আদিবাসী ভাষা: বর্ণমালা থাকলেও হয় না পাঠদান
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করেন লাখো আদিবাসী। তাদের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য; নিজস্ব পোশাক। এ ছাড়া নিজেদের ভাষায় কথা বলতেও তারা স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। এরই মধ্যে নিজেদের ভাষার জন্য তৈরি করেছেন বর্ণমালা। যদিও নানা সমস্যার কারণে বন্ধ হতে চলেছে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের কার্যক্রম। তারা শুধু মৌখিকভাবে নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করছেন।
সীমিতভাবে বর্ণমালা ও ভাষা শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং বই ছাপাতে আর্থিক সংকটের কারণে তারা মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
বর্ণমালা নিয়ে বিভক্ত খেয়াং ভাষাশিক্ষা
খেয়াং ভাষায় বাইরের অনেক শব্দ ঢুকেছে। বিশেষ করে মারমা, বাংলা ও কিছু ইংরেজি শব্দ। কোনটি মৌলিক আর কোনটি উপভাষা তা বাছাই করতে হয়েছে। এরপর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ধ্বনি, উচ্চারণ ও সুর নিয়ে ২০০৪ সালে কাজ শুরু হয়। ২০০৮ সালে শেষ হয় বর্ণমালা তৈরির চূড়ান্ত কাজ। বলেছিলেন প্রথম খেয়াং বর্ণমালার উদ্ভাবক ক্যসামং খেয়াং।
তিনি আরও জানান, এটি চীন-তিব্বতি ভাষা পরিবারের অর্ন্তভুক্ত। খেয়াং বর্ণমালা নিজস্ব ও মৌলিক ধ্বনি দিয়ে তৈরি হয়েছে। এর কোনো বর্ণ বাইরে থেকে ধার করে করা হয়নি। এতে মোট ২৮টি বর্ণ রয়েছে। এর মধ্যে ছিল সাতটি স্বরবর্ণ ও ২১টি ব্যঞ্জন বর্ণ। সে সময় ইউএনডিপির জন ক্রিপ্টন নামে একজন বর্ণমালা বিশেষজ্ঞ এগুলো তত্ত্বাবধান করেছিলেন।
শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী মংহ্লাপ্রু খেয়াং বলেছেন, প্রথম তৈরি বর্ণমালা সর্বজনে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। সে সময় ইউএনডিপি ও ইউনিসেফ পরিচালিত স্কুলে শিশুদের জন্যও পাঠ্য বই তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে পাঁচজন শিক্ষক মিলে আরেক দফায় খেয়াং বর্ণমালা তৈরি নিয়ে ভিভক্ত হয়ে পড়েন।
ওই পাঁচ শিক্ষকের একজন চিংহ্লা উ খেয়াং বলেন, নতুন ও পুরাতন বর্ণমালা নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য খেয়াং বর্ণমালা সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই অভিন্ন বর্ণমালা তৈরি হবে।
২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী, খেয়াং জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দুই হাজার ৯৮৬ জন হলেও বর্তমানে এ সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা গেছে। বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি ছাড়া রাঙ্গামাটির কাপ্তাই ও রাজস্থলী উপজেলায় খেয়াংদের বসবাস।
উদ্ভাবনেই সীমাবদ্ধ চাক বর্ণমালা
বান্দরবান জেলার সর্ব দক্ষিণের উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ির মাত্র দুইটি ইউনিয়নে চাকদের বসবাস। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার ৩৯২ জন। তবে সংখ্যায় যত কমই হোক; সবাই মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে। রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালাও।
চাক বর্ণমালার উদ্ভাবক মংমং চাক বলেন, দীর্ঘ সময় লেগেছে চাক বর্ণমালা তৈরি করতে। এ কাজের জন্য ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে গিয়ে ভাষা বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতাও নেওয়া হয়েছে। এরপর বহু গবেষণা শেষে ২০১১ সালে এই চাক বর্ণমালা প্রকাশ করা হয়।
