

সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে, টিকা নেওয়াদের মধ্যেও উচ্চমাত্রায় ভাইরাল লোড থাকে বলে সাম্প্রতিক ডেটা থেকে জানা গেছে। কিন্তু ভ্যাকসিন আপনার শরীর থেকে ভাইরাসকে দ্রুত অকেজো করে দিবে।

আপনাকে বুঝতে হবে যে, ভ্যাকসিন একটা কার্যকর উপায়; কিন্তু এটা শতভাগ আদর্শ জিনিস নয়। তাই আপনাকে নিজে সচেতন থাকতে হবে এবং কোভিড বিধিমালা মেনে চলতেই হবে।

৩। আমার একবার কোভিড হয়ে গেছে, তাই আর ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন নেই

একবার কোভিড আক্রান্ত হয়ে যদি আপনি সুস্থ হয়ে উঠেন, তাহলে অবশ্যই আপনার দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু তা ভ্যাকসিন থেকে প্রাপ্ত সুরক্ষার চাইতে কম। ভ্যাকসিন আপনাকে যে ইমিউনিটি দিবে, তা বেশিদিন স্থায়ী হয়। আর যদি আপনার ইতোমধ্যেই কোভিড হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে আপনি দ্বিগুণ সুরক্ষা পাচ্ছেন, যা আপনার ইমিউনিটিকে আরও জোরদার করবে। 

তবে একবার কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পরে আপনাকে ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য অন্তত ২৮ দিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, ভ্যাকসিন নেওয়া এড়িয়ে যাওয়া মানে নিজের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া!

৪। আমার ইমিউন সিস্টেম এমনিতেই ভালো, তাই আমার ভ্যাকসিন প্রয়োজন নেই

শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকা মানে অবশ্যই একটা বাড়তি সুবিধা। কিন্তু মহামারিকালে এরকম একটি ধারণা থাকার ফলে অনেক ফিটনেস সচেতন বা স্বাস্থ্যবান মানুষও মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। আমরা এও জানি যে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১০-৩০ শতাংশ মানুষের শরীরে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোভিড থাকতে পারে; যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে তারা সামান্যই অসুস্থ হন।

আর এটা শুধুমাত্র আপনার নিজের জন্যই নয়। আপনি হয়তো কোভিড আক্রান্ত হয়ে আবার নিজের ইমিউনিটির প্রভাবে সেরেও উঠলেন; কিন্তু এর মধ্যে কতজন আপনার দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে, তা কি আপনি জানেন? সুপারমার্কেটে, গণপরিবহনে বা আত্মীয়স্বজনের সাথে মেলামেশার সময়, যাদের ইমিউনিটি কম; তাদের অনেকেই হয়তো আপনার দ্বারা কোভিড আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে এই দুর্যোগের সময় আমাদের অবশ্যই দায়িত্বশীল হওয়া উচিত যেন অন্যরা আমাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।  

৫। শিশুরা কোভিড আক্রান্ত হলেও তাদের কোনো ক্ষতি হয় না

প্রাপ্তবয়স্কদের চাইতে শিশুরা কোভিড আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকিতে কমই থাকে। কিন্তু ব্যতিক্রম হতেই পারে। ইংল্যান্ডে প্রতি ২০০ জন শিশুর মধ্যে একজন করে কোভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। কোভিড আক্রান্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শিশুদের দেহে 'মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম' তৈরি হতে পারে; যা অত্যন্ত বিপদজনক এবং নিবিড় পরিচর্যার দরকার হয়। যদিও এই রোগটি অত্যন্ত বিরল, কিন্তু কোভিড আক্রান্ত হওয়া প্রতি এক লাখ শিশুর মধ্যে একজন এই সিনড্রোমে আক্রান্ত হতে পারে।

ঠিক কতজন শিশুর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কোভিড থাকতে পারে, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। বিভিন্ন গবেষণায় এই মুহূর্তে তা ২ থেকে ৮ শতাংশ বলে জানানো হয়েছে। যেহেতু শিশুরা ভ্যাকসিন নেওয়ার উপযুক্ত নয়, তাই তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থেকেই যায়।

৬। মাস্ক পরলে কোনো কাজ হয় না 

আমরা সবাই ইতোমধ্যে জানি যে, কোভিড মূলত বাতাসে ভেসে থাকে এবং মানুষের নিঃশ্বাস নেওয়া, কথা বলা, চিৎকার করা বা গান গাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায়। হ্যাঁ, মাস্ক হয়তো পারফেক্ট নয়; কিন্তু মাস্ক পরলে আপনার নিঃশ্বাস অন্যের মুখে বাড়ি খাবে না এবং এভাবে আরেকজন আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে যাবে।

একইসঙ্গে, আপনি নিজেও সুরক্ষা পেতে চাইলে অবশ্য আপনাকে ভালো মানের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। এন৯৫, এফএফপি২ বা এফএফপি৩ মাস্কগুলো এক্ষেত্রে বেশ কার্যকর।   

৭। কোভিডের এই তরঙ্গই শেষ আঘাত...

যুক্তরাজ্যে এর আগের সবক'টি কোভিড তরঙ্গকেই 'এবারই শেষ' বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। একইভাবে বিশ্বের নানা প্রান্তের, নানা দেশের মানুষের মনও হয়তো বলেছিল যে, এটাই শেষ! কিন্তু তাদের সবার ধারণাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

যুক্তরাজ্য সরকার এবার জানিয়ে দিয়েছে যে, কোভিড পুরোপুরিই অনিশ্চিত একটি ব্যাপার। বহু বিশেষজ্ঞের ধারণা, আসছে শরতে ও শীতে সংক্রমণ আবারও বৃদ্ধি পাবে। 

এর কারণ, পুনরায় বৃদ্ধি পাওয়ার আগে সংক্রমণের মাত্রা সাধারণত কমে যায়। আপনার মনে হতে পারে যে, এসব ওঠানামা আসলে একই তরঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, আগামী মাসগুলোতে আমরা আরও সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে দেখবো।

মূলত, নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট যদি আসে এবং সেগুলো যদি ডেল্টার চাইতেও বেশি সংক্রামক হয়; তাহলে পুরো পরিস্থিতিই বদলে যাবে। ফলে, তখন আমরা আরও ভয়াবহ ও নতুন এক কোভিড তরঙ্গের সম্মুখীন হবো। হতে পারে, এই কোভিডের বিভীষিকা আরও কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছর ধরেও চলতে থাকবে। তাই এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না যে, এটাই কোভিডের শেষ তরঙ্গ!  

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান  

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.