কয়লার ব্যবহার কি শেষ হবে? জলবায়ু ঝুঁকি বাড়ছেই

ফিচার

টিবিএস ডেস্ক 
28 June, 2021, 10:35 pm
Last modified: 28 June, 2021, 10:50 pm
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে কয়লা ভিত্তিক নতুন প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। কিন্তু, সাম্প্রতিক এক বৈশ্বিক আভাসে সস্তা জ্বালানিটির চাহিদা উচ্চ হারে বৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে

দেশে পরিকল্পনা ও নির্মাণাধীন ২২টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। তার মধ্যে যাচাই-বাছাইয়ের পর ১০টি প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে সরকার। গত রোববার (২৭ জুন) এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, সময়মতো উৎপাদনে আসতে না পারায় প্রকল্পগুলো বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। 

তিনি আরও জানান, সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে আন্তরিক। এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪১ শতাংশ বিদ্যুৎ আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

তবে বহুল আলোচিত কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হচ্ছে না। 

মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে কয়লার আগ্রাসন কমেছে। তবে পূর্বাভাস বলছে, ক্ষতিকর জ্বালানির চাহিদা এবছর থেকে ফের বাড়বে। ফলে বাধাগ্রস্ত হবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের নেতিবাচক প্রভাব কমানোর সুযোগ।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের সবচেয়ে বড় উৎস হলো কয়লা। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি-র তথ্যানুযায়ী, এ বছর কয়লার চাহিদা সাড়ে ৪ শতাংশ বাড়বে।

সবুজ অর্থনীতিতে যাওয়ার পথে সরকারগুলোর সামনে বড় রাজনৈতিক বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়লা। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার বিপজ্জনক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার অর্ধেকে নামিয়ে রাখতে হবে।

১৫০ বছর ধরে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে, প্রথমে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার অর্থনীতি শক্তিশালী করার জন্য—তারপর এশিয়া ও আফ্রিকার অর্থনীতি মজবুত করতে। কয়লা এখনও বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় উৎস। যদিও পারমাণবিক ও বায়ুশক্তিসহ অন্যান্য শক্তির আগমনে এর আধিপত্য ক্রমেই কমছে।

২০১৯ সালে এক দশকের মধ্যে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলোতে খরচের পরিমাণ সর্বনিম্ন হয়ে যায়। গত ২০ বছরে যতগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে, বন্ধ হয়েছে তারচেয়ে বেশি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশিরভাগই এখন চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চলে হচ্ছে। তবে কয়েক বছর আগে যে গতি ছিল, তা-ও এখন অনেকটাই কমে এসেছে।

যেসব দেশে সম্প্রতি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছিল, কিংবা নতুন কেন্দ্র চালুর চিন্তাভাবনা হচ্ছিল—যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম—সেসব দেশও তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে দেখছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ তো ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিলই করে দিল। ভারতের মতো কিছু দেশে বিদ্যমান কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সক্ষমতার চেয়েও অনেক কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে সম্মুখীন হচ্ছে আর্থিক ক্ষতির। আমেরিকার মতো দেশগুলোতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার গতিতে আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।

তবে কয়লার এখনও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। করোনা মহামারির পর দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতি যত দ্রুত সম্ভব পুনরুদ্ধার করতে চাইবে। সেইসাথে চাইবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নও কমিয়ে আনতে। সুতরাং, এ বছরে জলবায়ু কূটনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকবে কয়লা। বাইডেন প্রশাসন বিভিন্ন দেশে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধের জন্য বাইডেন প্রশাসন মিত্রদেশ জাপান ও কোরিয়ার সমর্থন আশা করছে। কয়লার ব্যবহার বাড়িয়ে চলার জন্য নিয়মিত চীনের সমালোচনা করে আসছে আমেরিকা। চীন এখন বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহার করছে। দেশটি ঘরে-বাইরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়ে চলেছে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশটির নাম চীন।

ক্রমেই বাড়ছে কয়লার বিরোধিতা:

শিল্পযুগের শুরু থেকে বাড়িতে বিজলি বাতি জ্বালাতে, কারখানা চালাতে, রান্না করতে, ঘর গরম রাখতে প্রধান জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে কয়লা। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বিশ্বের সিংহভাগ কয়লা ব্যবহার করেছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে মোট কয়লার দুই-তৃতীয়াংশই ব্যবহার করে চীন-ভারত।

এরপর বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাবার জন্য অন্যান্য শক্তি ব্যবহার হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আছে পারমাণবিক, বায়ু, হাইড্রোজেনশক্তি। নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর আগমন হলেও কয়লা কিন্তু পিছু হটেনি।

বর্তমানে অনেকেই কয়লার বিরুদ্ধে মুখ খুলছে। কয়লাসৃষ্ট ধোঁয়ার কারণে হওয়া বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে লোকে। বায়ু ও সৌরশক্তি—একসময় যা কয়লার চেয়ে ব্যয়বহুল ছিল—দিন দিন কয়লার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে।

কয়েক বছরের আইনি লড়াইয়ের পর, গত নভেম্বরে, দক্ষিণ আফ্রিকার লিমপোপো প্রদেশে একটি প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়।