তিনি জানান, চাক বর্ণমালা আর্য ভাষাগোষ্ঠীর পরিবার থেকে এসেছে। মোট বর্ণ ৪৫টি। এতে ৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণ ও ১১টি স্বরবর্ণ রয়েছে। তবে চাকদের বর্ণমালা ৬০ ভাগেরও বেশি বার্মিজ বর্ণমালা দ্বারা প্রভাবিত।
চাক ভাষা কমিটির সদস্য মংশৈচিং চাক জানান, বর্ণমালা উদ্ভাবনের পর মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য কিছু শিক্ষককে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যবস্থাপনার অভাব, বই ছাপানোর খরচ ও আর্থিক সংকটে ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম বেশি দূর এগুতে পারেনি।
বিপন্ন ও প্রান্তিক ভাষা খুমি
পাহাড়ে সবচেয়ে কম ভাষী জনগোষ্ঠী হলো খুমি। সরকারি হিসেবে ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা মাত্র এক হাজার ৭২৯ জন। তবে তাদের সামাজিক সংগঠন ‘খুমি সোস্যাল কাউন্সিল’র মতে বর্তমানে তাদের জনসংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
উচ্চ শিক্ষায় প্রথম স্নাতক করা লেলুং খুুমি বলেন, ১৯৩০ সালে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের এক খ্রীস্টান ধর্মযাজক খুমিদের বর্ণমালা তৈরি করেছেন। লিখিত এ বর্ণমালা রোমান হরফের। এটি কুকি-চিন ভাষা পরিবারে অর্ন্তভুক্ত। মোট ২৫টি বর্ণমালার মধ্যে স্বরবর্ণ রয়েছে ছয়টি।
সংস্কৃতিকর্মী সিয়ং খুমির মতে, বর্ণমালা তৈরির পর ১১ ব্যক্তি এ ভাষা আয়ত্ব করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন। তবে এ বর্ণমালা বিশেষজ্ঞরা বর্তমানে সবাই মিয়ানমারের থাকেন।
পরে কিছু খুমি ১৯৭০ সালে সেখানে বেড়াতে যাওয়ার মাধ্যমে লিখিত বর্ণমালা এদেশে নিয়ে আসেন। শব্দ ও সুর খুমিদের আঙ্গিকেই রয়েছে। তবে জনসংখ্যা কম ও পাঠদানের ব্যবস্থা না থাকায় এ ভাষা সবচেয়ে বিপন্ন ও মৌখিক ভাষার উপরে টিকে আছে বলে জানান তারা।
চর্চা বাড়ছে ম্রো ভাষার
কুকি-চিন ভাষা পরিবারে আরেক জনগোষ্ঠী ম্রো। ২০১১ সালের আদমশুমারীতে তাদের জনসংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার ৬৫৬ জন। তবে ম্রো সোস্যাল কাউন্সিলের করা জরিপ অনযায়ী বর্তমানে তাদের জনসংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার।
এক সময় ম্রোদের কোনো বর্ণমালা ছিল না। পরে ১৯৮৫-৮৬ সালে ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ মেনলে ম্রো পূর্ণাঙ্গভাবে বর্ণমালা তৈরি করতে সক্ষম হন। সে সময় পাঁচ হাজার ম্রোদের উপস্থিতিতে তিনি এই বর্ণমালা প্রকাশ করেছেন বলে জানালেন এ সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিংইয়ং ম্রো।
তিনি বলেন, ম্রোদের ৩১টি বর্ণমালা রয়েছে। এর মধ্যে আটটি স্বরবর্ণ। বর্ণমালার উদ্ভাবক মেনলে নিজেও ম্রো ভাষায় কবিতা, গান ও গল্প লিখেছেন। যা পরবর্তীতে গোটা ম্রো সমাজে ভাষা শিক্ষার উপর দারুণ প্রভাব ফেলে। এছাড়া ¤্রােদের জন্য তিনি ক্রামা নামে একটি নতুন ধর্মগ্রন্থও রচনা করেছেন।
ম্রো ভাষার প্রথম তরুণ লেখক ইয়াঙান ম্রো জানান, নিজেদের সামাজিক, ইতিহাস ও ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন বিষয় বাংলার পাশাপাশি ম্রো ভাষাতে লেখা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ম্রো ভাষায় তার পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
বর্ণমালা তৈরি ও ভাষা প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী ড. সৌরভ শিকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, নিজস্ব মাতৃভাষার জন্য বর্ণমালা তৈরি একটি ভালো উদ্যোগ।
‘কিন্তু এসব বর্ণমালার ধ্বনি, উচ্চারণ ও সুর নিয়ে ভাষা বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া এগুলো নিয়ে আরও গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে।’ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।