অন্তত তিনটি দেশে চীনের অর্থায়নে করা প্রকল্প ঝামেলায় পড়েছে কিংবা বাতিল হয়ে গেছে। কেনিয়ায় মামলার কারণে একটি প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। মিশরে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ স্থগিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশেও চীনের অর্থায়নে করা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা যাচাই-বাছাই করে দেখছে সরকার। ইতিমধ্যে সরকার ১০টি প্রকল্প বাতিলই করে দিয়েছে।

ঋণে জর্জরিত পাকিস্তান নতুন কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো স্থগিত করে দিয়েছে। ভিয়েতনামও নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প থেকে সরে এসেছে। ফিলিপাইনও জনসাধারণের চাপে নতুন প্রকল্প মুলতুবি রেখেছে।

কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো বাতিল হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো- অর্থসমস্যা। উন্নয়ন ব্যাংকগুলো কয়লা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কয়লার বড় দুই পৃষ্ঠপোষক, জাপান ও কোরিয়া নতুন কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের ওপর বিধিনিষেধ বাড়িয়েছে। জাপান নিজ দেশে এখনও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাচ্ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা গত অক্টোবরে বলেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে তার দেশ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করবে।

বড় কিছু ব্যতিক্রমও আছে। ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া তাদের খনিগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ কয়লা উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে। ব্রিটেনও সম্ভবত একটি নতুন কয়লাখনি খুলতে যাচ্ছে। এদের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কয়লাব্যবহারকারী দুই দেশ চীন ও ভারত তো আছেই।

চীন সরকার ইস্পাত, সিমেন্ট ও অন্যান্য শক্তিখরুচে শিল্পপণ্যে উৎপাদনে উৎসাহিত করছে। ফলে কয়লার চাহিদা গেছে বেড়ে। ২০২০ সালে চীনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ৩৮ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে (এক গিগাওয়াট বিদ্যুৎ দিয়ে একটি মাঝারি আকারের শহরের চাহিদা খুব ভালোমতো মেটানো যায়)।

চীনে কয়লার ভবিষ্যৎ এখন বিতর্কের কেন্দ্রে। প্রখ্যাত উপদেষ্টারা নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ স্থগিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানিগুলো জোর দিয়ে বলছে, আগামী দিনে চীনকে আরও বেশি কয়লা পোড়াতে হবে।

এদিকে ভারতের কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের আকারও দিন দিন বেড়েই চলেছে। কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানোর মতো কোনো ইঙ্গিতই আসছে না সরকারের তরফ থেকে। নয়া দিল্লি সরকার দেশের সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে বেশি দূষণকারী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে চালু থাকতে দিচ্ছে। এ বছর যদি ভারতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হয়, তবে দেশটিতে কয়লার চাহিদা ৯ শতাংশ বেড়ে যাবে।

তবে কয়েক বছর আগে ভারতে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের আকার যত দ্রুত বাড়ছিল, এখন আর তত দ্রুত বাড়ছে না। কাগজে-কলমে ভারত ২০২৬ সালের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ৬০ গিগাওয়াটে উন্নীত করতে চায়—কিন্তু বিদ্যমান বহু বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা তাদের রাজ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন।

বড় প্রশ্ন গ্যাসকে ঘিরে:

অনেক দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে যা এসেছে, সেটি হলো গ্যাস।

বাংলাদেশ থেকে ঘানা, ঘানা থেকে এল সালভাদরে সরকারিভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে পাইপলাইন সংস্কারে, টার্মিনাল ও স্টোরেজ ট্যাঙ্ক বসাতে। চার বছরেরও কম সময়ে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করা দেশের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এখন বিশ্বজুড়ে সকল শক্তির এক-চতুর্থাংশই আসে গ্যাস থেকে।

গ্যাস কয়লার চেয়ে কম পরিবেশদূষণ করে। গ্যাসের সমর্থকদের দাবি: যেসব দেশ জ্বালানি সংকটে ভুগছে, ওগুলোতে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানো উচিত। বিরোধীদের দাবি: গ্যাস প্রকল্পে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা, এসব প্রকল্পও বহু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতোই মাঝপথে বাতিল হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও গ্যাস পোড়ানোর ফলে মিথেন নিঃসৃত হয়। যা জলবায়ু পরিবর্তন ধীর করার জন্য স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তির পরিপন্থী।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিদ্যুৎ সরবরাহের বড় একটা অংশ আসে গ্যাস থেকে (যথক্রমে ৩৫ ও ২০ শতাংশ)। কাতার, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষ গ্যাস রপ্তানিকারকদের একটি।

ভিয়েতনামে মার্কিন কোম্পানিগুলো একটি গ্যাস রপ্তানি টার্মিনাল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে তরতর করে। সরকার কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানোর চিন্তা করছে। এ বছর সাব-সাহারান আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করেছে ঘানা। আমেরিকার এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বাড়িঘর ও ব্যবসাক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য গ্যাস ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছে।

এদিকে বাইডেন প্রশাসন বিশ্ব জলবায়ুর নেতৃত্বে আসতে চাইছে। কিন্তু গ্যাস আমদানি, বিশেষ করে দেশের বাইরে জনসাধারণের টাকায় গ্যাস অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে কী নীতি নিচ্ছে, তা পরিষ্কার করেনি মার্কিন প্রশাসন।

কয়লার বিরুদ্ধে শক্ত জনমত রয়েছে। কিন্তু বড় প্রশ্নটা এখন গ্যাসকে ঘিরে। গ্যাস থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেটিই এখন ভাবার বিষয়।

  • সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস 

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.